জানুয়ারি ১৩, ২০২৩ ২১:২৯ Asia/Dhaka
  • ইরাকের আবু গ্বারিব জেলখানা
    ইরাকের আবু গ্বারিব জেলখানা

এর আগে চারটি পর্বে আমরা মানবাধিকার বিষয়ে পাশ্চাত্যের দ্বিমুখী আচরণ সম্পর্কে আলোচনা করেছি। আজ শুনবেন এ সংক্রান্ত আলোচনার পঞ্চম ও শেষ পর্ব।

মানবাধিকার এমন একটি বিষয় যদি এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত না হয় তাহলে তা হবে মানব সমাজের জন্য অনেক বড় উপঢৌকন  এবং মানুষের জীবনমান উন্নয়নে তা অনেক বড় ভূমিকা রাখবে। বর্তমান বিশ্বে মানবাধিকারের কোনো অস্তিত্ব নেই এবং যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ ইউরোপের অনেক দেশ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করায় মানবাধিকারের মর্যাদা ও গুরুত্ব নড়বড়ে হয়ে গেছে। এ ছাড়া, পাশ্চাত্যের দেশগুলো শিশু হত্যাকারী হিসেবে পরিচিত স্বৈরসরকারগুলোকে সমর্থন দেয়ার পাশাপাশি বিশ্বের স্বাধীন দেশগুলোর বিরুদ্ধে মানবাধিকারকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করায় এবং এ ব্যাপারে দ্বিমুখী আচরণ করায় মানবাধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠন ও সংস্থাগুলোও দুর্বল হয়ে পড়েছে। মানবাধিকারের দাবিদার আমেরিকা ও ইউরোপ এমন সময় মানবাধিকার ইস্যুতে অন্য দেশের বিরুদ্ধে বিবৃতি দেয় যখন তারা নিজেরাই সরকার বিরোধীদের ওপর কঠোর দমন অভিযান চালায়, বৈষম্যমূলক আচরণ করে, দরিদ্রতা ও বেকারত্ব বাড়ছে এবং অস্বেতাঙ্গদের ওপর পুলিশি হত্যা ও নির্যাতন চলছে।

এসব দেশে আশ্রয়গ্রহণকারী ও অভিবাসীদের ওপর নির্যাতন চালানো হয় আইন বাস্তবায়নের অজুহাতে। পাশ্চাত্যের মানবতা বিরোধী অপরাধযজ্ঞ অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। মার্কিন যুদ্ধবাজ নীতি এবং বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে জঙ্গিদের প্রতি মার্কিনীদের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ সমর্থনের কারণে সাম্প্রতিক শতাব্দিতে লাখ লাখ মানুষ হতাহত হয়েছে যা কিনা মানবাধিকার লঙ্ঘনের অনেক বড় দৃষ্টান্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন সেনাদের হাতে আড়াই লাখ মানুষ নিহত হয়েছ। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর ১৯৫৫ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় মার্কিন সেনাদের হামলায় ৫০ লাখের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে।

ইরাক দখলের পরও মার্কিন সেনারা সেদেশের আবু গ্বারিব জেলখানায় ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছিল যা আজো বিশ্বব্যাপী মার্কিন সরকারের জন্য অনেক বড় কেলেঙ্কারি হয়ে আছে। আমেরিকায় অবস্থিত মানবাধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক বেসরকারী সংস্থা 'অ্যামেনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল' এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, মার্কিন সেনাদের বিবৃতি থেকে বোঝা যায় ২০০৩ থেকে ২০০৫ সালে আবু গ্বারিব জেলখানায় বন্দিদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হতো, তাদেরকে ঘুমাতে দেয়া হতো না এবং যৌন নির্যাতন চালানো হতো।

অ্যামেনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদক জন সিফটন এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে লিখেছেন, 'আবু গ্বারিব' জেলখানা, 'নামা আশ্রয় শিবির' নামে রাজধানী বাগদাদের বিমান বন্দরে অবস্থিত আটককেন্দ্র, মসুল বিমানবন্দর, সিরিয়ার সীমান্ত এলাকায় আল কায়েমের কাছে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে আটক ইরাকি বন্দীদের ওপর নজিরবিহীন নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছিল। আবু গ্বারিব জেল খানায় নির্যাতনের ঘটনা তদন্তে নিয়োজিত সেনা কর্মকর্তা জেনারেল অ্যান্থেনিও তাগুবা ২০০৪ সালে ওই জেলখানাগুলোতে ভয়াবহ নির্যাতনের কথা স্বীকার করেছিলেন।

২০০১ সালে কিউবার গুয়ান্টানামো বে জেলখানায়ও আটক আফগান বন্দীদের ওপর মার্কিন সেনাদের নির্যাতনের ঘটনা ফাঁস হয়ে গেলে বিশ্বব্যাপী হৈ চৈ পড়ে গিয়েছিল। কারণ কোনো বিচার আচার ছাড়াই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে বহু আফগান নাগরিককে আমেরিকা থেকে গুয়ান্টানামো বে জেল খানায় স্থানান্তর করা হয়েছিল।

