নভেম্বর ০১, ২০২২ ১৮:৫০ Asia/Dhaka

আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ইরানি সৈন্য ও কমান্ডাররা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ এবং তাকে সন্তুষ্ট করার জন্য যুদ্ধ করেছিলেন বলেই বিজয়ী হয়েছিলেন। এ সম্পর্কে পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে শহীদ ইরানি কমান্ডার হাজি ইব্রাহিম হেম্মাত তার যোদ্ধাদের বলেন: “আপনারা যখনই কোনো কাজ করতে যাবেন তা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য করুন। এটা করতে পারলেই আমাদের বিজয় নিশ্চিত।

আমাদের যুদ্ধ, আমাদের ঘুম এবং আমাদের অন্য সব কাজ যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য হয় তাহলে আমরা যুদ্ধের ময়দানে মারি বা মরি উভয় ক্ষেত্রেই আমরা বিজয়ী হবো।” শহীদ হেম্মাতের এই বক্তব্যের প্রভাব পড়েছিল সকল ইরানি যোদ্ধার অন্তরে। তারা তাদের সমস্ত কাজ একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য তথা ইখলাস বজায় রেখে করার চেষ্টা করতেন। প্রত্যেকে যেকোনো কাজে আগে ঝাঁপিয়ে পড়ার চেষ্টা করতেন এবং কাজটি কে করেছে সেটি বলার সময় কাউকে খুঁজে পাওয়া যেত না। কেউই নিজের নাম প্রকাশ করার ক্ষেত্রে অগ্রগামী ছিলেন না।

এ সম্পর্কে শহীদ মোহাম্মাদ বোরুজেরদি যাকে সবাই মাসিহ কুর্দিস্তান বলে ডাকত তার সম্পর্কে একটি ঘটনা রয়েছে। তিনি সব সময় রেডিও, টেলিভিশন ও পত্রপত্রিকার সাংবাদিকদের কাছ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করতেন। তিনি চাইতেন না তার কোনো বক্তব্য বা ছবি প্রকাশিত হোক। তিনি ক্যামেরাম্যান দেখলেই বলতেন ‘আমার ছবি তুলো না ভাই। ওই দিকে গিয়ে দেখো যারা যুদ্ধ করছে তাদের ছবি তোলো।’ একবার সারদাশত এলাকায় বিদ্রোহ দমনের সময় একজন ক্যামরাম্যান মাসিহ কুর্দিস্তানের দিকে ক্যামেরা তাক করে ছবি তোলে ও ভিডিও ধারণ করে।  বিষয়টি বুঝতে পেরে তিনি ক্যামেরাম্যানের কাছে যান এবং সর্বোচ্চ ভদ্রতা ও বিনয়ীভাব বজায় রেখে ক্যামেরাম্যানের কাছ থেকে ফিল্মটি নিয়ে নেন। এরপর তার নিজের ছবির অংশটি আলাদা করে সেটা নষ্ট করে ফেলেন।

শহীদ মোহাম্মাদ বোরুজেরদি

পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে ইরানের ১৭-আলী ইবনে আবি তালিব ডিভিশনের কমান্ডার মোহাম্মাদ বুনিয়াদি শাহাদাতবরণ করেন। শহীদ বুনিয়াদির মা তার সম্পর্কে বলেন: মোহাম্মাদের চরিত্রের বিশেষ কিছু দিক ছিল। সে তার কাজে ছিল একনিষ্ঠ এবং সব কাজে একমাত্র আল্লাহকে সন্তুষ্ট করতে চাইত। সে কখনো ছুটিতে  বাড়িতে আসলে যুদ্ধক্ষেত্রে তার কতো বড় দায়িত্ব রয়েছে বা সে কী কী কাজ করে তা কখনও বলত না। এ কারণে তার যুদ্ধ তৎপরতা সম্পর্কে আমাদের তেমন কিছু জানা ছিল না।

যুদ্ধের সময় উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তারা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সঙ্গে মিশে গিয়ে তাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করতেন। তারা নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করতেন না। কোনো যোদ্ধা যদি ওই কমান্ডারকে আগে থেকে না চিনে থাকত তাহলে তার পক্ষে বোঝার উপায় ছিল না যে, তার পাশে কতো বড় একজন কমান্ডার যুদ্ধ করছেন।

