সেপ্টেম্বর ০৮, ২০২২ ১৮:০৯ Asia/Dhaka

গত পর্বের আলোচনা অনুষ্ঠানে আমরা জ্ঞান-বিজ্ঞানে মধ্যযুগে বিখ্যাত ইরানি মনীষী আল খাওয়ারিজমির অবদান ও তার মূল্যবান বেশ কিছু গ্রন্থ সম্পর্কে আলোচনা করেছিলাম।

 

আল খাওয়ারিজমি পাটিগণিতের ক্ষেত্রে অনেক বড় অবদান রাখেন। পাটিগণিত বিষয়ে তিনি একটি বই রচনা করেন যা পরবর্তীতে ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। খ্রিষ্টীয় ৬ষ্ঠ শতকে হিন্দু গণিতবিদগণ দশমিক পদ্ধতির উদ্ভাবন করেছিলেন এবং এ পদ্ধতিকে খাওয়ারিজমিই প্রথম ইসলামি জগতে নিয়ে আসেন।

আল খাওয়ারিজমি বীজগণিতের জনক হিসেবে পরিচিত। তার হাতে গণিতের এ শাখাটি পরবর্তী সময়ে আরও উৎকর্ষতা লাভ করে। বর্তমানে গণিতবিদ্যার উন্নয়নের ফলে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় যে উন্নতি হয়েছে তা সম্ভব হয়েছে আল খাওয়ারিজমি উদ্ভাবিত গনিত বিষয়ক নীতিমালারই কারণে। আমরা যখন কোন সমীকরণ সমাধান করি তখন x অথবা y এর একটি করে মান পেয়ে থাকি যা একঘাত সমীকরণ নামে পরিচিত। আবার দ্বিঘাত সমীকরণের দুটি মান পাওয়া যায়। এই দুই ধরনের সমীকরণের বিশ্লেষণধর্মী ব্যাখ্যা তুলে ধরেন আল খাওয়ারিজমি। আর অ্যালজেবরা আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে এর উপযোগিতা অভাবনীয়ভাবে বেড়ে যায়। মধ্যযুগের আর কোনো গণিতবিদই গনিতজগতে তার সমান্তরাল কর্ম উপস্থাপন করে যেতে পারেননি।

ভারতীয় পরিসংখ্যান ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করার সময় আল খাওয়ারিজমি আবিষ্কার করেন ভগ্নাংশের বিষ্ময়কর দিক। তার এই কাজগুলো পরিচিত ছিল আরব্যকর্ম হিসেবে। পরে তার কর্ম অবদানগুলো পৌঁছে গিয়েছিল ইউরোপে। ইউরোপীয়রা দ্রুত তার বই ও লেখাগুলো অনুবাদ করে নেন। এ কারণে ইউরোপে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। তিনি দশমিক ব্যবস্থাকে এক নতুন দিগন্তে পৌঁছে দিতে চাইলেন, এক্ষেত্রে তার অবদান প্রশংসনীয়।

গণিতের একটি শাখা হলো ত্রিকোণমিতি। সমকোণী ত্রিভুজের তিন কোন ও বাহু নিয়ে আলোচনা করা হয় ত্রিকোণমিতিতে। ত্রিকোণমিতির বিস্তারিত উপাত্ত উদ্ভাবন করেন আল খাওয়ারিজমি। তিনি কণিক সেকশনে গনিতিক ধরনকে ও ক্যালকুলাসের উন্নয়ন ঘটিয়ে এর আধুনিকায়ন করেন। তিনি গবেষণা করেন ক্যালকুলাস নিয়ে। ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলাস হচ্ছে ক্যালকুলাসেরই একটি শাখা যা নিয়ে তিনি কাজ করেছিলেন।

আল খাওয়ারিজমি সর্বপ্রথম বীজগণিতের সমীকরণগুলোর জ্যামিতিক সমাধান নির্ণয় করেছিলেন। তিনি জ্যামিতির ক্ষেত্রে আয়ত, বর্গ, ত্রিভুজ প্রভৃতি জ্যামিতিক ক্ষেত্রগুলোর যে ধারণা দিয়েছেন তা হুবহু আজও একই রকম রয়েছে।

এ ছাড়া, জ্যোতির্বিদ্যায় আল খাওয়ারিজমি দিয়ে গেছেন নতুন কিছু ধারণা এবং এক্ষেত্রে তার অবদান উল্লেখযোগ্য। আল খাওয়ারিজমি জ্যোতির্বিজ্ঞানের একটি তালিকা প্রণয়ন করেন। তার এই তালিকাটির প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল, এতে তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানের উপক্রমণিকা যোগ করতেন। জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ে এ উপক্রমণিকাই তার প্রজ্ঞা ও পাণ্ডিত্যের স্বাক্ষর। এছাড়া, তার দুইটি গ্রন্থ রয়েছে এ বিষয়ে। প্রথম গ্রন্থে জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক যন্ত্রপাতির নির্মাণ কৌশল আলোচনা করা হয়েছে। আর দ্বিতীয় গ্রন্থে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে কিভাবে জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক পাঠ নিতে হয় সে বিষয়ে আলোচনা করেছেন। জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক বইগুলো অনুবাদ করা হয় ইউরোপীয় ভাষায়। পরে এগুলো চীনা ভাষাতেও অনুবাদ করা হয়। “সিদ্ধান্ত” হচ্ছে জ্যোতিশাস্ত্রের উপর রচিত ভারতীয়দের একটি বই যা তিনি আবরিতে অনুবাদ করেন।

