নভেম্বর ০১, ২০২২ ২০:৩৫ Asia/Dhaka

গত কয়েক আসরে আমরা ইরানের সেই কমান্ডারদের নিয়ে আলোচনা করেছি যারা ইসলামি বিপ্লব ও তাদের মাতৃভূমি ইরানকে রক্ষা করার জন্য প্রাণপণ যুদ্ধ করে শেষ পর্যন্ত শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করেছিলেন। এসব কমান্ডার ছিলেন ঈমান, আত্মত্যাগ ও প্রতিরোধ সংগ্রামের মূর্ত প্রতীক। পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধের সময় কেউ ইরানের সেনা সমাবেশে প্রবেশ করলে বুঝতেই পারত না সেখানে কে কমান্ডার আর কে সাধারণ সৈনিক।

কমান্ডার হওয়ার জন্য যোদ্ধাদের মধ্যে কোনো প্রতিযোগিতা ছিল না বরং যার যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতা ও সামরিক প্রশিক্ষণ বেশি ছিল তাকে অনেকটা জোর করে কমান্ডারের দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া হতো। আজকের আসরে আমরা যে কমান্ডারের জীবনী নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করব তিনি হলেন শহীদ হাসান বাকেরি।

হাসান বাকেরি ২৬ বছর ১০ মাসের জীবন নিয়ে এই পৃথিবীতে এসেছিলেন। এরমধ্যে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে পার করেছিলেন ২১ বছর। ইসলামি বিপ্লবের পর যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত ‌১৯ মাস এবং যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ২৮ মাস সেনা কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করার সৌভাগ্য লাভ করেন। বিপ্লব বিজয়ের পরপরই অবশ্য হাসান বাকেরি কিছুদিন সাংবাদিকতা করেন। একইসঙ্গে তিনি সে সময় সদ্য প্রতিষ্ঠিত ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি’র গোয়েন্দা বিভাগে দায়িত্ব পালন করেন। শহীদ হাসান বাকেরি সম্পর্কে আরেকজন শহীদ কমান্ডার হাজি ইব্রাহিম হেম্মাতের বক্তব্য উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেন, “আমরা আগ্রাসী ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বহু কমান্ডারকে হারালেও তাদের মধ্যে আদর্শ ছিলেন হাতে গোনা কয়েকজন। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন শহীদ বাকেরি যার  মধ্যে আমি একজন মহান মানুষের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেতাম।”

আট বছরের পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধের অন্যতম কমান্ডার ও হাসান বাকেরির সহযোদ্ধা জেনারেল গোলামআলী রশিদ বাকেরির ব্যক্তিত্বের উল্লেখযোগ্য দিক সম্পর্কে বলেন, হাসান বাকেরির দৃষ্টিতে পার্থিব জীবন ও দুনিয়ার চাকচিক্যের কোনো মূল্য ছিল না। তিনি হযরত আলী (আ.)-এর কাছ থেকে সাধাসিধে জীবনযাপন শিখেছিলেন। তার বাসায় কোনো ধরনের বিলাসী পণ্য ছিল না। বন্ধুরা তাকে বলত: তুমি অন্তত তোমার বাসায় একটি কার্পেট অথবা সতরঞ্জি বিছিয়ে রাখো যাতে ঘরে অতিথি আসলে তারা একটু আরামে সময় কাটাতে পারে। শহীদ বাকেরি পবিত্র কুরআনের সূরা তওবার ৩৮ নম্বর আয়াতকে গলার মালা বানিয়ে নিয়েছিলেন। এই আয়াতে বলা হয়েছে, আখেরাতের জীবনের তুলনায় পার্থিব জীবনের চাকচিক্যের বিন্দুমাত্র মূল্য নেই।

