অক্টোবর ১২, ২০২২ ২১:০৬ Asia/Dhaka

শ্রোতা/পাঠকবন্ধুরা! স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিষয়ক সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান স্বাস্থ্যকথার আসরে আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি আমি গাজী আবদুর রশীদ। বাংলাদেশে এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুর প্রকোপ ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার ছাড়িয়েছে একইসাথে ডেঙ্গুতে সারা দেশে অর্ধ শতকের বেশি মানুষ মারা গেছে। পরিস্থিতি কিছুটা উদ্বেগজনক।

তো পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে আজ আমরা ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে কথা বলব। আর আমাদের সঙ্গে অতিথি হিসেবে আছেন, ঢাকার মহাখালীর ডিএনসিসি ডেডিকেটেড কোভিড-১৯ হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. কবীরুল হাসান বিন রকীব।

জনাব ডা. কবীরুল হাসান বিন রকীব, রেডিও তেহরানে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি।

ডা. কবীরুল হাসান বিন রকীব: ধন্যবাদ আপনাকেও।

রেডিও তেহরান: ডা, কবীরুল হাসান, এ মৌসুমে তো জ্বর জারি হয়। কিন্তু ডেঙ্গু জ্বর ‌আসলে কি?

ডা. কবীরুল হাসান বিন রকীব: ধন্যবাদ, ডেঙ্গু অন্য ভাইরাল জ্বরের মতোই একটি ভাইরাস জ্বর। এডি এডিস নামক এক প্রকারের মশার কামড়ে হয়ে থাকে-সেকথা আমরা এরইমধ্যে সবাই জানি। ডেঙ্গু জ্বরটি মূলত একটি শহুরে এলাকার জ্বর। ডেঙ্গুকে আমাদের চিন্তায় আনতে গেলে সবার আগে যে বিষয়গুলো ভাবতে হয়- সেটি হলো, স্থান-কাল এবং পাত্র।

স্থানের কথা যদি বলতে হয়, তাহলে সেটি হচ্ছে শহুরে এলাকা।

কালের কথা যদি বলি, তাহলে এখন যে ঋতুটি চলছে সেটি-অর্থাৎ বর্ষাকাল, শরৎকালও কিছুটা পাচ্ছে। অর্থাৎ যে সময়টাতে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়।

ডেঙ্গু জ্বর

আর পাত্র-বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিশুরা বিশেষ করে যাদের বয়স- এক থেকে বিশ বছরের মধ্যে। এই বয়সীরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। যদিও এর চেয়ে বেশি বয়সের অনেকে আক্রান্ত হতেও দেখা যায়। বর্ষা মৌসুমে কেউ জ্বর নিয়ে এলে আমরা চিকিৎসকরা সবার আগে ডেঙ্গুর কথাই চিন্তা করে থাকি।

রেডিও তেহরান: জ্বি জ্বর নিয়ে কোনো রোগী আপনাদের কাছে গেলে আপনারা পরীক্ষা করান। পরীক্ষা করানোর আগে কি লক্ষণ দেখে আপনারা বুঝতে পারেন?

ডা. কবীরুল হাসান বিন রকীব: দেখুন, বর্তমান পরিস্থিতিতে ঢাকা শহরে আমরা জ্বরের লক্ষণকে খুব বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি না। জ্বর বললেই আমাদের মাথায় চলে আসে ডেঙ্গু জ্বর। তবে এর লক্ষণগুলো এমন যে, জ্বর থাকবে, জ্বরের সাথে শরীর ব্যথা, মাথা ব্যথা, চোখে ব্যাথা এবং ব্যাক পেইন প্রায় প্রতিটি রোগীর ক্ষেত্রে দেখা যায়। তবে আগে যেমন বেশ ক্রিটিক্যাল কিছু লক্ষণ ছিল যেগুলো থাকলেই কেবল আমরা ডেঙ্গুর কথা চিন্তা করতাম। কিন্তু বর্তমানে ডেঙ্গু জ্বরের যে প্রেজেন্টেশান সেটি আর আগের মতো নয়। এখন ডেঙ্গু জ্বর অথচ একেক জনের ক্ষেত্রে একেক রকম সিমটম দেখা যায়। কেউ শুধু জ্বর, কারো অনেক বেশি জ্বর, কারও গা ম্যাজম্যাজ করে এভাবে বিভিন্ন জন বিভিন্নভাবে আসছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে অর্থাৎ সময়ের বিবেচনায় শহুরে এলাকায় জ্বর বিশেষ করে ঢাকা শহরে জ্বর এবং তার সাথে মাথাব্যথা নিয়ে কেউ আমাদের কাছে এলে সবার আগে আমরা ডেঙ্গুর কথা চিন্তা করে নেই।

