নভেম্বর ০১, ২০২২ ১৪:৪৯ Asia/Dhaka
  • ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস (১৩৪): ইরাক সরকারের প্রতি পশ্চিমা দেশগুলোর নিষিদ্ধ রাসায়নিক অস্ত্র সরবরাহ

ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তৎকালীন দুই পরাশক্তি আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের পর ইরাকের সাদ্দাম সরকারকে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছে ইউরোপীয় দেশগুলো। দুই পরাশক্তির মতো তাদের ইউরোপীয় মিত্ররাও ইরাক-ইরান যুদ্ধের শুরুতে অর্থপূর্ণ নীরবতা অবলম্বন করে। ইরাককে হামলা থেকে বিরত রাখা তো দূরের কথা এমনকি তারা ইরানের ওপর ইরাকি বাহিনীর আগ্রাসনের নিন্দা পর্যন্ত জানায়নি।

আগ্রাসনের নিন্দা পর্যন্ত জানায়নি। অথচ যুদ্ধে ইরান যখন ঘুরে দাঁড়ায় এবং আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীকে পাল্টা মার দিতে শুরু করে তখন এসব পশ্চিমা দেশ নিজেদের নীরবতা ও কথিত নিরপেক্ষ অবস্থানের অবসান ঘটায়। তারা বাগদাদকে অর্থ ও অস্ত্র সহযোগিতা দিতে শুরু করে। যুদ্ধ শুরুর চার মাসের মাথায় ফ্রান্স ইরাকের কাছে ৬০টি মিরেজ এফ-ওয়ান যুদ্ধবিমান পাঠায়।

ইরানের ওপর সাদ্দামের আগ্রাসন শুরু হওয়ার আগে ১৯৭৭ ও ১৯৭৮ সালে ফ্রান্স ইরাকের কাছে ২০০ কোটি ডলার মূল্যের সমরাস্ত্র বিক্রি করেছিল। এরপর প্যারিস ১৯৮২ সালে বাগদাদের কাছে ৪০০ কোটি ফ্রাঙ্ক মূল্যের সমরাস্ত্র রপ্তানি করে এবং এর ফলে ইরাকের কাছে অস্ত্র বিক্রির দিক দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের পর দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে আসে প্যারিস।  ফ্রান্স এরপর ১৯৮৩ সালে ইরাকের হাতে ৫৬০ কোটি ডলারের সুপার স্ট্যান্ডার্ড যুদ্ধবিমান ও লেজার ক্ষেপণাস্ত্র তুলে দেয়। সুপার স্ট্যান্ডার্ড যুদ্ধবিমান ও লেজার ক্ষেপণাস্ত্র ছিল তখন পর্যন্ত ফ্রান্সের সমরাস্ত্র শিল্পের সর্বশেষ আবিষ্কার। এসব যুদ্ধবিমান ইরানি তেল ট্যাংকারে হামলার কাজে ব্যবহার করার জন্য পারস্য উপসাগরে মোতায়েন করা হয়। এসব যুদ্ধবিমান সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ছিল বলে ইরানি যুদ্ধবিমানের পক্ষে ইরাকি জঙ্গিবিমানগুলোর পশ্চাদ্ধাবন করা সম্ভব ছিল না।

ন্স সরকার ইরাকের সাদ্দাম সরকারকে শুধু সমরাস্ত্র দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি সেইসঙ্গে ১৯৮৫ ও ১৯৮৬ সালে প্যারিস বাগদাদের হাতে ৫০০ কোটি ডলারের ঋণ সহায়তা দান করে। অথচ ওই একই সময় ফ্রান্স তেল কেনা বাবদ ইরানের পাওনা ১০০ কোটি ডলার তেহরানকে দিতে অপারগতা প্রকাশ করে।

ফ্রান্সের পাশাপাশি ব্রিটিশ সরকারও ১৯৮১ ও ১৯৮২ সালে কয়েকটি বড় ধরনের চুক্তির আওতায় ইরাকের কাছে অত্যাধুনিক সব সমরাস্ত্র হস্তান্তর করে। লন্ডন ১৯৮২ সালে বাগদাদের কাছে ১০০ কোটি ডলার মূল্যের ট্যাংক বিক্রি করে এবং আরো ২০০ কোটি ডলার মূল্যের ইরাকের কাছে ৩০০টি যুদ্ধবিমান বিক্রির চুক্তি সই করে।  একই বছর তৎকালীন পশ্চিম জার্মানি ইরাকের কাছে ৪০০ কোটি মার্ক মূল্যের ‘রোনাল্ড’ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বিক্রির চুক্তি করে। অথচ একই সময়ে বিপ্লবের আগে ইরানের কাছে বিক্রি করা তিনটি যুদ্ধজাহাজ সরবরাহ করতে অস্বীকৃতি জানায় পশ্চিম জার্মানি।

