নভেম্বর ০১, ২০২২ ১৬:৪৪ Asia/Dhaka

গত আলোচনায় আমরা ইরানের গণিতবিদ মারিয়াম মির্জাখনির জ্যামিতিক নানা সমস্যার সমাধান ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পুরস্কার লাভের কথা উল্লেখ করেছিলাম। এ প্রসঙ্গে ২০১৪ সালে 'ফিল্ডস মেডেলস' জেতার কথা বলেছিলাম যা ছিল গণিতের সর্বোচ্চ সম্মাননা পুরস্কার।

'ফিল্ডস মেডেলস' নির্বাচকমণ্ডলীর সদস্য অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেম ফ্রানসেস কিরওয়ান বলেন, 'গণিতকে প্রথাগতভাবেই 'পুরুষদের জন্য সংরক্ষিত' বলে মনে করা হলেও বহু শত বছর ধরেই নারীরা এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন। প্রথম নারী হিসেবে মির্জাখানির এ পুরস্কার জয় বহু নারী গণিতবিদকে উদ্দীপনা জোগাবে বলেও আমি আশা  করি'।

আরেক ব্রিটিশ গণিতবিদ অধ্যাপক জন বল দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলে গণিতবিদদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বলেছেন, একজন নারীর এ পদক পাওয়া দীর্ঘদিন ধরেই প্রত্যাশিত ছিল। অধ্যাপক মির্জাখানি নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ নারী গণিতবিদদের মধ্যে একজন।

পুরস্কার পাওয়ার পর মির্জাখানি বলেন, 'এই পুরস্কার আমার জন্য অনেক সম্মানের। আমি আরো খুশি হব যদি আমার পুরস্কার পাওয়ার মধ্য দিয়ে তরুণ নারী বিজ্ঞানী ও গাণিতিকরা উৎসাহ পায়। আমি নিশ্চিত আগামী দিনে আরো অনেক নারী এধরনের পুরস্কার পাবে'।

জ্যামিতিতে বিশেষ অবদানের জন্য বিশেষ করে সেমেট্রি অব কার্ভড সারফেস বা বক্রতলের প্রতিসাম্য বুঝার ক্ষেত্রে একটি ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর জন্য মরিয়ম 'ফিল্ডস মেডেল' পুরস্কার পান বলে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা হয়। মির্জাখানি গণিতের যেসব বিষয়ে রিসার্চ করছেন তার মধ্যে হাইপারবোলিক জিওমেট্রি, টেইচমুলার থিউরি, এরগোডিক থিওরি এবং সিমপ্লেকটিক জিওমেট্রি রয়েছে। অত্যন্ত মূল্যবান ও গণিতের নোবেল খ্যাত 'ফিল্ডস মেডেলস' অর্জনের পর মির্জাখনির নাম সারা বিশ্বে  ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্বের বড় বড় গণমাধ্যমগুলো মারিয়াম মির্জাখনিকে গণিতের জগতে বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব হিসেবে অভিহিত করেছে। ক্লে ম্যাথমেটিক্স ইনস্টিটিউট'র কর্মকর্তা জিমস কার্লসন বলেছেন, মির্জাখনি গণিতে নয়া অধ্যায়ের সূচনা করেছেন। বলা যায়, একটি গভীর তত্ত্ব থেকে সহজে কার্যকারণে পৌঁছার পথ দেখিয়েছেন তিনি।

প্রকৃতপক্ষে, মারিয়াম মির্জাখনি বর্তমান বিশ্বের শীর্ষ গণিতবিদের একজন। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে গণিতশাস্ত্রে তার দেয়া থিওরি বা তত্ব আগামী বহু বছর পর্যন্ত গণিতবিজ্ঞানে ব্যবহৃত বিষয় হয়ে থাকবে। এরকম একজন গুনি ব্যক্তির দ্রুত ও অসময়ে দুনিয়া থেকে চলে যাওয়ার ঘটনা নিঃসন্দেহে গণিতবিজ্ঞানের জন্য অনেক বড় ক্ষতি। 'ইন্সটিটিউশন ইউনিয়ন অব ওয়ার্ল্ড ম্যাথমেটিকেল সোসাইটিস' ইরানী গণিত সমাজের মহিলা কমিটির প্রস্তাব অনুযায়ী মারিয়াম মির্জাখনির জন্মদিন মে মাসের ১২ তারিখকে 'গণিতে নারী' শীর্ষক দিবস পালনের ঘোষণা দিয়েছে। 

সিস্তান অঞ্চলে পরজীবী মৌমাছির একটি নতুন প্রজাতির সন্ধান মারিয়াম মির্জাখনিরই অবদান। ২০১৮ সালে ২ফেব্রুয়ারী 'ইমেজ অ্যানালাইসিস এ্যাণ্ড আর্থ অবজারভেশনের সঙ্গে জড়িত একটি কোম্পানি মরিয়ম মির্জাখানির সম্মানে একটি মাইক্রো-স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করেছে। এছাড়া, তার স্মরণেই 'মাইক্রোপ্ল্যানেট সার্ভে সেন্টার' 321357 গ্রহাণুর নাম দিয়েছে 'মির্জাখানি'।

