কামাল উদ্দিন ফারসি
জ্ঞান-বিজ্ঞানে ইরানিদের অবদান-(পর্ব-১৬)
গত পর্বের আলোচনা অনুষ্ঠানে আমরা আলোকবিদ্যা ক্ষেত্রে ইরানি মনীষী ইবনে হাইসামের গুরুত্বপূর্ণ অবদান সম্পর্কে আলোচনা করেছিলাম। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা ইরানের আরেকজন খ্যাতনামা মনীষী কামাল উদ্দিন ফারসির অবদান সম্পর্কে আলোচনা অব্যাহত রাখব। আশা করি শেষ পর্যন্ত আপনারা আমাদের সাথেই থাকবেন।
ইরানের খ্যাতনামা মনীষী কামাল উদ্দিন ফারসি এমন এক যুগের বাসিন্দা ছিলেন যখন একদিকে মুসলিম বিশ্ব ক্রুসেড যুদ্ধ থেকে মুক্তি পাচ্ছিল অন্যদিকে মুসলিম বিশ্ব মঙ্গলদের আক্রমণের মুখোমুখি হওয়ার দ্বারপ্রান্তে ছিল। তবে একের পর এক দুর্যোগ সত্বেও মুসলিম ভূখণ্ড বিজ্ঞানের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় পার করছিল। দুর্যোগ সত্বেও এ সময় ইরানের মনীষীরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে জ্ঞান গবেষণা অব্যাহত রাখেন।
পানি ও আলো এই দুটি উপাদান ছাড়া মানুষের জীবনকে কল্পনা করা যায় না। আলো এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যার কারণে বিশ্ব প্রকৃতি টিকে আছে এবং এ কারণে এ বিশ্বে মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশ ঘটেছে। সৌরশক্তি হতে প্রাপ্ত আলোর কারণেই পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব টিকে আছে। আলোর এ গুরুত্বের কারণেই জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সব সময় সূর্য, আলো, গ্রহ-নক্ষত্রের বিষয়ে তথা মহাকাশের রহস্য নিয়ে গবেষণা ও অনুসন্ধান চালিয়েছেন। আজ আমরা সবাই জানি সূর্যের আলোকরশ্মি আমাদের অস্তিত্বের অন্যতম কারণ। এমনকি পানির অস্তিত্ব থাকলেও আলো না থাকলে আমাদের জীবন যাপনই অসম্ভব হয়ে পড়তো।
দৃষ্টিশক্তি নির্ভর করে চোখে আলো ধারণ করার শক্তির ওপর। মানুষের চোখের বৈশিষ্ট্য বুঝতে হলে আলোর বৈশিষ্ট্য জানা জরুরি। চোখের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চক্ষুরোগের চিকিৎসার জন্য যেসব যন্ত্রপাতি বা প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয় তাতে আলোর বিচিত্র বৈশিষ্ট্যের ব্যবহার রয়েছে। আলোর এ বৈশিষ্ট্যের কারণে চিকিৎসক যন্ত্র দিয়ে চোখের চিকিৎসা করতে সক্ষম হন। প্রযুক্তিগতভাবে, আলো কেবলমাত্র ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গ যার মাধ্যমে কোনো কিছু দৃশ্যমান হয়। অন্য কথায় বলা যায়, আলো এমন কিছু ফোটনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত শক্তি যা মানুষের চোখের বিশেষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বস্তুর দৃশ্য উপলব্ধি করতে সহায়তা করে। ফোটন হচ্ছে আলোর কণা বা একক। আলোকরশ্মি কোন শক্তি থেকে অনবরত বের না হয়ে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিচ্ছিন্ন প্যাকেট বা শক্তি হিসেবে বের হয়। প্রত্যেক বর্ণের আলোর জন্য এক একটি বিচ্ছিন্ন প্যাকেটের শক্তির নির্দিষ্ট মান রয়েছে। এই এক একটি বিচ্ছিন্ন প্যাকেটকে কোয়ান্টাম বা ফোটন বলে।
সংখ্যাতত্ব ও আলোকবিদ্যা গবেষণায় অবদান রাখেন ইরানের খ্যাতনামা গবেষক কামালউদ্দিন ফারসি। খ্রিস্টিয় ১২৬৭ সালে ইরানের শিরাজে তার জন্ম হয় এবং ১৩১৯ সালের জানুয়ারিতে তাবরিজ শহরে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আলোকবিজ্ঞানের বিষয়ে কামালউদ্দিনের চিন্তাজগতে নানা প্রশ্নের জন্ম দিত। তিনি তার দীর্ঘ জীবনের বেশিরভাগ সময়ে এ সব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন। আলোকবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কামালউদ্দিন ফারসির গবেষণাকর্ম ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এরপর তার কর্মগুলো সারা বিশ্বে বৈজ্ঞানিক গবেষণার উৎসে পরিণত হয়। কামালউদ্দিন ফারসি শিক্ষা গ্রহণের জন্য বিভিন্ন জায়গা সফর করেন। তিনি গণিত শিক্ষা গ্রহণের জন্য দীর্ঘ সময় ইস্পাহানে কাটিয়েছিলেন। গণিতেও তিনি অবদান রাখেন। তিনি কুতুবুদ্দি শিরাজির কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেন। আল কাওয়ায়েদে ফি ওসুল আল ফাওয়েদে নামে তার গণিতের গ্রন্থ রয়েছে।
