নভেম্বর ০১, ২০২২ ১৮:৪২ Asia/Dhaka
  • ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস (১৩৯): যুদ্ধক্ষেত্রে ইরানি যোদ্ধাদের আল্লাহর স্মরণ

গত তিন আসরে আমরা যুদ্ধক্ষেত্রে তিনজন শহীদ ইরানি কমান্ডারের খোদাভীরুতা ও পরহেজগারি নিয়ে আলোচনা করেছি। আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইরানি শিবিরগুলোতে যে আধ্যাত্মিক পরিবেশ বিরাজ করত তার উদারহণ দিতে গিয়ে আমরা শহীদ আব্বাস বাবায়ি, শহীদ মোহাম্মাদ বোরুজেরদি ওরফে মাসিহ কুর্দিস্তান এবং শহীদ সাইয়্যেদ হোসেইন আলামুল হুদার জীবন ও কর্মের ওপর আলোচনা করেছি।

সেনাবাহিনীর চেইন-অব-কমান্ডের দিক দিয়ে যে যত উঁচু পর্যায়ের কমান্ডার তার খোদাভীরুতা ও ক্ষমা করার ক্ষমতাও তত বেশি।  শীর্ষ পর্যায়ের কমান্ডার থেকে শুরু করে সর্বনিম্ন স্তর পর্যন্ত ইরানি যোদ্ধাদের কথাবার্তা ও আচরণে পবিত্র কুরআনের শিক্ষার যথাযথ বাস্তবায়ন চোখে পড়ত।

সার্বিকভাবে সব ঐশী ধর্মের বিশেষ করে ইসলামের শিক্ষাকে মোটামুটি তিন ভাগে ভাগ করা যায়। এর একভাগে রয়েছে বিশ্বদর্শন, আকিদা ও বিশ্বাস, আরেকভাগে রয়েছে দ্বীনি বিধি-বিধান পালন এবং তৃতীয় ভাগে রয়েছে নৈতিকতা ও নৈতিক মূল্যবোধ।  মানবজাতিকে সঠিক পথ প্রদর্শন করে তাকে পূর্ণ সত্ত্বা আল্লাহ তায়ালার ঘনিষ্ঠ হতে সাহায্য করার জন্য মানবতার মুক্তির দূত বিশ্বনবী (সা.)-এর ওপর শ্রেষ্ঠতম ও পূর্ণাঙ্গ আসমানি কিতাব পবিত্র কুরআন নাজিল হয়। এই মহাগ্রন্থের কয়েকটি আয়াতে সুস্পষ্টভাবে লেখা হয়েছে, রাসূলে আকরাম (সা.)-এর রিসালাতের প্রধান উদ্দেশ্য মানুষের অন্তরাত্মাকে পরিশুদ্ধ করা। আর এখান থেকে পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, মানুষের নৈতিক চরিত্র গঠন করার ওপর কুরআনে কারিম কতখানি গুরুত্ব দিয়েছে। বলা হয়েছে, পারলৌকিক চিরস্থায়ী জীবনে সুখী হতে চাইলে অন্তরাত্মাকে পরিশুদ্ধ করে বিশুদ্ধ চিত্তে এক আল্লাহর ইবাদত করতে হবে। আর তা করতে না পারলে পরকালীন আবাস হবে জাহান্নাম।

পবিত্র কুরআন কোনো নৈতিকতার কিতাব না হলেও শ্রেষ্ঠতম নৈতিক শিক্ষাগুলো এখানেই পাওয়া যায়। মহাগ্রন্থ আল-কুরআন মুমিন ব্যক্তিদেরকে শ্রেষ্ঠতম নৈতিক শিক্ষায় নিজেদের সমৃদ্ধ করার আহ্বান জানায়। সেইসঙ্গে বিশ্বনবী (সা.)কে সর্বোত্তম চরিত্র হিসেবে আখ্যায়িত করার মাধ্যমে পবিত্র কুরআন একথাও বলে দিয়েছে যে, পরিপূর্ণ মানব হওয়ার চেষ্টা করতে চাইলে রাসূলের জীবনচরিতকে অনুসরণ করো। ন্যায়পরায়ণতা, উত্তম আচরণ, পরোপকার, সত্যবাদিতা, উদারতা, ধৈর্য ও সহনশীলতা, ক্ষমা, খোদাপ্রেম, ভ্রাতৃত্ব, নিষ্কলুস চরিত্র তথা সতীত্ব, ক্রোধ প্রশমন, বিনয়, অনর্থক কাজ থেকে বিরত থাকা, সৎকাজে সহযোগিতা করা এবং সব কাজে আল্লাহর ওপর নির্ভরতা হচ্ছে পবিত্র কুরআনে বর্ণিত নৈতিক শিক্ষাগুলোর কিছু উদাহরণ। মানুষের চরিত্র গঠনের সুমহান লক্ষ্যকে সামনে রেখে মানবচরিত্রের কিছু খারাপ দিকও কুরআনে কারিমে উল্লেখ করা হয়েছে যাতে মানুষ সেগুলো থেকে দূরে থাকতে পারে।