মারিয়াম মির্জাখনি

আপানরা গণিত বিজ্ঞানে মারিয়াম মির্জাখনির অসামান্য অবদান এবং তার সম্পর্কে বিভিন্ন ব্যক্তির মূল্যায়ন শুনলেন।

অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, মাধ্যমিক স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞানের সাথে তাল মিলিয়ে আরো উচ্চতর গণিত শেখার প্রয়োজনীয়তা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এ অবস্থায় সব সরকার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উচিত গণিতের প্রতি সবার আগ্রহ সৃষ্টি বা শিক্ষা  দানের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা। ব্রিটেনের খ্যাতনামা দার্শনিক ও গণিতবিদ বারট্রান্ড রাসেল বলেছেন, গণিত শুধু যে ভেতরের লুকায়িত সত্য ও বাস্তবতাকে বাইরে বের করে আনে তাই নয় একই সাথে এটি সৌন্দর্যের চূড়ান্ত বহি:প্রকাশ  ঘটায়।

জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় শতাধিক ইরানি মনীষীর অবদান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় সেই প্রাচীন কাল থেকেই এই ভূখণ্ডে জ্ঞানচর্চা হয়ে আসছে। বলা যায় ইরান ছিল মনীষীদের লালনভূমি। প্রাচীন কাল থেকেই ইরানের বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদরা জনগণের সমস্যা ও প্রয়োজনীয়তার বিষয়টিকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করে এসেছেন। তারা বোঝার চেষ্টা করতেন কেন একেক জিনিসের একেক বৈশিষ্ট্য? কেন বস্তুর ওজনের মধ্যে এতো তারতম্য? কেন আমরা ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে বস্তুর ভিন্ন ভিন্ন আচরণ আচরণ বা  প্রতিক্রিয়া দেখতে পাই? এ ছাড়া এ বিশ্বজগত, ভূমির গঠন কাঠামো এবং মহাকাশের বিভিন্ন বস্তু যেমন চন্দ্র ও সূর্যের গতিবিধি নিয়ে তারা গভীর চিন্তাভাবনা করতেন এবং এসবের রহস্য উৎঘাটনের চেষ্টা করতেন। তারা  পদার্থ  বিজ্ঞান বিশেষ করে যেকোনো বস্তু ও শক্তির প্রভাব-প্রতিক্রিয়া নিয়ে গভীর অধ্যয়ন ও গবেষণা চালাতেন। তারা প্রাকৃতিক বিভিন্ন ঘটনাবলীর মৌলিক সংজ্ঞা বা সারবস্তুকে পদার্থ বিজ্ঞানের সূত্র হিসেবে তুলে ধরতেন। এসব সূত্র বা আইন-কানুন আবার গণিত বিজ্ঞানের মাধ্যমে প্রমাণ করে এমন একটি ফরমুলায় নিয়ে আসতেন যা পদার্থ ও গণিতের মধ্যে সমন্বয় ঘটাতো এবং এটা প্রমাণ করতেন যে এ দুটি বিষয় একে অপরের পরিপূরক। অর্থাৎ গণিত বিজ্ঞান পদার্থ বিজ্ঞানের সমস্ত ক্রিয়াকলাপের ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম।

"পদার্থ" ও "বিজ্ঞান" দুটি সংস্কৃত শব্দ নিয়ে এটি গঠিত। এর ইংরেজি পরিভাষা ফিজিক্স শব্দটি গ্রিক 'ফুঁসিস' অর্থাৎ 'প্রকৃতি' এবং 'ফুঁসিকে' অর্থাৎ 'প্রকৃতি সম্পর্কিত জ্ঞান' থেকে এসেছে। বলা যায় পদার্থবিজ্ঞান হল সেই বিজ্ঞান যার লক্ষ্য আমাদের চারপাশের ঘটে যাওয়া বিভিন্ন প্রাকৃতিক ঘটনাবলীর রহস্যকে বোঝার চেষ্টা করা।

ফিজিক্স বা পদার্থ বিজ্ঞান হচ্ছে সবচেয়ে প্রাচীন ও মৌলিক বিজ্ঞানগুলোর মধ্যে একটি। ব্যবলিয়নবাসীরা প্রাচীনকালে যে বিজ্ঞান চর্চা করত তা থেকেই পরবর্তীকালে ভারত ,গ্রিস , ইরান, বেলজিয়াম , সিরিয়া, মধ্য এশিয়া এবং পশ্চিম ইউরোপে বিজ্ঞানচর্চার সূচনা ঘটে। পদার্থবিদ্যার মূল উদ্দেশ্য হলো প্রকৃতিকে জানা। বিভিন্ন সাক্ষ্য প্রমাণে দেখা যায়, খ্রিস্টপূর্ব হাজার হাজার বছর আগে প্রাচীন সুমেরিয় ও মিশরিয় এবং সিন্ধুনদের অববাহিকার জাতিগুলোর মধ্যে প্রকৃতি নিয়ে গবেষণা এবং সূর্য, চন্দ্র ও তারার গতিবিধি নিয়ে চর্চা হতো। পদার্থ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এসব নিয়ে বহু প্রশ্নের জবাব খুঁজে বের করার চেষ্টা করতেন।#

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/

 

 

ট্যাগ