আফগানিস্তানে মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপের কারণে শুধু যে যুদ্ধবিধ্বস্ত ওই দেশটিতে দরিদ্রতা বৃদ্ধি, নিরাপত্তাহীনতা বৃদ্ধি, আর্থিক দুর্নীতি, বেকারত্ব, শরণার্থী সংকট সৃষ্টি ও বহু অবকাঠামো ধ্বংস হয়েছে তাই নয় একই সাথে বহু নিরীহ মানুষ নিহত হয়েছে। ২০ বছর ধরে দখলদারিত্বের সময় মার্কিন আগ্রাসন ও অত্যাচার নির্যাতনের কারণে জনগণ এতো বেশী ক্ষুব্ধ ছিল যে মার্কিনীরা লজ্জাজনকভাবে আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল। তবে মার্কিনীরা পালিয়ে গেলেও সেখানে তাদেরই হাতে গড়া উগ্র তাকফিরি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী দায়েশ বা আইএস জঙ্গিদেরকে নিয়োজিত রেখেছে যাতে তাদের মাধ্যমে আফগানিস্তানে শিয়া ও সুন্নি জনগণের মধ্যে গোলযোগ বাধিয়ে রাখা যায় এবং ওই দেশটি যাতে আর কখনোই সোজা হয়ে দাড়াতে না পারে।

এ ছাড়া, মার্কিন সেনারা সন্ত্রাসবাদ দমনের অজুহাতে ৮০টির বেশি দেশে সামরিক হস্তক্ষেপ করেছে। ২০১৮ সালে ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপের বিষয়ে তথ্য সম্বলিত বিস্তারিত একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছিল। সাংবাদিকদের সাক্ষাতকার, বিভিন্ন দেশে দায়িত্ব পালনকারী মার্কিন কূটনীতিবিদ ও রাষ্ট্রদূতগণ, সামরিক কর্মকর্তা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাক্ষাতকারের ভিত্তিতে ওই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছিল। এতে দেখা গেছে কেবল সন্ত্রাসবাদ দমনের মিথ্যা অজুহাতে বহু দেশে মার্কিন সেনারা সামরিক উপস্থিতি বাড়িয়েছে। সামরিক হস্তক্ষেপ করতে গিয়ে ইরাক ও আফগানিস্তানে নারী ও শিশু হত্যা, ওই অঞ্চলে নিরাপত্তাহীনতা ছড়িয়ে দেয়া, আল কায়দা ও আইএস জঙ্গিদের মতো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে সমর্থন দান, ইরান বিরোধী সন্ত্রাসী মোনাফেকিন গোষ্ঠীকে পৃষ্ঠপোষকতা করা, ইরানের যাত্রীবাহী বিমান ভূপাতিত করা, গণহত্যা চালানোর জন্য সাদ্দামকে রাসায়নিক অস্ত্র যোগানো প্রভৃতি ঘটনা আমেরিকার মানবতা বিরোধী কর্মকাণ্ডের কিছু দৃষ্টান্ত মাত্র। 

মানবতার সত্যিকারের শত্রুরা তাদের কাজেকর্মে এটা দেখিয়ে দিয়েছে যে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য তারা যে কোনো অন্যায় অপরাধ করতে দ্বিধাবোধ করে না। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে আন্তর্জাতিক সমাজ আশা করে মানবাধিকার রক্ষার দায়িত্বশীল সংস্থা বা সংগঠনগুলো আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবে। কারণ নীরবতার অর্থ হবে পাশ্চাত্যের পক্ষ থেকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাকে বৈধতা দেয়া।

গত শতাব্দির দ্বিতীয়ার্ধে মার্কিন সরকার বিভিন্ন দেশের সরকার পরিবর্তনের জন্য প্রায় ১০০টি অভ্যুত্থান পরিকল্পনা করেছে। আবার অনেক দেশে তারা সরাসরি সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে সরকার পরিবর্তন করেছে কিংবা সামরিক হস্তক্ষেপের হুমকি দিয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন সরকার তাদের অধীনস্থ দেশগুলোতে এভাবে হস্তক্ষেপ করেছে অথবা বলপূর্বক অনুগত সরকার বসিয়েছে। আমেরিকা সরাসরি অভিযান চালিয়েও বহু মানুষ হত্যা করেছে। উদাহরণ স্বরূপ জাপানে পরমাণু বোমা হামলা, ইরাক ও আফগানিস্তানে হামলা, দখলদার ইসরাইলকে সমর্থন এবং ইয়েমেন নারী ও শিশু হত্যাকারী সৌদি আরবকে অস্ত্র যুগানোর কথা উল্লেখ করা যায়। এসবই মানবাধিকার লঙ্ঘনের অনেক বড় দৃষ্টান্ত।#

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