ফ্রান্স, ব্রিটেন ও পশ্চিম জার্মানির পাশাপাশি ইরানের ওপর আগ্রাসনের কাজে ইরাককে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে ইতালি ও বেলজিয়াম। এই দু’টি দেশের একটি ইরাকের কাছে সাঁজোয়া যান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র পাঠায় এবং অপর দেশ ইরাককে দূরপাল্লার কামান তৈরিতে সহযোগিতা করে। ইরানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ও বর্তমান সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী তার দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইউরোপীয় দেশগুলোর অবস্থান সম্পর্কে এক ভাষণে বলেন: মানবাধিকারের কথিত রক্ষক এবং দৃশ্যত ভদ্র-সভ্য ইউরোপীয়রা তাদের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ইরাককে সাহায্য করেছে অথচ ইরানের কাছে সামান্য ছোটখাট জিনিস বিক্রি করতেও তারা রাজি হয়নি। ইরানের পক্ষ থেকে অনেক দেনদরবার করে যদিও বা ইউরোপীয়দের কাছ থেকে কিছু কেনা সম্ভব হয়েছে তবে সেজন্য বাজারমূল্যের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি দাম তারা আদায় করে নিয়েছে।

ইউরোপীয় দেশগুলো ইরাককে যে শুধুমাত্র প্রচলিত যুদ্ধাস্ত্র সরবরাহ করেছে তাই নয় বরং তারা বাগদাদের কাছে নানা ধরনের নিষিদ্ধ মারণাস্ত্রও তুলে দিয়েছে। ইরাককে যখন সব ধরনের অস্ত্রসস্ত্র দিয়েও ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জেতানো সম্ভব হচ্ছিল না তখন পশ্চিম জার্মানি বাগদাদকে নিষিদ্ধ রাসায়নিক অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করে। জার্মানির কাছ থেকে রাসায়নিক উপাদান ও প্রযুক্তির চালান পেয়ে ইরাকের সাদ্দাম সরকার ইরানের বিরুদ্ধে ছয় হাজার টন রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করে। ইরাক সরকার ইরানের সারদাশত শহরে রাসায়নিক অস্ত্র নিক্ষেপ করে অন্তত এক হাজার ১০০ মানুষকে হত্যা করে। সেইসঙ্গে ইরাকের হালাবজা শহরে রাসায়নিক অস্ত্র নিক্ষেপ করে নিজ দেশের পাঁচ হাজার নাগরিককে হত্যা করে বর্বর সাদ্দাম সরকার। হালাবজার অধিবাসীদের অপরাধ ছিল তার স্বৈরশাসক সাদ্দামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল।

হালাবজায় রাসায়নিক বোমা নিক্ষেপের ফলে তাৎক্ষণিকভাবে পাঁচ হাজার ইরাকি কুর্দি নিহত হয় এবং ওই গ্যাসে আক্রান্ত হয়ে পরবর্তীতে মারা যায় আরো প্রায় ১০ হাজার মানুষ। ইরাক-ইরান যুদ্ধের আট বছরে ইরানের প্রায় আড়াই লাখ যোদ্ধা ইরাকি বাহিনীর নিক্ষিপ্ত রাসায়নিক গ্যাসে আক্রান্ত হয়ে মারাত্মক পঙ্গুত্ব বরণ করেন। তাদের মধ্য থেকে ধীরে ধীরে হাজার হাজার মানুষের জীবনী শক্তি নিঃশেষ হয়ে যায় এবং তারা শাহাদাতবরণ করেন। এখনও হাজার হাজার ইরানি নাগরিক রাসায়নিক গ্যাসে আক্রান্ত হয়ে নানারকম শারিরীক জটিলতা নিয়ে বেঁচে আছেন।

১৯৮৮ সালে ইরাক-ইরান যুদ্ধ শেষ হওয়ার কয়েক বছর পর ওয়াইজেন্টাল নামের প্যারিস-ভিত্তিক মধ্যপ্রাচ্যের একটি সামরিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জানায়, ইরাককে রাসায়নিক অস্ত্র সরবরাহকারী ২০৭টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৮৬টি কোম্পানিই ছিল জার্মানির।নের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইরাক যে কেবল পশ্চিমা দেশগুলোর সমরাস্ত্র সাহায্যই পেয়েছিল তাই নয় সেইসঙ্গে পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলো তাদের পেট্রো ডলারের ভাণ্ডার বাগদাদের জন্য খুলে দিয়েছিল। এসব দেশ ইরাককে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করানোর জন্য হাজার হাজার কোটি ডলারের অর্থসাহায্য এবং বিনা সুদে ঋণ সহায়তা দেয়। এর ফলে ইরাকের যুদ্ধ করার ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়। কুয়েত সরকার ১৯৮১ সালের শেষদিকে সাদ্দাম সরকারের হাতে ৭০০ কোটি ডলারের সাহায্য তুলে দেয়। এরপর সৌদি আরব ৩০০ কোটি ডলার, সংযুক্ত আরব আমিরাত ১০০ কোটি ডলার এবং কাতার ৫০ কোটি ডলার ইরাককে হস্তান্তর করে। এসব দেশ ১৯৮২ সালে খোররামশাহর পুনরুদ্ধার পর্যন্ত বাগদাদ সরকারকে দুই হাজার ৫০০ কোটি ডলারের সহায়তা দেয়।#

পার্সটুডে/এমএমআই/১

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

 

ট্যাগ