অক্টোবর ২৪, ২০২২ ১৭:৪৮ Asia/Dhaka

রংধনু আসরের কাছের ও দূরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা, কেমন আছো তোমরা? আশাকরি তোমরা সবাই ভালো ও সুস্থ থেকেই পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছো। আজকের আসরে তোমাদের স্বাগত জানাচ্ছি আমি গাজী আব্দুর রশীদ এবং সহকর্মী আকতার জাহান। অনুষ্ঠানটি গ্রন্থনা ও প্রযোজনা করেছেন আশরাফুর রহমান।

বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই স্বীকার করবে যে, শারীরিকভাবে সুস্থ থাকা কিংবা ভালোভাবে পড়াশোনা করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য আল্লাহর সাহায্য খুবই জরুরী। আর আল্লাহর সাহায্য লাভের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মাধ্যম হচ্ছে নামায। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনের সূরা মায়েদার ৫৫ আয়াতে বলা হয়েছে,  

‘তোমাদের প্রকৃত সাহায্যকারী বন্ধু হচ্ছেন কেবলমাত্র আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং ঈমানদার লোকেরা। ঈমানদার লোক তারাই যারা নামায কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ সামনে নম্রতা দেখায়।’

নামায কেবল আল্লাহ করুনা লাভের মাধ্যমই নয়, পাপ থেকে মুক্তির মাধ্যমও এটি। রাসূলুল্লাহ হযরত মুহাম্মদ (সা.) তারা সাহাবীদের উদ্দেশে বলেছেন, তোমাদের কারও বাড়ীর সামনে যদি একটি প্রবাহমান নদী থাকে এবং সে তাতে প্রতিদিন পাঁচবার গোসল করে তাহলে তার শরীরে কোন ময়লা থাকতে পারে কি? জবাবে সাহাবীগণ বললেন: না, তার শরীরে এক বিন্দু ময়লাও থাকতে পারে না। রাসূল বললেন, নামাজও একটি চলমান ঝরণাধারার মতো। যখনই কেউ নামাজ পড়তে দাঁড়ায় তখন তার দুই নামাজের মধ্যবর্তী সময়ের সকল গোনাহ মা করে দেওয়া হয় এবং ঐ নামাজের অসিলায় সে গোনাহগুলোকে তার আমলনামা থেকে মুছে ফেলা হয়।”

বন্ধুরা, আল্লাহর সাহায্য লাভ এবং পাপ থেকে মুক্তি পাবার জন্য তোমরা নিশ্চয়ই পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ো। তবে নামায পড়তে হবে আন্তরিকতা ও একাগ্রতার সাথে। কেননা হাদিসে বলা হয়েছে, ‘যে লোক সঠিকভাবে নামায আদায় করে না, কেয়ামতের দিন তার পরিণতি হবে হারুন, ফিরাউন, হামান ও উবাই ইবনে খালফের মতো।’ তাই নামায পড়তে হবে সহি-শুদ্ধভাবে। এ প্রসঙ্গে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা উল্লেখ করছি।

‘একদিন এক ব্যক্তি মসজিদে নববীতে প্রবেশ করল। রাসূল (সা.) তখন মসজিদেই বসে ছিলেন। লোকটি নামায পড়া শেষ করে নবীজির কাছে এসে সালাম জানালো। নবীজি সালামের জবাব দিয়ে বললেন: তুমি ফিরে যাও এবং নামায পড়ো কারণ তুমি নামায পড়োনি। লোকটি চলে গেল এবং আগের মতো নামায পড়ে রাসূলের কাছে এসে সালাম করল। সালামের জবাব দিয়ে নবীজি আবার বললেন: তুমি ফিরে যাও এবং নামায পড়ো কারণ তুমি নামায পড়োনি।

