সেপ্টেম্বর ০৩, ২০২২ ১৭:৪১ Asia/Dhaka

বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই জানো যে, শরৎ ঋতুর প্রথম মাস অর্থাৎ ভাদ্র মাসের ১২ তারিখে মৃত্যুবরণ করেন বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ১৩৮৩ বঙ্গাব্দের ১২ ভাদ্র ঢাকায় তৎকালীন পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মহান প্রভূর ডাকে সাড়া দিয়ে পরপারে চলে যান তিনি।

কবির ৪৬তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আমরা একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি। এতে কবির সংগ্রামী জীবন, কর্ম ও শিশু সাহিত্যের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করব। সেইসঙ্গে শোনাব কবির লেখা ছড়াগান ও কবিতা। আমাদের আজকের অনুষ্ঠানটিও তৈরি করেছেন আশরাফুর রহমান। আর উপস্থাপনায় রয়েছি আমি গাজী আবদুর রশীদ ও আমি আকতার জাহান।

বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই শুনেছো যে, কাজী নজরুল ইসলাম ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তবে, তিনি ছিলেন বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের কবি। গ্রাম-বাংলার অসহায় মানুষ থেকে শুরু করে শহরের বড় বড় দালান কোঠার বাসিন্দারাও কবি নজরুলকে মনে প্রাণে ভালোবাসে। কবি ছিলেন সমাজের নির্যাতিত, নিপীড়িত ও অসহায় মানুষে মুখপাত্র।

নিজে দুঃখ-কষ্টের মধ্যে বেড়ে উঠেছিলেন বলেই হয়তো মানুষের দুঃখ-দুর্দশা কবিকে দারুণভাবে আলোড়িত করতো। শৈশবে আর্থিক অনটনের কারণেই তিনি মাজারের খাদেম, মসজিদের ইমাম এবং রুটির দোকানের কর্মচারী হিসেবে কাজ করেছেন। শত দুঃখের মধ্যে বড় হলেও তিনি দুঃখ-কষ্টকে জয় করার স্বপ্ন দেখতেন। বর্ধমানের চুরুলিয়া, রাণীগঞ্জের শিয়ারসোল ও ময়মনসিংহের দরিরামপুর- যেখানেই তিনি কৈশোর কাটিয়েছেন সেখানেই তাঁর কৈশোর ছিল দুরন্তপনায় ভরা। মুক্ত আকাশের উদার হাতছানি তার দুঃখ-কষ্টকে ভোলার মন্ত্র শিখিয়েছিল।

দুরন্তমনা, চঞ্চল আর বাঁধনহারা মনোভাবের কারণে কবি নজরুল কোনোখানেই স্থায়ীভাবে বাস করতে পারেননি। তাই তো দরিরামপুর স্কুল থেকে পালিয়ে গিয়ে ভর্তি হন রাণীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুলে। সেখানে বন্ধু হিসেবে পান শৈলজানন্দকে। নজরুল তখন মাঝে মাঝে ছোট গল্প লিখতেন আর শৈলজানন্দ লিখতেন কবিতা। তারা একজন আরেকজনকে তাদের লেখা দেখাতেন। শৈলজানন্দের কবিতা শুনে নজরুল তাঁকে বাহবা দিতেন এবং নজরুলের গল্পে মুগ্ধ হতেন শৈলজা। একসময় শৈলজানন্দ কবিতা বাদ দিয়ে শুরু করলেন গল্প লেখা। আর নজরুল শুরু করলেন কবিতা লেখা। নজরুল প্রথম যে কবিতাটি লিখলেন তা বেশ হাসির। কবিতাটি এরকম-

এপার হতে মারলাম ছুরি লাগল কলা গাছে

হাঁটু বেয়ে পড়ল রক্ত, চোখ গেলরে বাবা!

