নভেম্বর ০১, ২০২২ ২০:৪৭ Asia/Dhaka

ইরাকের আগ্রাসী সাদ্দাম সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সময় কেউ যদি ইরানি শিবিরগুলোতে যেতেন তাহলে তিনি এক অদ্ভুত বিষয় দেখতে পেতেন। তিনি দেখতেন, নিরীহ প্রকৃতির ঈমানদার কিছু মানুষ নানা কাজে ব্যস্ত রয়েছে এবং তাদের মধ্যে ধর্মকর্ম পালন করার প্রতি আগ্রহ প্রবল। একেবারেই মনে হয় না যে, এই মানুষগুলো সাদ্দামের মতো একজন রুক্ষ শাসকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য এখানে সমবেত হয়েছেন। ইরানের শিবিরগুলোকে সে সময় মানুষ তৈরির কারখানা বলা হতো।

ইরানি কমান্ডার হাসান বাকেরিকে নিয়ে কথা বলছিলাম আমরা। মাত্র ২৫/২৬ বছরের এই ঈমানদার সেনা কমান্ডারকে রণ কৌশলবিদ বলা হতো। নবগঠিত ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসির অপারেশন্স ইউনিটগুলোর গোয়েন্দা শাখা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এই শহীদ কমান্ডার। আর এ কাজের মাধ্যমে তিনি ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যথেষ্ট সাফল্যের পরিচয় দেন।

আইআরজিসির এই গোয়েন্দা শাখার জন্য একটি শক্তিশালী আর্কাইভের প্রয়োজন অনুভব করেন শহীদ বাকেরি। তিনি যুদ্ধ সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য নোট করে তা গোপন তথ্য আকারে আর্কাইভে রাখার নির্দেশ দেন। নিজের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি নিজে যুদ্ধের ঘটনাবলী লিখে রেখে গেছেন। তার লেখা সেই নোটগুলো পরবর্তীতে বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে। পাঁচ খণ্ডের এই বইয়ে দেখা যায়, গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, সেগুলো বিচার-বিশ্লেষণ ও যুদ্ধ পরিচালনায় অসামান্য দক্ষতা অর্জন করেছিলেন শহীদ বাকেরি। তার দক্ষ হাতে যুদ্ধ পরিচালনায় আগ্রাসী ইরাকি বাহিনী পর্যন্ত হতভম্ভ হয়ে গিয়েছিল। 

শত্রুবাহিনীর যুদ্ধ প্রস্তুতির খবরাখবর জানার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ছিল ইরানের হাতে বন্দি ইরাকি সেনা ও কমান্ডাররা। শহীদ হাসান বাকেরি যুদ্ধবন্দিদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহের জন্য একটি দপ্তর খোলেন। ধীরে ধীরে ইরাকি বাহিনীর ইরান আগ্রাসনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এবং তাদের রণকৌশল সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য ইরানের হাতে চলে আসে। শহীদ বাকেরির সহযোদ্ধা শহীদ মাহদি সাবুনি এ সম্পর্কে বলেন: যখন কেউ আটক ইরাকি সেনাদের কাছে পাওয়া তথ্য ও দলিল-প্রমাণকে গুরুত্বই দিত না তখন শহীদ বাকেরি আটক শত্রু সেনাদের সব দলিল-পত্র সংগ্রহ করার নির্দেশ দেন। যুদ্ধের শুরুর দিনগুলো থেকে তিনি এ কাজ শুরু করেন এবং বলেন, একদিন এসব কাগজপত্র কাজে লাগবে। রাত ১টার দিকে সবাই যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ত তখন তিনি নিজের ঘুম শেষ করে উঠে পড়তেন এবং এসব কাগজপত্র ঘাটাঘাটি শুরু করতেন।

ইরানের ওপর সাদ্দাম বাহিনীর আগ্রাসী তৎপরতা প্রথম দফায় থেমে যাওয়ার পর ইরানের পক্ষ থেকে প্রথম প্রথম যে অভিযানগুলো চালানো হয় সেগুলো চালানো হয় হাসান বাকেরির সংগ্রহ করা তথ্যের ভিত্তিতে। এসব অভিযানের বেশিরভাগ সফল হয়; ফলে ইরানি যোদ্ধারা হারানো মনোবল ফিরে পান। সেইসঙ্গে ইরানি সেনা কমান্ডাররা নতুন নতুন অভিযান চালানোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। পাশাপাশি শহীদ বাকেরি তার গোয়েন্দা তথ্য ও শত্রুসেনাদের কাছ থেকে পাওয়া দলিলপত্র উদ্ধারের কাজ চালিয়ে যান। তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ২৪ বছর বয়সি এই ছাত্র নিজের সংগ্রহ করা তথ্যের ভিত্তিতে শত্রুসেনাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার পরিকল্পনাও তৈরি করে দেন। ছোট ছোট অভিযানে সাফল্য পাওয়ার পর আসে বড় অভিযান চালানোর পালা। প্রথম যে বড় অভিযানটি চালানো হয় তার মাধ্যমে আবাদান শহরের ওপর থেকে ইরাকি বাহিনীর অবরোধ সরিয়ে দিতে সক্ষম হন ইরানি যোদ্ধারা। এর ফলে ইরানের বিশাল ভূখণ্ড ইরাকি বাহিনীর দখলমুক্ত হয়।