রেডিও তেহরান: ডা.কবীরুল হাসান,ডেঙ্গু জ্বরে মৃত্যুর ঝুঁকি কতোটা, অর্থাৎ মারণব্যাধী হিসেবে বলা যায় কি না?

ডেঙ্গু জ্বরে শিশুদের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে নজর দিতে হবে

ডা. কবীরুল হাসান বিন রকীব: হ্যাঁ, ডেঙ্গু জ্বরের ক্ষেত্রে যদি আমরা সময় মতো চিকিৎসাজনিত উদ্যোগগুলো গ্রহণ না করি তাহলে এটি অবশ্যই মারণব্যাধী হতে পারে। যা এরইমধ্যে আমরা দেখেছি। প্রায় শতাধিক মানুষ এই ডেঙ্গু জ্বরে মারা গেছে।

রেডিও তেহরান:  জ্বি, আচ্ছা ডেঙ্গু জ্বর হলে চিকিৎসা করালে সাধারণ রোগী কতদিনে রোগী সুস্থ হতে পারে?

ডা. কবীরুল হাসান বিন রকীব: দেখুন, ডেঙ্গু জ্বর হলে সাধারণ রোগীরা দুই থেকে ৭ দিন পর্যন্ত জ্বর থাকে। তবে অনেক ক্ষেত্রে রোগীরা এরচেয়ে বেশিদিন পর্যন্ত ভুগতে পারেন। ডেঙ্গু পরবর্তী একটা দুর্বলতা থেকে যায় রোগীর দেহে। সেটি দুই তিন সপ্তাহ এমনকি মাসের চেয়েও বেশি থাকতে পারে।

রেডিও তেহরান: ডেঙ্গু জ্বর কি একই রোগীর কয়েকবার হতে পারে?

ডা. কবীরুল হাসান বিন রকীব: ডেঙ্গু একটি ভাইরাস জ্বর। এর চারটি সেরোটাইপ আছে। সাধারণত একটি সেরোটাইপ নিয়ে জ্বরটি হলে একবছরের মধ্যে অন্যকোনো সেরোটাইপ দিয়ে ডেঙ্গুটা সাধারণ হয় না। তবে একবছর পর অন্য যেকোনো সেরোটাইপ দিয়ে আবার তার ডেঙ্গু হতে পারে। সুতরাং একটা মানুষ একাধিকবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হতে পারে।

রেডিও তেহরান: আচ্ছা ডা. কবীরুল হাসান-ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে অনেক কিছু জানা হলো- এখন জানতে চাইব-ডেঙ্গুর জ্বরের প্রতিকারে করণীয় কী?

মশারি টাঙাতে হবে

ডা. কবীরুল হাসান বিন রকীব: দেখুন, ডেঙ্গু জ্বরের প্রতিকারে আমাদের সম্মিলিত প্রয়াস সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সেই সম্মিলিত প্রয়াস একেবারে ঘর থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পর্যন্ত। আমরা সাবই জানি যে ডেঙ্গু একটি মশাবাহিত রোগ। প্রথম কথা হলো যে, মশাকে নিধন করতে হবে এবং মশা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে হবে। নিজেকে সেফ রাখতে চাইলে- মশারি টাঙাতে হবে, মশার কয়েল ব্যবহার করতে হবে, ফুলহাতা শার্ট পরতে হবে। একইসাথে বাড়ির যেসব জায়গাগুলোতে ডেঙ্গু মশা বিডিং করে সেই জায়গাগুলোতে যাতে মশা বিডিং করতে না পারে সেজন্য পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। বাসায় নারকেলের মালায় স্বচ্ছ পানি জমে থাকতে দেয়া যাবে না। বাড়ির আশেপাশে যতরকমের ঝোপ ঝাড় আছে সেগুলোকে নিজেদের পরিস্কার পরিচ্ছ্ন্ন রাখতে হবে। একইসাথে সামাজিক আন্দোলন একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

রেডিও তেহরান: আচ্ছা আপনি সমন্বিত উদ্যোগের কথা বলছিলেন সেখানে সরকারের বিশেষ করে সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্বের কথা বলছিলেন। তো এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সরকারের উদ্যোগ কি যথেষ্ট বলে মনে করেন?

