অক্টোবর ২৫, ২০২২ ১৬:৫৫ Asia/Dhaka
  • ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস (১৩১): পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে মানসিক উদ্দীপনা ও সাহস

ইরাকের সাদ্দাম বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইরানের সেনা শিবিরগুলোতে সব সময় আধ্যাত্মিক পরিবেশ বিরাজ করত।  এই পরিবেশ থেকে আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার যে সংস্কৃতি তৈরি হয়েছিল তা বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য স্বাধীনতাকামী আন্দোলনকারী দেশগুলোর আদর্শে পরিণত হয়েছে।

বিশেষ করে লেবানন, ফিলিস্তিন, সিরিয়া, ইরাক ও ইয়েমেনের মুসলিম জনগোষ্ঠী ইরানে তৈরি প্রতিরোধ সংগ্রামের আদর্শ অনুসরণ করে আগ্রাসী শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। ইরাকের বিরুদ্ধে ইরানের পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে যে আধ্যাত্মিক পরিবেশ তৈরি হয়েছিল তার মূলে ছিল মহান আল্লাহর প্রতি ইরানি জনগণের গভীর ঈমান ও বিশ্বাস। ইরানি যোদ্ধারা সব সময় মনে করতেন, আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে দেখছেন।

তারা ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ও পীরে কামেল ইমাম খোমেনী (রহ.)-এর এই উপদেশ মেনে চলতেন যে, “আপনারা যখন কোনো কিছু লিখতে যাবেন তখন যেন একথা মনে থাকে যে, আল্লাহর চোখের সামনে আপনি লিখছেন। যখন আপনারা কথা বলবেন তখন একথা মনে রাখবেন যে, আপনাদের জিহ্বা, আপনাদের অন্তর, আপনাদের চোখ এবং আপনাদের কান আল্লাহর দৃষ্টির বাইরে নয়। প্রকৃতপক্ষে গোটা পৃথিবী রয়েছে আল্লাহর নখদর্পণে।  কাজেই আল্লাহর চোখের সামনে গোনাহ করবেন না। পার্থিব সামান্য বিষয় নিয়ে আল্লাহর সামনে ঝগড়া-বিবাদ ও মারামারি করবেন না। শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য কাজ করুন এবং তার জন্য সামনে অগ্রসর হন। যদি ইরানি জাতি আল্লাহর জন্য এবং মহানবী (সা.)-এর সন্তুষ্টির জন্য সামনে অগ্রসর হয় তাহলে তাদের সকল লক্ষ্য অর্জিত হবে।”

পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে বলা হয়েছে, মানুষ সার্বক্ষণিকভাবে আল্লাহ তায়ালার দৃষ্টির সামনে থাকে। সূরা আলাকে বলা হয়েছে, তবে কি সে অবগত নয় যে, আল্লাহ তার সবকিছু দেখছেন? এছাড়া, সূরা আনফালের ২৪ নম্বর আয়াতের একাংশেও আল্লাহ বলেছেন, “নিশ্চয় আল্লাহ মানুষ ও তার হৃদয়ের মাঝে অন্তরায় হন” অর্থাৎ তিনি মানুষের অন্তরের সব গোপন খবর রাখেন।  তিনি মানুষের মনের গোপন কথাও জানেন, তার কাছে কোন জিনিসই লুক্কায়িত নয়। আল্লাহ যখন চান খন মানুষ ও তার অন্তরের মাঝে অন্তরায় হয়ে যান। এমনকি মানুষ তার ইচ্ছা ছাড়া কিছুই পেতে পারে না।

রুহ বা আত্মা ও শরীর এই দুইয়ের সমন্বয়ে মানুষ গঠিত। মহান আল্লাহ মাটি দিয়ে মানবদেহ তৈরি করে তার মধ্যে রুহ ফুঁকে দিয়ে আদি মানব হযরত আদম (আ.)কে সৃষ্টি করেন। সেইসঙ্গে তিনি বুদ্ধি ও জ্ঞানের দিক দিয়ে মানুষকে অন্য সকল বস্তু ও প্রাণীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ হিসেবে তৈরি করেছেন।  ইসলামি বিশ্ব দর্শন অনুযায়ী, রুহ বা আত্মাই মানুষের আসল পরিচয় এবং যে শরীরে আমরা এই রুহ ধারণ করেছি সেটি একটি জড় অবকাঠামো ছাড়া আর কিছু নয় যা মৃত্যুর মাধ্যমে একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে। মানুষের যত শক্তি ও ক্ষমতা তার উৎসও সেই রুহ বা আত্মা। যুদ্ধের সময় সেই আত্মা থেকে উৎসারিত মানসিক শক্তি বা কর্ম উদ্দীপনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