শহীদ হাসান বাকেরি পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধের ২৮ মাসের স্বল্পতম সময়ের দায়িত্ব পালনকালে শরিয়তের প্রতিটি বিধান পালন করার চেষ্টা করেছেন। ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেনীর দৃষ্টিভঙ্গি ও দিকনির্দেশনা মেনে চলার ক্ষেত্রে তিনি কখনও পিছপা হননি। তিনি ইমামে এই বাণীকে সারাক্ষণ স্মরণে রাখার চেষ্টা করতেন: “যদি মনে করো ক্লান্ত হয়ে পড়েছো তাহলে খুঁজে দেখার চেষ্টা করবে কোথায় তুমি ভুল করেছো কারণ, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের কাজে মানুষ কখনও ক্লান্ত হয় না।”

যেসব কমান্ডার ক্যাম্পে বসে থাকেন এবং দূর থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করেন হাসানন বাকেরি তাদের মতো ছিলেন না। মৃত্যু ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও তিনি সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে চলে যেতেন যা দেখে ইরানি যোদ্ধারা দ্বিগুণ উৎসাহে শত্রুসেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই করত। আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস এবং তাঁর মদদ পাওয়ার ব্যাপারে শহীদ বাকেরি দৃঢ়সংকল্প ছিলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি কখনও আল্লাহর স্মরণকে ভুলে যাননি। আজান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নামাজ আদায়ের ব্যাপারে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সচেতন। কখনও গাড়িতে করে দূরবর্তী গন্তব্যে যাওয়ার সময় আজান দিলেই তিনি গাড়ি থামিয়ে নামাজ আদায় করে নিতেন।রাসূলুল্লাহ (সা.)এর পবিত্র আহলে বাইতের প্রতি শহীদ বাকেরির ছিল অগাধ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

উন্নত নৈতিক চরিত্রের অধিকারী শহীদ বাকেরি যুদ্ধের ময়দানে ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন এক ব্যক্তিত্ব। আমরা আগেও বলেছি, ইরাক-ইরান যুদ্ধ শুরুর আগে শহীদ বাকেরি সাংবাদিকতা করতেন। তিনি ছিলেন ‘ইসলামি প্রজাতন্ত্র’ পত্রিকার সাংবাদিক।তাকে ইরানের বর্তমান সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী  ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসিতে পাঠিয়েছিলেন। এ সম্পর্কে এই বাহিনীর তৎকালীন প্রধান কমান্ডার মোহসেন রেজায়ি বলেন, “একদিন আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী আমাকে ফোন করে বলেন, ইসলামি প্রজাতন্ত্র পত্রিকায় এক তরুণ কাজ করছেন যিনি যুদ্ধের ময়দানে গোয়েন্দা তৎপরতা চালাত চান।” ইরাকি বাহিনী ইরানে আগ্রাসন চালালে হাসান বাকেরিকে দু’দেশের সীমান্তবর্তী আহওয়াজ অঞ্চলে পাঠানো হয়।

তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়েই শত্রুসেনাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে প্রয়োজনীয় গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহে মনোনিবেশ করেন। স্থানীয় জনগণকে অন্তর্ভুক্ত করে তিনি একটি গোয়েন্দা ইউনিট গঠন করেন। সেনাবাহিনী ও আইআরজিসি’র বিভিন্ন বৈঠকে হাসান বাকেরি যেসব গোয়েন্দা তথ্য পরিবেশন করতেন এবং এ সম্পর্কে যে বিশ্লেষণ তুলে ধরতেন তা দেখে সেনা কমান্ডাররা থ মেরে যেতেন। সহযোদ্ধারা তাকে ‘সেরা সমরবিদ’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। হাসান বাকেরি মধ্যরাত পর্যন্ত জেগে জেগে বিভিন্ন অভিযানের পরিকল্পনা তৈরি করতেন। তিনি মূল পরিকল্পনার পাশাপাশি পরিবর্তিত পরিস্থিতির জন্য কয়েকটি বিকল্প পরিকল্পনাও তৈরি করে রাখতেন যা যুদ্ধে কাজে আসত। ইরাকি বাহিনী আগ্রাসন শুরু করার দুই বছরের মাথায় ওই বাহিনীকে আন্তর্জাতিক সীমান্তের ওপারে পাঠিয়ে দেয়ার ঘটনায় যাদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল তাদের শীর্ষে ছিলেন শহীদ বাকেরি।#

পার্সটুডে/এমএমআই/২

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

 

ট্যাগ