এভাবে তিনবার নামায পড়ার পরও রাসূল (সা.) তাকে পুনরায় নামায পড়তে বলায় লোকটি বলল: হে আল্লাহর রাসূল! আমি এর চেয়ে ভালোভাবে নামায পড়তে পারি না; আমাকে শিখিয়ে দিন। এবার রাসূলুল্লাহ বললেন: ‘প্রথমে নামাযে দাঁড়িয়ে তাকবীর বলো। এরপর যতটুকু সম্ভব কুরআন পাঠ করো। তারপর রুকু করো এবং রুকুতে গিয়ে স্থির হও। এরপর সোজা হয়ে দাঁড়াও। তারপর সিজদা দাও এবং সিজদায় গিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়াও। তারপর সোজা হয়ে বসো। এভাবে নামায শেষ কর।’

বন্ধুরা, সঠিক নিয়মে নামায পড়ার ওপর রাসূল (সা.) যে গুরুত্ব দিয়েছেন সে সম্পর্কে হাদিসটি শুনলে। এবার আমরা নামায সম্পর্কে কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা একটি গান শোনাব। গানটি গেয়েছে শিশুশিল্পী তাহজিব আজমী। (গান)

চমৎকার কথামালায় সাজানো গানটি শুনলে। বন্ধুরা, এবার আমরা নামাযে একাগ্রতা সম্পর্কে আমিরুল মোমেনীন হযরত আলী (আ.) এর একটি ঐতিহাসিক ঘটনা শোনাবো।  

‘একবার কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় শত্রু পক্ষের একটি তীর এসে আমিরুল মোমেনীন হযরত আলীর পায়ে বিদ্ধ হলো। ক্ষতস্থান দিয়ে দরদর করে রক্ত পড়া শুরু হলো। তীরটি ছিলো বিষাক্ত। তাই তিনি ব্যথায় চিৎকার করে উঠলেন। দূর থেকে সঙ্গী-সাথীরা  হযরত আলীর কাছে ছুটে এলেন। তারা পা থেকে তীরটি বের করার জন্য টান দিতেই তিনি যন্ত্রণায় শিউরে উঠলেন। সাহাবীরা পড়ে গেলেন মহা সমস্যায়। কারণ তীর বের করতে না পারলে রক্ত পড়া বন্ধ হবে না, ব্যথাও যাবে না। মহানবীও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি সবকিছু দেখছিলেন। তিনি বুঝলেন এভাবে আলীর পা থেকে তীর বের করা যাবে না। তাই তিনি কয়েকজন সাহাবীকে ডাকলেন। একটু দূরে গিয়ে তাদেরকে আস্তে আস্তে বললেন: তোমরা এক কাজ করো। আলী যখন নামাযে দাঁড়াবে তখন তোমরা তীরটি বের করে নেবে। রাসূলের পরামর্শ সবাই মেনে নিয়ে যার যার কাজে চলে গেল।

কিছুক্ষণ পর নামাযের সময় হলো। সবাই তৈরি হলো নামাযের জন্য। হযরত আলীও বসে নেই। মুযাজ্জিনের আযানের ধ্বনি শোনার সাথে সাথে তিনি নামাযের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। সকল ব্যথা ভুলে গিয়ে তিনি জামায়াতে গিয়ে হাজির হলেন। সবাই যখন নামাযে মশগুল তখন কয়েকজন সাহাবী ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন আলীর দিকে। বেশ শক্তভাবেই তীরটা বিঁধেছে আলীর পায়ে। আস্তে টান দিলেও চলবে না। তাই তীরের মাথা ধরে সাহাবীগণ সজোরে টান মারলেন। বেরিয়ে এলো তীর। কিন্তু ফিনকি দিয়ে বের হতে লাগলো তাজা রক্তের স্রোত। হযরত আলী তখনও নামায পড়ছেন। উহ্ আহ্ কোন শব্দই করলেন না তিনি। নামাযের মধ্যে এতো বড় ঘটনা ঘটল অথচ তিনি কিছুই টের পেলেন না!

