অক্টোবর ১৯, ২০২২ ১৫:৫৯ Asia/Dhaka

গত পর্বের আলোচনা অনুষ্ঠানে আমরা ইরানের খ্যাতনামা মনীষী আবু রেইহান বিরুনি নানা আবিষ্কার ও গবেষণাকর্ম সম্পর্কে আলোচনা করেছিলাম। আজকের অনুষ্ঠানেও আমরা এ বিষয়ে আলোচনা অব্যাহত রাখবো।

ঝর্ণা ও ফোয়ারার পানি কিভাবে উপরের দিকে ওঠে আল বিরুনি তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। এরই আলোকে কুয়া বা ঝর্ণার পানির প্রবাহকে কিভাবে পাহাড়ের চুড়ায় বা উঁচু মিনারে তোলা যায় সেই পদ্ধতি তিনি উল্লেখ করে গেছেন। বিরুনি পৃথিবীর আয়তক্ষেত্র পরিমাপ করেছিলেন। তিনি পৃথিবীর ব্যাসার্ধের পরিমাপ সম্পর্কিত নানা সমীকরণও উল্লেখ করে গেছেন তার নিজের লেখা 'উস্তুরলবাত' শীর্ষক বইয়ের শেষের দিকে। পশ্চিমা বিজ্ঞানীরা বিরুনির নামে এই সমীকরণগুলোর নামকরণ করেছেন।

আল বিরুনি পৃথিবীর দ্রাঘিমা রেখার পরিমাপ বের করেছিলেন। তার হিসেবে এর দৈর্ঘ্য ছিল ১১ হাজার ৬২ দশমিক চার কিলোমিটার। আধুনিক যুগের হিসেবে এই দৈর্ঘ্য ১১ হাজার ১১০ কিলোমিটার।  অর্থাৎ বিরুনির পরিমাপ করা দ্রাঘিমার হিসেবের সঙ্গে আধুনিক নিখুঁত হিসেবের খুব একটা পার্থক্য হয়নি। অথচ বিরুনি ছিলেন এক হাজার বছর আগের একজন গবেষক। এক্ষেত্রে বিরুনির আবিষ্কৃত বিশেষ পরিমাপ-পদ্ধতিকে পশ্চিমারা সপ্তদশ শতকের রাইট নামক ব্যক্তির আবিষ্কার বলে প্রচার করে আসছেন। অথচ মূল আবিষ্কারক হলেন আল বিরুনি।

বিরুনির সবচেয়ে সাড়া-জাগানো বইগুলোর মধ্যে ‘আসার আল বাকিয়া’ অন্যতম। এটি বহু বছর আগে ইউরোপে অনূদিত হয়েছে। বিশ্ব-ইতিহাস বিষয়ে এ বইটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বই হিসেবে বিবেচিত হয়। 'আসার আল বাকিয়া' নামক বইটিতে আল বিরুনি নানা জাতির বিশ্বাস, প্রথা ও সম্প্রদায় এবং তাদের মধ্যকার নানা মিল ও অমিল নিয়ে আলোচনা করেছেন। বিরুনি এই বইয়ের ষষ্ঠ অধ্যায়ে বনি ইসরাইল বংশে জন্ম-নেয়া রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী নবী-রাসুল এবং রাজা-বাদশাহদের ইতিহাস তুলে ধরেছেন। এ ছাড়াও তিনি অ্যাসিরিয়া, ব্যাবিলন, ইরান ও রোমের শাসকদের এবং মিশরের ফেরাউন শাসকদের ইতিহাসও তুলে ধরেছেন। ইরানের হাখামানেশিয়, পার্থিয়ান ও শাসানিয় রাজাদের ইতিহাসসহ পারস্যের অন্য রাজাদের ইতিহাসও স্থান পেয়েছে বিরুনির এ গ্রন্থে।

আল বিরুনির আরেকটি মূল্যবান গ্রন্থ হল ‘তাহকিক মালাল আল হিন্দ'। এ বইটি সমাজবিজ্ঞানে মুসলিম গবেষকদের বিস্ময়কর অগ্রগতির স্বাক্ষর বহন করছে। সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে তাদের এই দক্ষতা গড়ে উঠেছিল নানা দেশ সফরের সুবাদে। বিরুনি এই বইয়ে জ্যোতির্বিদ্যা ও গণিত বিষয়ে ভারতীয়দের মতামত এবং হিন্দুদের  নানা ধর্ম-বিশ্বাসের পাশাপাশি ভারতের ভৌগলিক ও ভূতাত্ত্বিক নানা বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন। অনেকেই মনে করেন যে পশ্চিমা পণ্ডিতরা মূলত এ বইয়ের মাধ্যমেই ভারত সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। বিরুনির এই বই ভারতীয়দের ধর্ম, প্রথা, ইতিহাস ও নানা জ্ঞান সম্পর্কে বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত বই হিসেবে বিবেচিত হয়। তাই বিরুনিকে তুলনামূলক নৃতত্বের অগ্রপথিকও বলা যায়। ভারত সম্পর্কে নৃতাত্ত্বিক গবেষণা চালাতে গিয়ে নানা বিপত্তির শিকার হতে হয়েছিল বিরুনিকে। কারণ, সে যুগের ভারতীয়রা মুসলমানদের সঙ্গে সখ্যতা রাখত না। আর ভারতীয়দের ভাষা শেখাও ছিল বেশ কঠিন। তা সত্ত্বেও বিরুনি সংস্কৃতি ভাষা শিখেছিলেন এবং তিনি এর মাধ্যমে ভারত সফরের সময় নানা অঞ্চলের ভারতীয়দের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করেন।