যেকোনো যুদ্ধে সৈনিকদের মানসিক উদ্দীপনা নিয়ে অনেক কথা বলা হয়েছে। বলা হয়, যুদ্ধের ভাগ্য সৈনিকের সংখ্যা ও তাদের সমরাস্ত্র শক্তির ওপর নির্ভর করে না বরং সৈনিকদের সাহস ও উদ্দীপনা এখানে মূল ভূমিকা পালন করেন। যে সেনাবাহিনী প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস ও সাহস নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে অবতীর্ণ হয় প্রতিপক্ষ তাকে সমীহ করে চলতে বাধ্য। আট বছরের পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে সমরাস্ত্রের দিক দিয়ে ইরান ইরাকের চেয়ে অনেক বেশি পিছিয়ে ছিল। কিন্তু আত্মিক ও মানসিক শক্তির দিক দিয়ে ইরাকের আগ্রাসী বাহিনী ছিল ইরানি যোদ্ধাদের চেয়ে যোজন যোজন পিছিয়ে। একথা বলার অর্থ এই নয় যে, ইরাকি সেনাদের মানসিক শক্তি অর্জনের মতো কোনো বিষয় ছিল না কিংবা ইরানি যোদ্ধাদের কাছে কোনো অস্ত্রসস্ত্র ছিল না। একথা বলার অর্থ এই যে, সমরাস্ত্রের দিক দিয়ে ইরাকিদের পাল্লা ভারী ছিল এবং মানসিক উদ্দীপনা ও সাহসের দিক দিয়ে ইরানি যোদ্ধাদের পাল্লা ছিল ভারী।

সমরাস্ত্র ও গোলাবারুদের দিক দিয়ে ইরাক ইরানের চেয়ে কতখানি এগিয়ে ছিল তা উপলব্ধি করার জন্য ইরাকি বাহিনীর সমরাস্ত্র সম্পর্কে মোটা দাগে কিছু তথ্য জানা প্রয়োজন। ইরাকি বাহিনী ইরানে আগ্রাসন চালানোর বেশ কয়েক মাস আগে থেকে নিজের প্রস্তুতি শুরু করে। ১৯৭৯ সালে ইরাকের সামরিক বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল ৫ লাখ ৫৫ হাজার। ১৯৭৯ ও ১৯৮০ সালে ইরাকের সেনা ডিভিশন ছিল ১২টি। এর মধ্যে পাঁচটি পদাতিক, পাঁচটি সাঁজোয়া এবং দু’টি ছিল যান্ত্রিক ডিভিশন। এই বিশাল সেনাবাহিনীর ছিল ৮০০টি কামান, পাঁচ হাজার ৪০০ ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান, ৪০০টি বিমান বিধ্বংসী কামান, ৩৬৬টি যুদ্ধবিমান এবং ৪০০টি হেলিকপ্টার। ঠিক একই সময়ে ইরানের সেনাবাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল এক লাখ ৫০ হাজার, বিমান বাহিনীর ৬০ হাজার, নৌবাহিনীর ২০ হাজার এবং আধাসামরিক বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল মাত্র ২৫ হাজার।

১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের আগে ইরানের সেনাবাহিনী মার্কিন অস্ত্রসস্ত্রে সুসজ্জিত থাকলেও এসব অস্ত্রের সবগুলো চালনায় এদেশের সেনাবাহিনীর দক্ষতা ছিল না। কাজেই ইরানের কাছে যেসব অস্ত্রসস্ত্র ছিল দক্ষতার অভাবে সেগুলোর সবকিছু ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্যবহার করা যায়নি। এ সময় ইরাকিরা যেসব সমরাস্ত্র ও গোলাবারুদ ব্যবহার করেছে তার শতকরা ৫০ ভাগও ব্যবহারের অবস্থা ইরানি যোদ্ধাদের ছিল না। অন্যদিকে ইরানে সে সময় সদ্যগঠিত ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি’র না ছিল অস্ত্রসস্ত্র না ছিল দক্ষ সেনাদল।  ইরাক-ইরান যুদ্ধ শুরুর সময় আইআরজিসি’র সদস্য সংখ্যা ছিল মাত্র ৩০ হাজার। তাদেরকে কোনোভাবেই ইরাকি বাহিনীর সঙ্গে তুলনা করা যায় না।#

ট্যাগ