নভেম্বর ০১, ২০২২ ১৪:৩৩ Asia/Dhaka
  • ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস (১৩৩):  যুদ্ধের ব্যাপারে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের দ্বৈত আচরণ

ইরাকের সাদ্দাম সরকারের প্রতি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দুই পরাশক্তির পৃষ্ঠপোষকতা ছিল পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধের একটি বড় বৈশিষ্ট্য। ১৯৭৯ সালে ইরানে অনুষ্ঠিত ইসলামি বিপ্লব ওই দুই পরাশক্তির সামনে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিল। পাশাপাশি বিশ্বের স্বাধীনতাকামী আন্দোলনকারীরা এই বিপ্লব থেকে পেয়েছিল অনুপ্রেরণা। সাদ্দামের নেতৃত্বাধীন ইরাকের বামপন্থি বাথ সরকার ছিল প্রাচ্যের পরাশক্তি অর্থাৎ সোভিয়েত ইউনিয়নের পরিপূর্ণ অনুগত।

সোভিয়েত ইউনিয়নের স্নেহভাজন হিসেবে আমেরিকার শত্রু  দেশগুলোর তালিকায় ইরাক সরকারের নাম থাকার কথা ছিল। কিন্তু ইসলামি বিপ্লবের মাধ্যমে ইরান থেকে আমেরিকা চিরতরে হাত গুটিয়ে নিতে বাধ্য হওয়ায় এদেশের ইসলামি শাসনব্যবস্থাকে ধ্বংস করার লক্ষ্য নির্ধারণ করে ওয়াশিংটন। সে কারণে শত্রুর মদদপুষ্ট ইরাক সরকারকে এই যুদ্ধে পরিপূর্ণ পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় আমেরিকা।  অবশ্য যুদ্ধের শুরুর দিকে আমেরিকার মতো সোভিয়েত ইউনিয়নও নিজেকে নিরপেক্ষ ঘোষণা করে এবং ইরাককে অস্ত্র সহায়তা দেয়া বন্ধ রাখে। তবে মস্কো ইরাকের বিরাগভাজন হওয়া থেকে বিরত থাকার জন্য পূর্ব ইউরোপে নিজের মিত্র দেশগুলোকে নির্দেশ দেয় তারা যেন বাগদাদকে প্রয়োজনীয় সমরাস্ত্রের যোগান দিয়ে যায়।

সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকনির্দেশনা পেয়ে বুলগেরিয়া, তৎকালীন চেকোস্লোভাকিয়া ও পোল্যান্ড ইরাক সরকারকে প্রয়োজনীয় সমরাস্ত্র সরবরাহ করার দায়িত্ব গ্রহণ করে। এদিকে ইরান সরকার দেশটির ওপর ইরাকি আগ্রাসনের নিন্দা জানাতে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি আহ্বান জানায়। কিন্তু মস্কো সে আহ্বানে সাড়া দিতে অপারগতা প্রকাশ করে। কিন্তু ইরান যখন যুদ্ধের দ্বিতীয় বছরে ঘুড়ে দাঁড়ায় এবং ইরাকের অভ্যন্তরে অভিযান চালাতে শুরু করে তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন তার কথিত নিরপেক্ষ নীতির অবসান ঘটিয়ে ইরানি হামলার নিন্দা জানায়। একইসঙ্গে ইরাককে সম্ভাব্য পরাজয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে বাগদাদের প্রতি অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য দিতে শুরু করে।

Image Caption

সোভিয়েত সরকার প্রথমেই বাগদাদের হাতে ১৫০ কোটি ডলারের নগদ অর্থসাহায্য তুলে দেয়। এরপর ইরাকের কাছে মিগ-২৩ ও মিগ-২৫ যুদ্ধবিমান, টি-৭২ ট্যাংক এবং ভূমি থেকে ভূমিতে ও ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র পাঠায় মস্কো। একইসঙ্গে দুই হাজার সামরিক উপদেষ্টা পাঠিয়ে ইরাকের যুদ্ধ করার ক্ষমতা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয় সোভিয়েত সরকার। ইরানের তৎকালীন বিপ্লবী সরকার এদেশের সোভিয়েতপন্থি ‘তুদে’ পার্টির বিরুদ্ধে ব্যাপক ধরপাকড় অভিযান শুরু করলে মস্কো তেহরানের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়। এই ক্ষোভ থেকে বাগদাদের প্রতি সাহায্যের পরিমান আরো বাড়িয়ে দেয় মস্কো। সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৮৪ সালে ইরাককে ২০০ কোটি ডলার ঋণ দেয়ার জন্য বাগদাদের সঙ্গে একটি দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি সই করে। সেইসঙ্গে মস্কো বাগদাদের কাছ থেকে তেল কেনার পরিমান বাড়িয়ে দেয় এবং তেলের মূল্যের বিনিময়ে ইরাককে সমরাস্ত্র সরবরাহ করতে থাকে।

সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৮৬ সালের গোড়ার দিক থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত ইরাককে ৩৯০ কোটি ডলারের অস্ত্র সরবরাহ করে। এসব অস্ত্রের মধ্যে ছিল ৮০০টি অত্যাধিুনিক টি-৭২ ট্যাংকসহ মোট দুই হাজার ট্যাংক, মিগ-২৩, মিগ-২৫, মিগ-২৭ বিমানসহ ৩৩০টি যুদ্ধবিমান এবং ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপযোগ্য ৩০০টি ক্ষেপণাস্ত্র। ইরান ১৯৮৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইরাকের অভ্যন্তরে কারবালা-৫ অভিযান চালানোর পর ইরাকের পরাজয়ের পুনরাবৃত্তি রোধ করতে সোভিয়েত ইউনিয়ন জাতিসংঘে স্পষ্ট ঘোষণা দেয়, দেশটি ইরাককে অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রে সুসজ্জিত করবে।  এ লক্ষ্যে মস্কো বাগদাদের হাতে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের পাশাপাশি মিগ-২৯ ও মিগ-৩১ এর মতো আরো আধুনিক যুদ্ধবিমান তুলে দেয়। এসব সমরাস্ত্র পেয়ে ইরাকি বাহিনী ইরানের শহরগুলোর আবাসিক এলাকাগুলোতে ব্যাপক হারে হামলা চালাতে শুরু করে।

এদিকে, পারস্য উপসাগরে আমেরিকা ইরানের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে সোভিয়েত ইউনিয়ন শুধু এর মৌখিক বিরোধিতা করে। এর বাইরে, মস্কো ইরানের বিরুদ্ধে মার্কিন নীতিকে অন্ধভাবে সমর্থন দেয় এবং ইরাকের সাদ্দাম সরকারের প্রতি পূর্ণ পৃষ্ঠপোষকতা অব্যাহত রাখে। অন্যদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব বলয়ে বিভক্ত থাকা আরব দেশগুলো একটি জায়গায় ঐক্যবদ্ধ ছিল। আর তা হলো ইরাক-ইরান যুদ্ধে ইরাককে সার্বিক সহযোগিতা করা। এসব আরব দেশ বাগদাদকে শুধু আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে থেমে থাকেনি সেইসঙ্গে তারা ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে ইরাকে হাজার হাজার সেনা পাঠায়। ইরাকের তৎকালীন উপ প্রধানমন্ত্রী তাহা ইয়াসি রমাজান পরবর্তীতে স্বীকার করেন, মিশর, জর্দান, ইয়েমেন, মরক্কো, তিউনিশিয়া ও সুদান থেকে ১৪ হাজার সেনা ইরাকি বাহিনীর পক্ষে যুদ্ধ করতে এসেছিল। তবে প্রকৃত আরব সেনাদের সংখ্যা ছিল এর চেয়েও বেশি।

ইরাক-ইরান যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ইরাকি শাসক সাদ্দাম কুয়েত দখল করে নিলে এতদিন যেসব আরব দেশ ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বাগদাদকে সহযোগিতা করে এসেছিল তারা পড়ে যায় কিংকর্ত্যবিমূঢ় অবস্থায়। কারণ, তারা অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র দিয়ে যে সেনাবহিনীকে হৃষ্টপুষ্ট করেছে সেই বাহিনী এখন তাদের দিকেই বন্দুকর নল তাক করেছে। এ সময় আরব দেশগুলো স্বীকার করে যে, তারা ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইরাকি বাহিনীকে কি পরিমান সহযোগিতা করেছে। এদিকে বিনা উসকানিতে ইরানের উপর ইরাকি আগ্রাসনের নিন্দা জানাতে ব্যর্থ হয় জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ। এই পরিষদ জাতিসংঘ ঘোষণার ৪১ ও ৪২ নম্বর ধারা উপেক্ষা করে ইরানের ওপর ইরাকি আগ্রাসনকে বৈধতা দেয়। ইরাকি বাহিনী  ইরানে আগ্রাসন চালিয়ে এদেশের বিস্তীর্ণ ভূমি দখল করে নিলেও জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ আলোচনার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান করার আহ্বান জানায়।

জাতিংঘ নিরাপত্তা পরিষদ যুদ্ধের ময়দানে সৃষ্ট পরিস্থিতির কারণে এতদিন পর আলোচনার দাবি তোলে। যতদিন ইরাকি সেনারা ইরানের অভ্যন্তরে মোতায়েন ছিল ততদিন নিরাপত্তা পরিষদ কোনো প্রস্তাব গ্রহণের কথা চিন্তা করেনি। কিন্তু যখন ইরানি যোদ্ধারা অভিযান চালাতে গিয়ে ইরাকের ভেতরে প্রবেশ করে তখনই নিরাপত্তা পরিষদের টনক নড়ে।  ওই পরিষদ যুদ্ধের আকার বৃদ্ধিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে। প্রকৃতপক্ষে তাদের উদ্বেগ যুদ্ধের বিস্তারের জন্য ছিল না বরং ইরাক পরাজিত হতে পারে ভেবে নিরাপত্তা পরিষদ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল। মজার ব্যাপারে হচ্ছে নিরাপত্তা পরিষদ ১৯৮০ সালে ইরানে ইরাকি আগ্রাসনের নিন্দা জানাতে ব্যর্থ হলেও ১৯৯০ সালে ইরাকের কুয়েত দখলের প্রথম দিনই বাগদাদের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং পরবর্তী চার মাসে ইরাকি সেনারা ঘরে ফিরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত ওই পরিষদে ১২টি নিন্দা প্রস্তাব পাস করা হয়।#

পার্সটুডে/এমএমআই/1

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

 

ট্যাগ