কবিতাটি লেখার পর নজরুল তা শৈলজানন্দকে শোনালেন। কবিতাটি শুনে শৈলজা হেসে কুটি কুটি। অবাক হয়ে বললেন, এ তোর কেমন কবিতা? ছুরি মারলি কলা গাছে আর রক্ত বেরুল হাঁটু বেয়ে! এটা কেমন করে হয়? নজরুলের স্পষ্ট জবাব- কবিতা নাহয় না হলো, হাঁটু বেয়ে রক্ত তো পড়ল। একথা বলার পর দু'বন্ধুই খুব করে হেসে উঠল।

কাজী নজরুল ইসলাম

কবি নজরুল ইসলাম শৈশবে যেমন হাস্যরসিক ছিলেন, তেমনি বড় হয়েও তিনি তার লেখায় ব্যাপক হাস্যরসের সৃষ্টি করেছেন। খাঁদু দাদু কবিতায় তিনি লিখেছেন- 

ও মা! তোমার বাবার নাকে কে মেরেছে ল্যাং? 
খ্যাঁদা নাকে নাচছে ন্যাদা- নাক ড্যাঙ্গা-ড্যাং- ড্যাং! 
ওঁর নাকতাকে কে করল খ্যাঁদ্যা রাঁদা বুলিয়ে? 
চামচিকে- ছা ব'সে যেন ন্যাজুড় ঝুলিয়ে। 
বুড়ো গরুর টিকে যেন শুয়ে কোলা ব্যাং। 
অ মা! আমি হেসে মরি, ন্যাক ডেঙ্গাডেং ড্যাং। 

ছোট্টবন্ধু হুমায়রা আফনান নাবার উচ্চারণে কবিতাটি শুনলে। আশা করি ভালো লেগেছে। বন্ধুরা, হাস্যরসযুক্ত কবিতা রচনায় নজরুলের জুড়ি মেলা ভার। তিনি লিখেছেন,

আমি যদি বাবা হতুম, বাবা হতো খোকা,
না হলে তার নামতা,
মারতাম মাথায় টোকা।।

অন্য কবিতায় তিনি লিখেছেন,

'মা, খাবার কথা বলি যদি

ভাববি পেটুক ছেলে,

আমি ভাত না খেয়েও থাকতে পারি

পোলাও লুচি পেলে।'

বন্ধুরা, কাজী নজরুল ইসলাম তার কবিতায় বাবা-মায়ের সাথে দুষ্টুমি করলেও মাকে নিয়ে তিনি লিখেছেন হৃদয় কাঁপানো এক বিখ্যাত কবিতা। এ পর্যায়ে সেই কবিতাটি শোনা যাক।

যেখানেতে দেখি যাহা
মা-এর মতন আহা
একটি কথায় এত সুধা মেশা নাই,
মায়ের মতন এত
আদর সোহাগ সে তো
আর কোনখানে কেহ পাইবে না ভাই!

হেরিলে মায়ের সুখ
দূরে যায় সব দুখ,
মায়ের কোলেতে শুয়ে জুড়ায় পরান,
মায়ের শীতল কোলে
সকল যাতনা ভোলে
কতনা সোহাগে মাতা বুকটি ভরান।

বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই অবগত আছো যে, কবি কাজী নজরুল ইসলামের যোগ্যতা ছিল বহুমাত্রিক। তিনি আমাদের জন্য রেখে গেছেন অজস্র কালজয়ী কবিতা, গান, নাটক, প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস প্রভৃতি। নজরুল কিন্তু শুধু কবিই ছিলেন না; একই সাথে তিনি গীতিকার, সুরকার, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, সৈনিক ও দার্শনিকও ছিলেন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ দুই বাংলাতেই তাঁর কবিতা ও গান সমানভাবে সমাদৃত। তাঁর কবিতায় বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাঁকে ‘বিদ্রোহী কবি’ বলা হয়।

কাজী নজরুল ইসলামকে বিদ্রোহী কবি হিসেবে দেখা হলেও ছোটদের সঙ্গে তাঁর বেশ বন্ধুত্ব ছিল। ছোটদের খুব ভালোবাসতেন তিনি। সত্যি বলতে কী, ছোটদের স্বপ্ন জাগানিয়া কবি ছিলেন নজরুল। তিনি বলছেন-

আমি হব সকাল বেলার পাখি 
সবার আগে কুসুম-বাগে উঠব আমি ডাকি 

কবির এই ইচ্ছা কিন্তু শুধুমাত্র সকাল বেলার পাখি হওয়া নয়, একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে বোঝা যাবে এর ভেতরে রয়েছে অনেক গূঢ় তাৎপর্য। সেটি হলো এই যে, সবাই যদি ওই পাখির মতো সবার আগে জাগতে পারে এবং জাতিকে জাগানোর চেষ্টা করে তাহলে গোটা জাতিই জেগে উঠবে।