নামাযের প্রতি হযরত আলীর একাগ্রতা দেখে সাহাবীগণ বিস্মিত হয়ে গেলেন। তারা মনে মনে ভাবলেন, এমন অদ্ভুত মানুষও কেউ হতে পারে? একটু আগেও যিনি তীরে হাত দিলেই ব্যথায় শিউরে উঠতেন। অথচ নামাযের সময় সেই একই ব্যক্তি ব্যথা-বেদনার কথা একদম ভুলে গেলেন-এটা কিভাবে সম্ভব? সাহাবীগণ এমনই অনেক কথা ভাবতে ভাবতে নামায শেষ হলো। নামায শেষে হযরত আলী তার পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখলেন যে পায়ে তীর নেই। ক্ষতস্থান দিয়ে দরদর করে রক্ত পড়ছে। তিনি একটু অবাক হলেন। পাশে দাঁড়ানো সাহাবীদের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলেন তিনি। সাহাবীরা জানালেন, নামাযের সময় তাঁর পা থেকে তীরটি বের করে নেয়া হয়েছে। হযরত আলী বুঝলেন সমস্ত ঘটনা। তাঁর মুখে স্মিত হাসির রেখা ফুটে উঠল।

বন্ধুরা, দেখলে তো নামাযের প্রতি হযরত আলীর আকর্ষণ কেমন ছিল? বিভিন্ন বর্ণনা থেকে জানা যায়, নামাযের সময় তিনি যেন একেবারে অন্য জগতের মানুষ হয়ে যেতেন। ভুলে যেতেন সকল দুঃখ-কষ্ট, জ্বালা-যন্ত্রণা আর দুনিয়াদারীর কথা। তোমরা হয়ত ভাবছো, হযরত আলীর মতো একনিষ্ঠভাবে নামায পড়া কি কারো পক্ষে সম্ভব? তোমাদের এ জিজ্ঞাসা যথার্থ  হলেও কয়েকটি পন্থা অবলম্বন করলে নামাযে একাগ্রতা আনা যেতে পারে।

নামায পড়ার সময় প্রতিটি সূরা এবং তাসবীহ তাহলীলের অর্থ কি তা মনে মনে চিন্তা করবে। নামাযে দাঁড়ানোর সময়  মনে করবে যে তুমি এমন এক সত্ত্বার সামনে দাঁড়িয়ে আছো যিনি তোমাকে দেখছেন। এছাড়া প্রতিটি নামাযের সময় চিন্তা করবে যে, এটাও তোমার শেষ নামায। আশা করা যায়, এভাবে নামায পড়লে নামাযের সময় তোমাদের মন এদিক ওদিক ছুটোছুটি করবে না। আর মহান আল্লাহও এতে খুশি হয়ে সবাইকে পুরস্কৃত করবেন।

বন্ধুরা, এবার আমরা পাঁচ ওয়াক্ত নামায কেন ফরজ হলো- সে সম্পর্কে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা শোনাব।

ইসলাম ধর্মকে দুর্বল হিসেবে তুলে ধরার জন্য ইহুদি পণ্ডিতরা একবার এক ফন্দি আঁটল। ফন্দি অনুযায়ী বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-কে জ্ঞানের দিক থেকে দুর্বল হিসেবে তুলে ধরার জন্য ইহুদি পণ্ডিতরা তাঁকে কিছু জটিল প্রশ্ন করার সিদ্ধান্ত নিল। আল্লাহর সর্বশেষ (সা.) রাসূল এইসব জটিল প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন না এবং এর ফলে তাঁর ও ইসলাম ধর্মের দুর্বলতা মানুষের কাছে তুলে ধরা সম্ভব হবে বলে ইহুদি পণ্ডিতরা ভেবেছিল। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে মসজিদে প্রকাশ্য জনসভায় বিশ্বনবী (সা.) ইহুদি পণ্ডিতদের জটিল সব প্রশ্নের জবাব দিতে লাগলেন এবং তারা সবাই উত্তর পেয়ে বিস্মিত হল। সবশেষে ইহুদি পণ্ডিতদের নেতা তার দৃষ্টিতে সবচেয়ে কঠিন প্রশ্নটি  করে রাসূলকে জব্দ করতে চাইলেন।

ওই পণ্ডিত বললেন, হে মুহাম্মাদ! বলুন তো দেখি আল্লাহ কেন দিন ও রাতে ৫ ওয়াক্ত নামাজ আপনার ওপর ফরজ করেছেন? কেন এর চেয়ে কম বা বেশী করা হল না?