শহীদ হাজি ইব্রাহিম হেম্মাত ও শহীদ মেহদি বাকেরি সম্পর্কে এ ধরনের বহু জনশ্রুতি রয়েছে।  এই দুই কমান্ডার সাধারণ সৈনিকদের সঙ্গে মিশে গিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে ট্রাক থেকে অস্ত্রসস্ত্র ও গোলাবারুদ নামানো এবং ওঠানোর মতো কাজ করতেন। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো- এরকম কাজ করার সময় সৈনিকেরা তাদেরকে চিনত না বলে অনেকে তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারও করত। কিন্তু এই দুই পদস্থ সেনা কর্মকর্তা মুখ বুজে সেসব হজম করতেন। পরবর্তীতে যখন এসব সেনা বুঝতে পারত যে, তাদের কমান্ডার তাদের সঙ্গে কাজ করেছিলেন এবং কমান্ডারের সঙ্গে তারা দুর্ব্যবহার করেছে তখন তারা লজ্জিত হয়ে তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিত।

শহীদ মেহদি বাকেরি- শহীদ সাইয়্যাদ শিরাজি

৩১-আশুরা ডিভিশনের কমান্ডার শহীদ মেহদি বাকেরি তার ভাই শহীদ হামিদ বাকেরির শাহাদাতের এক বছর পর ১৯৮৫ সালে ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেনী (রহ.)-এর সঙ্গে দেখা করতে যান। ওই সাক্ষাতে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ও বর্তমান সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী উপস্থিত ছিলেন। এ সময় মেহদি বাকেরি আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ীকে অনুরোধ করেন তিনি যেন ইমামকে তার শাহাদাতের জন্য দোয়া করতে বলেন। এই ছিল ইরানি সেনা কমান্ডারদের বিশুদ্ধ অন্তরের অবস্থা।

মেহদি বাকেরি তার ওসিয়তনামায় লিখেছেন: হে আল্লাহ! তুমি আমাকে তোমার সাক্ষাতের জন্য কবুল করে নাও। আমার শাহাদাতের পর আমার মরদেহ যেন কেউ খুঁজে না পায়। তাহলে এই পৃথিবীর এক বিঘত জায়গাও আমার কবরের জন্য নষ্ট হবে না। হে আল্লাহ! আমাকে পবিত্র করে গ্রহণ করো।”

১৯৮৫ সালের মার্চ মাসে ইরাকি বাহিনীর বিরুদ্ধে বদর অভিযান শুরু হয়। মেহদি বাকেরির নেতৃত্বাধীন আশুরা ডিভিশনের প্রথম ব্যাটেলিয়ানটি দজলা নদী পার হয়ে ইরাকি বাহিনীর ওপর হামলা চালায়। ফজরের আজানের আগেই ইরানি সেনাদের ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের সদস্যরা দজলা নদীর উপর অস্থায়ী সেতু নির্মাণের কাজ সম্পন্ন করেন।

মেহদি বাকেরি ও তার সহযোদ্ধারা ততক্ষণে ইরাকি বাহিনীর মারাত্মক ক্ষতিসাধন করেন।  ১৯৮৫ সালের ১৫ মার্চ ইরানি যোদ্ধাদের এই দলটি নিজেদের সামান্য অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে ইরাকি বাহিনীর ভারী অস্ত্রসস্ত্র ও গোলাবারুদের মোকাবিলায় অকুতোভয় লড়াই করছিলেন।  জীবনের শেষ মুহূর্তে মেহদি বাকেরি কাঁধে আরপিজি নিয়ে শত্রুসেনাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। 

এ সময় তার মাথায় শত্রুসেনাদের নিক্ষিপ্ত একটি গুলি আঘাত হানে এবং তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। সহযোদ্ধারা বহু কষ্টে তাকে তুলে দজলা নদীতে অপেক্ষমান স্পিডবোটে তুলতে সক্ষম হন। এ সময় তার সারা শরীর রক্তে ডুবে যাচ্ছিল। স্পিডবোট চলতে শুরু করে। এ সময় স্পিডবোটটি চালাচ্ছিলেন আলীরেজা তোন্দরো নামের একজন সৈনিক। হঠাৎ ইরাকি বাহিনীর নিক্ষিপ্ত একটি গোলা এসে স্পিডবোটে পড়ে এবং প্রচণ্ড বিস্ফোরণে স্পিডবোটসহ মেহদি বাকেরি ও আলীরেজার শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে দজলা নদীতে ডুবে যায়। তার শাহাদাতের খবর পেয়ে ইমাম খোমেনী তাকে ‘ইসলামের শহীদ’ উপাধিতে ভূষিত করেন।#

পার্সটুডে/এমএমআই/২৭

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