দেশপ্রেম, মুক্তির আকাঙ্ক্ষা, অন্যায়ের প্রতিবাদ, উজ্জীবনের সুর, ধর্মচেতনা, মানবতা, সাম্য, হাস্যরস এবং বিজ্ঞান জগতের নব উদ্ভাবনী চিন্তা কবি নজরুলের লেখায় স্থান পেয়েছে। তার ‘সঙ্কল্প’ কবিতা ও ‘জাগো সুন্দর চিরকিশোর’ নাটকে বিজ্ঞান মনস্কতা উঠে এসেছে প্রবলভাবে। ‘সঙ্কল্প’ কবিতাটি নানাভাবে অসাধারণ। বিশেষ করে উদ্দীপনা ও বিজ্ঞানময়তার কারণে। এ কবিতায় কবি কিশোর মনের প্রশ্ন করে বলেন,

‘দেশ হতে দেশ-দেশান্তরে 
ছুটছে তারা কেমন করে,
কিসের নেশায় কেমন করে মরছে যে বীর লাখে লাখে,
কিসের আশায় করছে তাঁরা বরণ মরণ-যন্ত্রণাকে।’

বৃদ্ধ বয়সে কাজী নজরুল ইসলাম

বন্ধুরা, তোমরা জেনে অবাক হবে যে, কবি নজরুল তার কবিতায় যখন ‘হাউই’ জাহাজের কথা বলেছেন তখন হেলিকপ্টার বা বিমান আবিষ্কারই হয়নি! বিজ্ঞানীরা ষাটের দশকে হেলিকপ্টার এবং বিমান আবিষ্কার করেন। সত্তরের দশকে রকেটে করে চাঁদে যান। আর নজরুল ত্রিশের দশকেই নিখুঁতভাবে কল্পনা করতে পেরেছেন সে-সব বিষয় নিয়ে। এ কল্পনার মাধ্যমে তিনি কিশোর-তরুণদের উদ্দীপনা জুগিয়েছেন আগামীর বিশ্বকে সাজিয়ে তোলার।

গোটা বিশ্বজগৎ হাতের মুঠোয় ধরার সাহস একমাত্র কবি নজরুলই দেখিয়েছেন! বাংলা ভাষার আর কোনো কবি এমন করে ভাবেনওনি কেউ আর। তাঁর কল্পনা শক্তি ও সাহস ছিলো সীমাহীন। স্বপ্ন ছিল আকাশের চেয়েও বড়। সপ্ত আকাশ ভেদ করার কথা তিনিই বলেছেন। তিনি সত্যের ব্যাপারে ছিলেন আপসহীন। মিথ্যা পচা জীর্ণতার বিরুদ্ধে ছিল তাঁর প্রতিবাদ।

তিনি বিদ্রোহ করেছেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে। অসুন্দরের বিরুদ্ধে। মিথ্যা ও কলুষতার বিরুদ্ধে। মানুষের প্রতি ছিল তাঁর অপরিসীম ভালোবাসা। গরিব দুঃখী অসহায়ের প্রতি ছিলো দারুণ মমতা। তিনি এসব মানুষের পক্ষে কবিতা লিখেছেন। এসব অধিকারহীন মানুষের অধিকারের কথা লিখেছেন। বঞ্চিতজনের কথা লিখেছেন। যারা মানুষের ওপর নির্যাতন করে, মানুষের অধিকার লুট করে, মানুষকে মানুষ হিসেবে গণ্য করে না তাদের বিরুদ্ধে কবিতায় উচ্চারণ করেছেন দ্রোহ। তাদের শাস্তি চেয়েছেন। তাদের বলেছেন মানুষের দুশমন। মানবতার দুশমন। সমাজে অবহেলিত মানুষের প্রতি তার প্রচণ্ড ভালোবাসা ছিলো। তিনি এসব মানুষের স্বাধীনতার কথা বলেছেন তীব্রভাবে।