'তাহকিক মালাল আল হিন্দ' বইয়ে বিরুনি হিন্দুদের নানা প্রথা এবং আচার-অনুষ্ঠান সম্পর্কে নিরপেক্ষ মতামত দেয়ার চেষ্টা করেছেন। এ বইয়ে তিনি হিন্দু জাতিগুলোর চিন্তা ও বিশ্বাসের সঙ্গে অন্যান্য জাতির চিন্তা-বিশ্বাসের পার্থক্য তুলে ধরতে গিয়ে এ বিষয়ে চমৎকার তুলনামূলক গবেষণা আর বিশ্লেষণ উপহার দিয়েছেন।

আবু রেইহান আল বিরুনি ভাস্কর্য

আবু রেইহান আল বিরুনি বহুবার ভারতে গেছেন এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের ধর্ম, সাংস্কৃতিক, বিশ্বাস ও দর্শনের সাথে পরিচিত হন।

মজার বিষয় হচ্ছে ভারতের হিন্দু গবেষক ও চিন্তাবিদরা প্রথম দিকে আবু রেইহান বিরুনির ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করতেন এবং পারত পক্ষে তার সঙ্গে সাক্ষাতে মিলিত হতে চাইতেন না। কিন্তু এক পর্যায়ে বিরুনি ভারতীয় চিন্তাবিদদের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হন এবং তারা বিভিন্ন সময় একসাথে বৈঠক করতেন। এসব আলোচনায় তিনি ইরানের সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে ভারতীয়দের কাছে তুলে ধরতেন। একইসাথে তিনি ভারতীয়দের প্রাচীন কৃষ্টি কালচারের সাথেও পরিচিত হওয়ার সুযোগ পান।  এসব অভিজ্ঞতা ও তথ্য তিনি 'তাহকিক মালাল আল হিন্দ' বইয়ে লিপিবদ্ধ করেছিলেন।

আল বিরুনির আরেকটি বই হল 'কানুনে মাসুদি'। বইটির বিষয়বস্তু হল জ্যোতির্বিদ্যা, ভূগোল ও গণিত। এ বইয়ের রয়েছে ১১টি অধ্যায়। বইটি মুসলিম জ্যোতির্বিদদের সুস্পষ্ট অগ্রগতির সাক্ষ্য বহন করছে। এ বইয়ে  গ্রহ-নক্ষত্রের জটিল গতিবিধি তুলে ধরেছেন আল বিরুনি।  বিরুনি তার উদ্ভাবিত ত্রিকোণমিতির নানা সূত্রও তুলে ধরেছেন। এ বইয়ে আল বিরুনি ভৌগলিক আকার ও আকৃতিগুলোর মধ্যে সমন্বয় থাকার কথাও উল্লেখ করেছেন তার নানা অভিজ্ঞতা ও গবেষণার আলোকে।

বিরুনি জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত ও ভূগোল ছাড়াও ভূতত্ত্ব, পদার্থবিদ্যা এবং নৃতত্ত্বেও বিশেষজ্ঞ ছিলেন। ইউরোপীয় গবেষকদের মতে,  আল-বিরুনি ১৮০টি বই লিখেছিলেন। এর মধ্যে ১১৫ টি বই ছিল গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ের। এসবের মধ্যে কেবল ২৮ টি বই বর্তমান যুগে টিকে আছে।

মোটকথা, আল বিরুনি ছিলেন ইসলামের প্রাথমিক যুগের অন্যতম একজন খ্যাতিমান লেখকও। তার প্রতিটি গবেষণা কর্ম লক্ষ্য করলেও দেখা যাবে তিনি এসবের পেছনে জীবনের একটা বিরাট সময় ব্যয় করেছেন। এ কারণেই হয়তো তিনি তার সৃষ্টিকর্মকে নিজের সন্তানের মতো মনে করতেন। তিনি তার সৃষ্টিকর্মের প্রতি মানুষের আগ্রহকে তার সন্তানদের প্রতি  আগ্রহ বা ভালোবাসার সাথে তুলনা করতেন। আল বিরুনির একটি ভাস্কর্য ইরানের রাজধানী তেহরানের ললে পার্কে সংরক্ষিত আছে।

প্রকৃতপক্ষে, আবু রেইহান আল বিরুনির বিজ্ঞান মনষ্কতা, তার গবেষণাকর্ম, অভিজ্ঞতা সঞ্চয় প্রভৃতি তাকে এমন এক উচ্চস্তরে নিয়ে গিয়েছিল যে তিনি নিজেকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের খাদেম বা সেবক হিসেবে উল্লেখ করতেন। তিনি ছেলেবেলা থেকেই জ্ঞানগবেষণার কাজে নিয়োজিত থাকার সুযোগ পাওয়ায় নিজেকে  সৌভাগ্য মনে করতেন এবং এর জন্য কৃতজ্ঞ ছিলেন। #

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/১৯

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