ডা. কবীরুল হাসান বিন রকীব: দেখুন, সেটি যথেষ্ট একেবারে বলা যাবে না। অবশ্যই সেখানে আরেকটু গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। সামাজিক আন্দোলনের বিষয়টিতে আসলে সেভাবে নজর দেয়া হচ্ছে না। এটা এমন একটা বিষয় যে সরকার চাইলেও এটি পারবে না। এখানে মিডিয়াকে প্রচণ্ডভাবে কাজে লাগাতে হবে। পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলনের জন্য প্রয়োজনে সরকারি উদ্যোগে স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে, স্কুল শিক্ষক, মসজিদের ইমাম-মোয়াজ্জেম তাঁদেরকে কাজে লাগাতে হবে। এরবাইরে সমাজের উচুঁশ্রেণির মানুষ-যাদেরকে সমাজে সবাই মেনে চলেন তাদেরকেও এগিয়ে আসতে হবে। আমি মনে করি, এখানে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ কুব বেশি কাজে দিবে না। সামাজিক আন্দোলনটা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর সামাজিক আন্দোলনকে গড়ে তুলতে গেলে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগটা প্রয়োজন হবে। মশা মারার যে ইকুইপমেন্টগুলো সেগুলোর ক্ষেত্রে সরকারকে আরও ভাবতে হবে এবং সেইভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। এক্ষেত্রে পাবিলিক হেলথ বিশেষজ্ঞ যাঁরা আছেন তাদের পরামর্শ যেমন নেওয়া দরকার একইসাথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাইরোলজি যে বিভাগ আছে সেখানে পর্যাপ্ত অর্থায়ন করতে হবে। তারা গবেষণা করে যদি ডেঙ্গু ভাইরাসের একটি ভ্যাকসিন আবিষ্কার করতে পারেন তাহলে সেটি কিন্তু খুব বড় একটা কাজ হবে।

রেডিও তেহরান: ডেঙ্গুর বর্তমান যে ভয়াবহ পরিস্থিতি- এ পরিস্থিতি কি আরও খারাপের দিকে যেতে পারে ?

ডা. কবীরুল হাসান বিন রকীব: দেখুন, ডেঙ্গুর বর্তমান পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে কি না সেকথা এই মুহূর্তে বলা মুশকিল। তবে আমরা সবসময় আশাবাদী থাকব যে আল্লাহপাক যেন  আমাদের দিকে সুদৃষ্টিতে তাকান।

জনাব ডা. কবীরুল হাসান বিন রকীব-ডেঙ্গু জ্বর, এডিস মশার বিস্তাররোধসহ এ সম্পর্কিত নানা দিক নিয়ে রেডিও তেহরানের সাথে কথা বলার জন্য আপনাকে আবারও ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

ডা.কীবরুল হাসান বিন রকীব: আপনাকেও ধন্যবাদ।

আর শ্রোতা/পাঠকবন্ধুরা! ডেঙ্গু জ্বর যাতে না হয় সেজন্য এডিস মশা যাতে জন্ম নিতে না পারে সেজন্য সবাইকে সচেতন হতে হবে। সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে এবং মশারি টানানো, হাতাওয়ালা পোশাক পরা, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখা, স্বচ্ছ পানি জমতে না দেয়ার বিষয়ে বিশেষ গুরুত্বের সাথে নিতে হবে। আর কোনো কারণে কেউ আক্রান্ত হন- দ্রুত চিকিৎসা নিতে হবে। তো হাতে আজ আর সময় নেই। সবাই ভালো ও সুস্থ থাকুন এ কামনা করে স্বাস্থ্যকথার আসর এখানেই গুটিয়ে নিচ্ছি।#

সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ, উপস্থাপনা এবং প্রযোজনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।

পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/১২

ট্যাগ