নজরুল আমাদের স্বাধীনতার প্রতীক। আমাদের সাহসের উপমা এবং আমাদের সুন্দরের প্রতিনিধি। কবিতায় গানে এসব সুন্দরের কথা বলেছেন তিনি। গেয়েছেন সুন্দরের গান। তাঁর গানে স্বপ্ন আছে। আশার আকাশ আছে। প্রেরণার উচ্ছ্বাস আছে। আছে ন্যায় ও নতুনের পথে যাত্রার সাহস। নজরুল আমাদের শিখিয়েছেন মানুষকে ভালোবাসার মন্ত্র। মানুষকে সম্মান দেয়ার বাণী। তাইতো তিনি বলেছেন-

“গাহি সাম্যের গান

মানুষের চেয়ে বড় কেউ নয়

নহে কিছু মহীয়ান।”

সৃষ্টির ভেতর মানুষই সবচেয়ে বড়। স্রষ্টা মানুষকে এমন বড় করে মহান করে পাঠিয়েছেন দুনিয়ায়। দুনিয়ার আর যত সৃষ্টি সবই মানুষের জন্য। আর মানুষকে বানানো হয়েছে স্রষ্টার গুণগানের জন্য। স্রষ্টার প্রশংসায় ডুবে থাকার জন্য। স্রষ্টার সৌন্দর্য অনুধাবন করে তা প্রচারের জন্য। তার বিরাটত্ব এবং মহানত্ব অনুভবের জন্য।

কবির সমাধি

কবি নজরুল মানুষকে ডেকেছেন সত্য ও সুন্দরের দিকে। মানুষকে জেগে ওঠার কথা বলেছেন তিনি। প্রয়োজনে সাবধান করেছেন গোটা জাতিকে। বলেছেন তোমাদের সামনে রয়েছে দুর্গম পাহাড়, মরু এবং ঝড় ঝঞ্ঝা। এসব পাড়ি দিতে হবে। অতএব হুঁশিয়ার হে যাত্রীদল। তার ভাষায়-

“দুর্গম গীরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুঁশিয়ার।”

বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই নানা রকমের প্রজাপতি দেখেছো। কোনোটার পাখার রং টুকটুকে লাল বা নীল, কারো গায়ে সোনালী কিংবা রূপালী পরাগ মাখা। প্রজাপতি বন্ধনহীনভাবে বনে বনে ফুলে ফুলে মধু খেয়ে উড়ে বেড়ায়। তোমাদের মনও নিশ্চয়ই প্রজাপতির নেচে নেচে আনন্দ পায়! শিশুদের ছন্দময় ও স্বপ্নের মতো রঙিন অনুভূতিকে ব্যক্ত করেছেন কবি তার রচিত একটি বিখ্যাত গানে। এবার গানটি শোনা যাক।

ছোট্টবন্ধুদের কণ্ঠে গানটি শুনলে। কেবল প্রজাপতি নয়, ফুল-পাখিদের নিয়ে মজার মজার কবিতা লিখেছেন কাজী নজরুল। ‘খুকি ও কাঠবেড়ালি’ কবিতার প্রতিটি পঙক্তিতে ছড়িয়ে আছে শিশু মনের স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা আর সংলাপ। আনন্দ, বেদনা, চাওয়া আর শিশুসুলভ খুনসুটিও আছে এখানে।

কবি নজরুল ইসলাম ছোটদেরকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন, সামনে চলার সাহস দেখিয়েছেন। তাদেরকে বুকে টেনে নিয়েছেন বড় মমতায়। কিশোর কাননে নজরুলের উপস্থিতি আর অবস্থান একজন প্রকৃত দরদি অভিভাবকের মতই। এ জন্য তিনিও আমাদের হৃদয়ে মিশে আছেন গভীর শ্রদ্ধায় ও ভালোবাসায়।

সবার প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম দীর্ঘসময় বাকরুদ্ধ থাকার পর ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২৯ আগস্ট তারিখে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। নজরুল তাঁর একটি গানে লিখেছেন,

“মসজিদেরই কাছে আমায় কবর দিয়ো ভাই/

যেন গোরের থেকে মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই”।

কবির এই ইচ্ছার বিষয়টি বিবেচনা করে কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাধিস্থ করা হয়।   

বন্ধুরা, কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুবার্ষিকীতে তার রুহের মাগফিরাত কামনা করে আজকের এই বিশেষ অনুষ্ঠান থেকে বিদায় নিচ্ছি। কথা হবে আবারো রংধনুর আগামী আসরে।#

পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/৩

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