ইমাদ উদ্দিন কাশানি এবং গিয়াস উদ্দিন জামশিদ কাশানির মতো নামকরা জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা তাদের বিভিন্ন রচনাবলীতে কামালউদ্দিন ফারসির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। কেননা তিনি আলোক পদার্থবিদ্যার ওপর গবেষণা চালান। এ ছাড়া, গণিত ও জ্যামিতির ওপরও তিনি গবেষণা চালিয়েছেন।

কামালউদ্দিন ফারসিই ছিলেন প্রথম বিজ্ঞানী যিনি চোখের নানা ত্রুটি বা সমস্যা নিয়ে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছিলেন। দৃষ্টিশক্তির নানা সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি বিভিন্ন ধরনের লেন্সের ব্যবহার করেন। লেন্স ব্যবহারের ক্ষেত্রে তার উদ্ভাবিত পদ্ধতি ১৬শ' শতাব্দির দিকে ফটোগ্রাফির নিয়ম এবং টেলিস্কোপ ও মাইক্রোস্কোপেও ব্যবহার শুরু হয়।
আলোক পদার্থবিদ্যার বিষয়ে 'তানকিহ আল মোনাযের' ছিল কামালউদ্দিন ফারসির একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। এই গ্রন্থে তিনি আলোকবিজ্ঞানের নানা জটিল তত্ব নিয়ে আলোচনা করেছেন। এটি জ্ঞানবিজ্ঞানে মুসলিম বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হিসেবে পরিচিত। তার এ গ্রন্থে সাতটি নিবন্ধ রয়েছে যেখানে আলোকবিদ্যা বিষয়ে ইবনে হিশামের কিছু ভুল তিনি সংশোধন করে দিয়েছেন এবং বৈজ্ঞানিক কাজ ও গবেষণাকর্মগুলো কীভাবে স্থানান্তর করা যায় সে সম্পর্কেও তিনি উল্লেখ করেছেন। আলোর বিকিরণ, প্রতিফলন, অনুপ্রবেশ প্রভৃতি বিষয় তাকে এতোটাই বিস্মিত করতো যে তিনি এ বিষয়ে ব্যাপক গবেষণা চালিয়ে তার গবেষণাকর্মের ফলাফল এ বইয়ে লিপিবদ্ধ করেন।
কামালউদ্দিন ফারসি বিনা প্রশ্নে ইবনে হিশামের মতামতকেও মেনে নেননি। আলোর প্রতিফলন ও চারদিকে আলো ছড়িয়ে পড়ার তুলনামূলক পার্থক্যের বিষয়ে তিনি ইবনে হিশামের মতামতকে গ্রহণ করেননি। তিনিই ইবনের হিশামের অন্ধকার কক্ষে আলোর ব্যবহার, দুটি স্বচ্ছ গোলকে আলোর প্রতিসরণ ও প্রতিসরণকারী সূচকের টেবিলের বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদান করেন। প্রতিসরণ হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট বিমূর্ত সংখ্যা যা যেকোনো স্বচ্ছ মাধ্যমের প্রতিসরণ শক্তিকে চিহ্নিত করে।
কামালউদ্দিন ফারসি তার এ গ্রন্থে আলোর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে লিখেছেন, আলোকিত কোনো বস্তু বা পদার্থ থেকে যে আলো বের হয় তা আসলে এক ধরনের তাপ ও আগুন। কারণ অবতল আয়নার ওপর যদি সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয় তাহলে সেই আলো এক বিন্দুতে এসে জমা হবে এবং সেই বিন্দু থেকে বের হওয়া উত্তাপ কোনো বস্তুকে জ্বালিয়ে দিতে পারে।
কামালউদ্দিন ফারসির ৪০০ বছর পর হল্যান্ডের পদার্থবিজ্ঞানী ক্রিশ্চিয়ান হাইজেন্স তার এক গ্রন্থে আলোর এ ধরণের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে লিখেছেন, 'আলোর উৎপত্তি আগুন থেকে। আয়নার ওপর যদি আলো ফেলা হয় তাহলে সেই আলো একটি বিন্দুতে এসে জমা হবে এবং সেই বিন্দু থেকে এমন উজ্জ্বল আলো বের হবে যা কোনো বস্তুকে জ্বালিয়ে দিতে পারে এবং তাপ উৎপন্ন করবে। ওই বস্তুর ওপর আলোর বিন্দু ধরে রাখলে তাতে আগুন ধরে যাবে।
যাইহোক, কামালউদ্দিন ফারসি ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি নিজের মত বা দৃষ্টিভঙ্গি প্রমাণের জন্য আলোর পদার্থবিদ্যায় জ্যামিতির সূত্র ও উপপাদ্য ব্যবহার করেছেন। তার এ পদ্ধতি ছিল ওই যুগে একেবারে নতুন এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রে তা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।#
পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।