এ প্রশ্ন শুনে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) মোটেই ঘাবড়ালেন না বরং তিনি তার নির্দ্বিধায় বললেন, যোহরের নামাজের সময় আল্লাহর আরশের নীচে অবস্থিত সব কিছু আল্লাহর প্রশংসা করে ও তাঁর গুণ-গানে মশগুল হয়। আর এ জন্যই আল্লাহ এ সময় অর্থাৎ মধ্যাহ্নের পর আমার ও আমার উম্মতের জন্য নামাজ ফরজ করেছেন   এবং এ জন্যই মহান আল্লাহ বলেছেন, সূর্য মধ্য আকাশ থেকে পশ্চিমে হেলে পড়ার পর থেকে অন্ধকার নেমে আসার সময় পর্যন্ত নামাজ আদায় কর।

আল্লাহর রাসূল (সা.) আসরের নামাজ ফরজ বা বাধ্যতামূলক হবার কারণ সম্পর্কে বললেন, আসরের সময় হল সেই সময় যখন হযরত আদম (আ.) তার জন্য নিষিদ্ধ ঘোষিত গাছের ফল খেয়েছিলেন। ফলে আল্লাহ তাঁকে বেহেশত থেকে বহিষ্কার করেন। আল্লাহ আদমের সন্তানদেরকে আসরের নামাজ পড়তে বলেছেন এবং আমার উম্মতের জন্যও তা ফরজ করা হয়েছে। এই নামাজ মহান আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় নামাজগুলোর মধ্যে অন্যতম।

এরপর আল্লাহর রাসূল (সা.) মাগরিবের নামাজ ফরজ বা বাধ্যতামূলক হবার কারণ সম্পর্কে বললেন, মহান আল্লাহ অনেক বছর পর হযরত আদম (আ.)'র তওবা কবুল করেন এবং তিনি তখন তিন রাকাত নামাজ আদায় করেন। আল্লাহ আমার উম্মতের জন্যও মাগরিবের নামাজ বাধ্যতামূলক করেছেন, কারণ এ সময় দোয়া কবুল হয়। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, তোমরা রাত নেমে আসার সময় ও সকালে আল্লাহর প্রশংসা কর।

আল্লাহর রাসূল (সা.) এশা'র নামাজ ফরজ হবার কারণ সম্পর্কে বললেন, কবরে ও কিয়ামতের দিনের ভয়াবহ অন্ধকারগুলো এশা'র নামাজের আলোয় কেটে গিয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। আল্লাহ বলেছেন, এশা'র নামাজ আদায়ের জন্য অগ্রসর হওয়া এমন কোনো ব্যক্তি নেই যাকে আল্লাহ দোযখ বা জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করবেন না। আর ফজরের নামাজের দর্শন হল, সূর্য-পূজারীরা সূর্য উদয়ের সময়ে এবাদত করতো। তাই আল্লাহ কাফেরদের সিজদার আগেই ইবাদতে মশগুল হতে মুমিনদেরকে ফজরের নামাজ আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন।

৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায়ের রহস্য বা দর্শন সম্পর্কে বিশ্বনবী (সা.)'র কাছ থেকে বক্তব্য শোনার পর ইহুদি পণ্ডিতরা লা-জওয়াব হয়ে গেলেন। কারণ, তাদের আর বলার কিছুই ছিল না। ফলে তারা অবনত মস্তকে মসজিদ ত্যাগ করল।

বন্ধুরা, তোমরা যত ব্যস্তই থাকো না কেন- নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ার চেষ্টা করবে এ আহ্বান রেখে আজকের আসর থেকে বিদায় নিচ্ছি।#

 পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/২৪

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।