কুরআনে বর্ণিত দোষত্রুটিগুলোর মধ্যে রয়েছে দম্ভ, অহংকার, অবৈধ বাসনা চরিতার্থ করা, অপরের ব্যাপারে মন্দ ধারনা পোষণ করা, গুপ্তচরবৃত্তি, গীবত, অপবাদ দেওয়া, কথা লাগানো, অপরের দোষত্রুটি অন্বেষণ, পরনিন্দা, পরচর্চা, গুজব রটনা, কৃপণতা, অপব্যয়, লোভ, দুর্নীতিপরায়ণতা, বিশ্বাসঘাতকতা, শপথ ভঙ্গ, লোক দেখানো ইবাদত করা, পরশ্রীকাতরতা, মিথ্যাবাদিতা, পাষাণ হৃদয় হয়ে যাওয়া ইত্যাদি। এসব দোষত্রুটি থেকে মুমিনদের দূরে থাকার আহ্বান জানিয়েছে আল-কুরআন। এই মহাগ্রন্থ যেসব নৈতিক গুণাবলী অর্জন করতে বলেছে সেগুলো পরকালীন চিরস্থায়ী আবাসে সুখী হওয়ার লক্ষ্যকে সামনে রেখে অর্জন করতে বলা হয়েছে। সেইসঙ্গে এসব গুণাবলী পার্থিব জীবনেও মানুষের জন্য ইতিবাচক ফল বয়ে আনে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আল্লাহর রাস্তায় দান করলে দানকারী ব্যক্তি যেমন আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে তেমনি যাকে দান করা হলো তার দারিদ্র দূর হয় এবং মুসলিম সমাজ অভাব-অনটনমুক্ত হতে পারে।

আবার মানুষ সত্যবাদিতার গুণ অর্জন করলে তারা একদিকে যেমন আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারে তেমনি সমাজে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস বৃদ্ধি পায় এবং সামাজিক বন্ধন অটুট ও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত নৈতিক শিক্ষাগুলোর অন্যতম হচ্ছে জিহাদ ও আত্মরক্ষা।  শত্রুর আগ্রাসনের হাত থেকে দ্বীন কিংবা ইসলামি ভূখণ্ড রক্ষা করার জন্য জিহাদ করার আদেশ দেওয়া হয়েছে। অন্য কথায়, পবিত্র কুরআনের দৃষ্টিতে মুসলিম ভূখণ্ডের যোদ্ধাদেরকে জিহাদে যাওয়ার আগে অন্য সব উন্নত চারিত্রিক গুণাবলীতে নিজেকে সমৃদ্ধ করার আহ্বান জানানো হয়েছে। আর তা করতে পারলেই তার পক্ষে শত্রুর আগ্রাসন থেকে মুসলিম ভূখণ্ড রক্ষা করা সম্ভব বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

পবিত্র কুরআনে বর্ণিত অন্যতম নৈতিক গুণাবলী হিসেবে ধৈর্য ও সহনশীলতার কথা তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, যুদ্ধের ময়দানে বিজয়ের অন্যতম চাবিকাঠি হচ্ছে ধৈর্যধারণ করা। সূরা আনফালের ৬৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: হে নবী! আপনি মুমিনদেরকে যুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ করুন; তোমাদের মধ্যে বিশজন ধৈর্যশীল থাকলে তারা দু’শ জনের উপর বিজয়ী হবে এবং তোমাদের মধ্যে এক’শ জন থাকলে এক হাজার কাফিরের উপর বিজয়ী হবে। কারণ তারা এমন এক সম্প্রদায় যাদের বোধশক্তি নেই। ” এর পরের আয়াতেই বলা হচ্ছে: “আল্লাহ এখন তোমাদের ভার লাঘব করলেন এবং তিনি তো অবগত আছেন যে, তোমাদের মধ্যে দুর্বলতা আছে, কাজেই তোমাদের মধ্যে একশ জন ধৈর্যশীল থাকলে তারা দু’শ জনের উপর বিজয়ী হবে। আর তোমাদের মধ্যে এক হাজার থাকলে আল্লাহর অনুজ্ঞাক্রমে তারা দু’হাজারের উপর বিজয়ী হবে। আর আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে রয়েছেন।”

পবিত্র কুরআন মুসলিম যোদ্ধাদেরকে বেশি বেশি আল্লাহর স্মরণ করানও আহ্বান জানিয়েছে। সূরা আনফালেরই ৪৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: “হে ঈমানদারগণ! তোমরা যখন কোন দলের সম্মুখীন হবে তখন অবিচলিত থাক এবং আল্লাহকে বেশী পরিমাণ স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও।” বেশি বেশি আল্লাহর স্মরণ মুমিন ব্যক্তিদেরকে সব সময় উন্নত চরিত্র রক্ষা করতে সহযোগিতা করে এবং কঠিন ও বিপর্যয়কর মুহূর্তেগুলোতে অন্তরে প্রশান্তি ঢেলে দেয়। আল্লাহকে স্মরণ বা আল্লাহর জিকির যত বেশি করা যায় তত বেশি এই কাজে গায়েবি অনুপ্রেরণা পাওয়া যায়। ইরানি যোদ্ধা ও কমান্ডারদের জীবনচরিত ও শাহাদাতের ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তারা এক মুহূর্তের জন্য আল্লাহর স্মরণ বা জিকির থেকে বিচ্যুত হননি। তারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, তারা যদি আল্লাহকে স্মরণ করেন তবে আল্লাহও তাদেরকে স্মরণ করবেন এবং যুদ্ধের ময়দানে শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধে সাহায্য করবেন।#

পার্সটুডে/এমএমআই/২

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