মার্চ ২৮, ২০২৩ ১৪:৫২ Asia/Dhaka

গত পর্বের আলোচনা অনুষ্ঠানে আমরা ইরানের খ্যাতনামা মনীষী কুতুবুদ্দীন শিরাজির জীবন ও কর্মের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করেছি। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা ইরানের আরেকজন বিখ্যাত মনীষী গিয়াসউদ্দিন জামশিদ কাশানির জীবনী ও তার গবেষণাকর্মের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করবো।

গিয়াসউদ্দিন জামশিদ কাশানির জন্ম হয়েছিল হিজরি ৭৯০ সালে তথা খ্রিস্টিয় ১৩৮৮ সনে মধ্য-ইরানের কাশান অঞ্চলে। গিয়াসউদ্দিন তার উপাধি। তার বাবা ছিলেন একজন চিকিৎসক এবং তার নাম ছিল মাসউদ।  জামশিদ কাশানির দাদা ও পরদাদার নাম ছিল যথাক্রমে মাহমুদ ও মুহাম্মাদ।

জামশিদ কাশানির জীবন সম্পর্কে যা কিছু জানা যায় তার বেশিরভাগেরই উৎস হল জ্ঞান-বিজ্ঞান বিষয়ে এই মনীষীর নিজের লেখা বই-পুস্তক এবং নিজের বাবা ও কাশানের জনগণের উদ্দেশে লেখা তার দু'টি চিঠি।  কাশানির শৈশব, কৈশর ও যৌবন কেটেছে এমন একটা সময়ে যখন ইরানে চলছিল তৈমুর লং-এর নৃশংস ও ধ্বংসাত্মক নানা সামরিক অভিযান। এমন দুঃসময়েও জামশিদ কাশানি জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে মোটেও পিছপা হননি। তিনি কোথায় ও কোন্ কোন্ অঞ্চলে পড়াশুনা করেছিলেন এবং কারা ছিলেন তার শিক্ষক সে বিষয়ে খুব বেশি কিছু জানা যায় না। মনে করা হয় যে জামশিদ কাশানি ইরানের মধ্যাঞ্চলে অবস্থিত শহরগুলোতে এবং বিশেষ করে ফার্স প্রদেশে ও কাশান অঞ্চলে পড়াশুনা করেছেন।

জামশিদ কাশানির বাবা যদিও চিকিৎসক ছিলেন, তবে অন্য অনেক বিষয়েও হয়তো পাণ্ডিত্য তার ছিল। যেমন,  বাবার কাছে জামশিদ কাশানির লেখা একটি চিঠি থেকে জানা যায় তার বাবা খাজা নাসিরউদ্দিনের লেখা 'মেইয়ার আল আশআর' বা 'কবিতার বিধান' শীর্ষক বইটির ব্যাখ্যা লিখে তা ছেলের কাছে পাঠানোর পরিকল্পনা করেছিলেন। হিজরি ৮০৮ সনের ১২ জিলহজ তথা ১৪০৬ খ্রিস্টাব্দের ২ জুলাই কাশানে চন্দ্রগ্রহণ পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে বর্ণনা দিয়েছেন জামশিদ কাশানি। এটাই ছিল তার প্রথম বৈজ্ঞানিক তৎপরতা। গিয়াসউদ্দিন জামশিদ কাশানির প্রথম বইয়ের নাম 'রিসালাতু সুল্লাম আসসামাআ' অর্থাৎ 'আকাশের সিঁড়ি সম্পর্কিত পুস্তক'। আরবিতে লেখা এ বইটির রচনার সাল ৮০৯ হিজরি বা ১৪০৭ খ্রিস্টাব্দ।  তৈমুর লংয়ের মৃত্যুর দু্ই বছর পরে তার সৃষ্ট অশান্তিও যখন থেমে যায় তখন এ বইটি লিখেছিলেন জামশিদ কাশানি। এরপর ২৩ বছর বয়সে যখন তিনি কাশানে ছিলেন তখন জামশিদ কাশানি মহাকাশ-বিদ্যা বিষয়ে ফার্সি ভাষায় একটি ছোটো বই লেখেন।