এই অভিযানে শহীদ বাকেরি ‘দারখুইন’ ও ‘মাহশাহর’ এলাকার কমান্ডিং-এর দায়িত্বে ছিলেন। এই অভিযানের পর ইরানি কমান্ডাররা পরবর্তী অভিযানগুলোর প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত নেন। এ কারণে হাসান বাকেরি বুস্তান শহর মুক্ত করার লক্ষ্যে আরেকটি অভিযানের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেন। তিনি পদস্থ কর্মকর্তাদের সামনে অভিযানের একটি সার্বিক চিত্র তুলে ধরেন এবং সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। ওই অভিযানেও ইরানি বাহিনী সাফল্য অর্জন করে।

যুদ্ধের দ্বিতীয় বছরে আবাদান ও বুস্তান মুক্ত করার মতো আরো কিছু অভিযান সমাপ্ত হওয়ার পর শহীদ বাকেরির সামনে আরো বড় দায়িত্ব এসে যায়। এবার একটি বড় অভিযানের প্রস্তুতি নেয়া হয় যেটি ফাতহুল মুবিন নামে পরিচিত।  এই অভিযানে ইরানি যোদ্ধাদের চারটি ক্যাম্প অংশগ্রহণ করে যাদের মধ্যে শহীদ বাকেরি ছিলেন নাস্‌র ক্যাম্পের কমান্ডার।

এই অভিযানের প্রথম পর্যায়েই হাসান বাকেরি পূর্ব পরিকল্পিত সবগুলো লক্ষ্য অর্জন করতে সক্ষম হন। অভিযানের দ্বিতীয় পর্যায়ে রাডার হিলট্র্যাক দখল করে তিনি অভিযানের চূড়ান্ত বিজয় নিশ্চিত করেন। এই অভিযানের পর আইআরজিসির তৎকালীন কমান্ডার মোহসেন রেজায়ি শহীদ হাসান বাকেরিকে তার অন্য সব কাজ বন্ধ রেখে বায়তুল মোকাদ্দাস অভিযানের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করার নির্দেশ দেন। এটি ছিল হাসান বাকেরির জীবনের সবচেয়ে কঠিন অভিযান এবং এর মাধ্যমে ইরানের খোররামশাহর ইরাকি বাহিনীর দখলমুক্ত হয়। এই অভিযানেও নাসর ক্যাম্পের কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন হাসান বাকেরি। তার ক্যাম্পের কাজটি ছিল সবচেয়ে কঠিন কারণ, সামনে এবং পেছন উভয় দিক দিয়ে আক্রমণের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল নাসর ক্যাম্পকে। হাসান বাকেরির অসামান্য দক্ষতায় নাসর ক্যাম্প ওই দায়িত্ব সূচারুরূপে পালন করে এবং শত্রু সেনাদের নাস্তানাবুদ করে খোররামশাহর মুক্ত করা হয়।

খোররামশাহর মুক্ত করার পর শহীদ হাসান বাকেরি কারবালা ক্যাম্পে যান। এ সময় তিনি মুসলিম ইবনে আকিল ও মহররম নামক দু’টি অভিযানের পরিকল্পনা প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। অবশেষে ১৯৮৩ সালের ২৯ জানুয়ারি ওয়ালফাজর-১ অভিযানের প্রস্তুতি নেওয়ার সময় শত্রুসেনাদের নিক্ষিপ্ত একটি গোলার আঘাতে হাসান বাকেরি শাহাদাতবরণ করেন। এই তরুণ কমান্ডারের ডায়েরি থেকে জানা যায়, তিনি দৈনিক ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৮ ঘণ্টাই কাজে ব্যস্ত থাকতেন এবং রাত জেগে বড় বড় অভিযানের পরিকল্পনা তৈরি করতেন। ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেনী (রহ.) শহীদ বাকেরির শাহাদাতের পর তার ছবির উপর লিখে দেন: মহান আল্লাহ আমাদের এই রাত্রি জাগরণকারী শহীদকে ইসলামের প্রাথমিক যুগের শহীদদের সঙ্গে হাশর-নাশর করুন।#

পার্সটুডে/এমএমআই/২৭

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

 

ট্যাগ