আল খাওয়ারিজমি টলেমির অনেক ভৌগোলিক ধারণার সংশোধন করেন। তিনি টলেমির মানচিত্র পর্যন্ত সংশোধন করেন এবং একটি মানচিত্র সংযুক্ত করেন। ইউরোপীয়রা এতে বিস্ময় প্রকাশ করে। আল খাওয়ারিজমি টলেমির দ্রাঘিমা ও অক্ষরেখা গ্রহণ করেন এবং মুসলিম দেশগুলোর বিবরণ পেশ করেন।

আল খাওয়ারিজমির উদ্যোগে দুনিয়ার একটি বাস্তব রূপ তৈরি করা হয়েছিল যা পরবর্তীতে পৃথিবীর মানচিত্র অঙ্কনে ব্যবহার করা হয়। আল খাওয়ারিজমিই সর্বপ্রথম পৃথিবীকে সপ্ত মণ্ডলে বা সাত ভাগে ভাগ করেন। এই সূত্র ধরেই আবহাওয়া পরিমণ্ডল অনুসারে পৃথিবীকে সাতটি মহাদেশে ভাগ করা হয়।

আল খাওয়ারিজমি ৮৪৭ অথবা ৮৪০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে মৃত্যুবরণ করেন। বাগদাদের খলিফা মামুনের মৃত্যুর পরও তিনি এক যুগের বেশি জীবিত ছিলেন। বিজ্ঞানে মৌলিক অবদানের জন্য আল খাওয়ারিজমি চির স্মরণীয় হয়ে আছেন মানবসভ্যতার মাঝে।

আল খাওয়ারিজমি ইরানের জান্দিশাপুর শিক্ষা কেন্দ্রের গবেষণা কর্ম এবং ভারতীয় গণিতশাস্ত্রের দ্বারাও গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। খাওয়ারিজমি সম্পর্কে বিখ্যাত ঐতিহাসিক আল দুমিলি বলেছেন, 'খাওয়ারিজমি শুধু প্রাচ্য ও মুসলিম বিশ্বেই নয় একই সাথে পাশ্চাত্য বিশ্বেও বিখ্যাত হয়ে আছেন। গণিত শাস্ত্রে তিনি নয়া যুগের সূচনা করেছিলেন এবং তার গ্রন্থগুলো ছিল নজিরবিহীন'।

আরেক ঐতিহাসিক জুজম্যান আল খাওয়ারিজমিকে নজিরবিহীন গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিদ হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, দ্বিঘাত সমীকরণ ছিল তার অসামান্য সৃষ্টিকর্ম। 

যাইহোক, ধারণা করা হয় বৃহত্তর খোরাসান এলাকায় আল খাওয়ারিজমির জন্ম হয়েছিল। বর্তমানে ওই এলাকাটি উজবেকিস্তানে অবস্থিত। বৃহত্তর খোরাসান একসময় পারস্যেরই অংশ ছিল। আবার কোনো কোনো সূত্র মতে তিনি পারস্যের অন্তর্গত অন্য এলাকায় জন্মেছিলেন।

প্রকৃতপক্ষে, সে সময় পারস্য সাম্রাজ্যের বিশাল এলাকার ওপর ইসলামের প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিল। বাগদাদ ছিল মুসলিম বিশ্বের বাণিজ্য ও জ্ঞানগবেষণার কেন্দ্রভূমি। সে যুগে অনেক দূর-দূরান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা ও জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিরা বাগদাদে যেতেন যাদের মধ্যে আল খাওয়ারিজমিও ছিলেন অন্যতম। এক পর্যায়ে তিনি বাগদাদের খলিফা মামুনের গ্রন্থাগারের দায়িত্ব গ্রহণ করার সুযোগ পান। ওই সময়টি মুসলিম ইতিহাসের স্বর্ণালি যুগ হিসেবে পরিচিত ছিল। কেননা ইসলামের কল্যাণে জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বিরাট জাগরণ ঘটেছিল এবং এর প্রভাবে অনেক বড় বড় মুসলিম মনীষী ও বিজ্ঞানীর আবির্ভাব ঘটেছিল। খাওয়ারিজমি ছিলেন তাদের অন্যতম।

সবশেষে, মুসলিম সভ্যতায় গণিতশাস্ত্রে ব্যাপক উন্নতির কারণ সম্পর্কে কিছু কথা না বললেই নয়। প্রথমত, তৎকালীন মুসলিম শাসকরা জ্যোতির্বিদ্যা চর্চা এবং গ্রহ নক্ষত্রের গতিবিধি যাচাই করে ভবিষ্যদ্বাণী করায় বিশ্বাসী ছিলেন। এ ছাড়া, ধর্মের সঙ্গে যুক্ত নানা প্রকল্প বাস্তবায়ন, দফতর পরিচালনা করা, কর আদায়, পঞ্জিকা বা ক্যালেন্ডার ব্যবহার প্রভৃতি কাজে গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিদদেরকে রাজদরবারে ডেকে আনা হতো।

রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার কারণে এ সংক্রান্ত জ্ঞানচর্চার ব্যাপক উন্নয়ন ঘটে। এ যুগে গণিতের তাত্বিক ও ব্যবহারিক প্রয়োগ শুরু হয়। একইভাবে গবেষণা কাজে ব্যবহারের জন্য এমন সব যন্ত্রপাতি তৈরি হয় যা ছিল নজিরবিহীন। এসব যন্ত্রপাতি ও গবেষণা কেন্দ্র গ্রিস ও ভারতের গবেষণা কেন্দ্রের চাইতেও উন্নত ছিল। এমনকি এসব যন্ত্রপাতি ব্যবহারের নিয়ম কানুন সম্পর্কেও গ্রন্থ রচিত হয়।#

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/মো.আবুসাঈদ/০৮

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