সে যুগে শাসকদের সহায়তা ছাড়া বৈজ্ঞানিক তৎপরতা চালানো ছিল খুবই কঠিন বা প্রায় অসম্ভব। জামশিদ কাশানি ৮১৬ হিজরিতে লিখেছিলেন 'জিজে খাক্বানি' নামের একটি ফার্সি বই। মহাকাশ-বিদ্যা সম্পর্কিত এ বইটি তিনি উপহার দেন তৈমুর লংয়ের নাতি তথা শাহরুখের ছেলে উলুগ বেগকে। উলুগ বেগ সে সময় থাকতেন সমরকন্দে। জিজে খাকানি নামের এ বইটি উলুগ বেগের সাহায্য ছাড়া লেখা সম্ভব হত না বলে বইটির মধ্যেই উল্লেখ করেন কাশানি। উলুগ বেগের সহায়তায় বৈজ্ঞানিক গবেষণার কাজ অব্যাহত রাখতে পারবেন বলেও জামশিদ কাশানি আশা প্রকাশ করেন।

কাশানির যুগে জ্ঞানী-গুণি ও গবেষকদের গবেষণার আকর্ষণীয় বিষয় ছিল গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যা। সে যুগে এ দুই বিষয়ে লেখা হয়েছিল অনেক বই যা এখনও টিকে আছে।  তৈমুরের বংশধররা, বিশেষ করে উলুগ বেগ জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় উৎসাহী ছিলেন এবং তারা এ কাজে গবেষকদের সহায়তা দিতেন।

ইরানের এক বিদ্যান নারী গওহরশাদের পুত্র উলুগ বেগ নিজেও গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যায় পারদর্শি ছিলেন। বাবার শাসনামলেই তিনি ট্রান্স-অক্সিয়ানার প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন। পরে তিনি এই অঞ্চলের স্বাধীন শাসক বা সম্রাট হন এবং ৮৫০ হিজরি পর্যন্ত এ অঞ্চল শাসন করেন।

ট্রান্স-অক্সিয়ানা অঞ্চল বলতে বর্তমান যুগের উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, কিরঘিজিস্তান, দক্ষিণ কাজাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের বেশিরভাগ এলাকাকেই বোঝায়। উলুগ বেগের শাসনাধীন অঞ্চলের রাজধানী ছিল সমরকন্দ। বিজ্ঞান-চর্চায় উৎসাহী বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও সম্রাট উলুগ বেগ সমরকন্দে মহাকাশ-পর্যবেক্ষণ ও বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার কাজে সহায়তার জন্য যেসব বিজ্ঞানীদের সাহায্য চেয়েছিলেন জামশিদ কাশানিও ছিলেন তাদের অন্যতম। কারণ, অসাধারণ বিজ্ঞানী জামশিদ কাশানি ছিলেন একাধারে পদার্থ-বিজ্ঞানী, গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিদ।  এর  আগে তিনি কখনও তার বৈজ্ঞানিক দক্ষতা ও যোগ্যতা প্রমাণের এতো বড় সুযোগ পাননি। 

জামশিদ কাশানি জ্যোতির্বিদ্যা বা মহাকাশ-বিদ্যা সম্পর্কিত তার বই 'জিজে খক্বানি'র নামকরণ করেছিলেন উলুগ বেগের বাবা শাহরুখ তৈমুরির নামের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে। শাহরুখ তৈমুরির উপাধি ছিল খ'ক্বান। বইটি তিনি উপহার দেন শাহরুখের পুত্র উলুগ বেগকে। অনেকেই বলেন যে, এ বইয়ের কারণেই উলুগ বেগ গিয়াসউদ্দিন জামশিদ কাশানিকে সমরকন্দে আসার দাওয়াত দিয়েছিলেন। আবার কেউ কেউ বলেন, উলুগ বেগ, কাজিজাদেহ রুমির মাধ্যমে জামশিদ কাশানি সম্পর্কে জানতে পারেন এবং এ কারণেই তাকে অত্যন্ত মর্যাদা দিয়ে সমরকন্দে আসার আমন্ত্রণ জানান। কাজিজাদেহ নিজেও ছিলেন একজন গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিদ।  এ সম্পর্কিত এক বর্ণনায় এসেছে, কাজিজাদেহ ছিলেন রুমের একজন বিজ্ঞানী। রুম অঞ্চলটি ছিল বর্তমান তুরস্কে। কাজিজাদেহ রুমি ট্রান্স-অক্সিয়ানা অঞ্চলের শাসক মির্জা উলুগ বেগ তৈমুরির সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য ইরাক থেকে সমরকন্দে যান। পথে তিনি কাশানে অবস্থান করেন কিছু সময়ের জন্য। একদিন তিনি ফার্সিভাষী কোনো গণিতবিদের সন্ধানে কাশানের বাজার এবং অলি-গলিতে ঘুরছিলেন। সেখানে তিনি ঘটনাক্রমে গিয়াসউদ্দিন জামশিদ কাশানির সঙ্গে পরিচিত হন। #

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/২৮

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।