কুরআনের আলো
সূরা আন-নাজম: আয়াত ১৯-৩০ (পর্ব-২)
পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠান কুরআনের আলোর এ পর্বে সূরা আন নাজম-এর ১৮ থেকে ৩০ নম্বর আয়াতের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। এই সূরার ১৯ থেকে ২৩ নম্বর পর্যন্ত আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
(19) وَمَنَاةَ الثَّالِثَةَ الْأُخْرَى (20) أَلَكُمُ الذَّكَرُ وَلَهُ الْأُنْثَى (21) تِلْكَ إِذًا قِسْمَةٌ ضِيزَى (22) إِنْ هِيَ إِلَّا أَسْمَاءٌ سَمَّيْتُمُوهَا أَنْتُمْ وَآَبَاؤُكُمْ مَا أَنْزَلَ اللَّهُ بِهَا مِن سُلْطَانٍ إِنْ يَتَّبِعُونَ إِلَّا الظَّنَّ وَمَ تَهْوَى الْأَنْفُسُ وَلَقَدْ جَاءَهُمْ مِنْ رَبِّهِمُ الْهُدَى (23) أَمْ لِلْإِنْسَانِ مَا تَمَنَّى.
“তোমরা কি লাত ও উজ্জা [মূর্তিগুলো] দেখেছো?” (৫৩:১৯)
“এবং তৃতীয় আরেকটি মূর্তি মানাত?” (৫৩:২০)
“তবে কি তোমাদের জন্য পুত্ৰ সন্তান [নির্ধারিত] এবং আল্লাহর জন্য কন্যা সন্তান [যা তোমরা নিজেদের জন্য চাও না)?” (৫৩:২১)
“তাহলে এটাতো খুবই অন্যায় ভাগ-বাঁটোয়ারা।” (৫৩:২২)
“এই মূর্তিগুলো কিছু নাম মাত্র যা তোমরা ও তোমাদের পূর্বপুরুষরা রেখেছ, [যাদের সমর্থনে] আল্লাহ্ কোন দলীল-প্রমাণ নাযিল করেননি। [মুশরিকরা] তো কেবল অনুমান এবং নিজেদের প্রবৃত্তিরই অনুসরণ করে, অথচ তাদের কাছে তাদের রবের পক্ষ থেকে হেদায়াত এসেছে।” (৫৩:২৩)
এই আয়াতগুলোতে মক্কার মূর্তিপূজকদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। বলা হচ্ছে: তোমরা একদিকে এসব মূর্তিকে ফেরেশতা-তুল্য মনে করে তাদের পূজা করছ এবং অন্যদিকে ফেরেশতাদেরকে মনে করছো আল্লাহর কন্যা। অথচ প্রথমত, আল্লাহর কোনো সন্তান নেই, দ্বিতীয়ত, ফেরেশতারা আল্লাহর সন্তান নয়; এবং তৃতীয়ত, ফেরেশতাদের মধ্যে মানুষের মতো নারী-পুরুষ ভেদাভেদ নেই।
পক্ষান্তরে তোমরা নিজেদের কন্যা সন্তান হলে সেটিকে লজ্জা ও কলঙ্কজনক মনে করছ এমনকি কন্যা সন্তানকে জীবিত কবর দিতেও কুণ্ঠাবোধ করছো না। এমতাবস্থায় তোমরা ফেরেশতাদেরকে কীভাবে আল্লাহর কন্যা মনে করছো? তোমাদের কাছে কি এর পক্ষে কোনো প্রমাণ আছে? নাকি তোমরা কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছো অর্থাৎ তোমাদের পূর্বপুরুষরা এ কাজ করেছে বলেই তোমরাও তা বিনাবাক্য ব্যয়ে মেনে নিয়েছো? তোমরা যদি সত্যিকার অর্থে আল্লাহর খোঁজ পেতে চাও তাহলে তিনি তোমাদের কাছে সর্বশেষ নবীকে কিতাবসহ পাঠিয়েছেন। তোমরা যদি তাঁকে অনুসরণ করো তাহলে সঠিক পথের দিশা পাবে।
এই আয়াতগুলোর কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:
১- মক্কার মুশরিকরা আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখলেও তাঁর উপাসনা করতে গিয়ে কুসংস্কারে জড়িয়ে পড়ে এবং পাথরের তৈরি মূর্তিগুলোকে আল্লাহর কন্যা মনে করে তাদের উপাসনা শুরু করে দেয়।
২- ভ্রান্ত বিশ্বাসগুলোর প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়ার জন্য তাদের যুক্তি দিয়েই তাদেরকে ঘায়েল করা যায়। মুশরিকরা যখন নিজেদের জন্য কন্যা সন্তানকে কলঙ্ক মনে করে তখন তারাই কীভাবে আল্লাহর জন্য কন্যা সন্তান নিধারণ করে?
৩- ছেলে ও মেয়ের মধ্যে বৈষম্য করা কিংবা তাদের যেকোনো একজনকে অপরের চেয়ে ভালো মনে করা অন্যায় ও জুলুম।
এবারে সূরা নাজমের ২৪ থেকে ২৬ নম্বর পর্যন্ত আয়াতে বলা হয়েছে:
(24) فَلِلَّهِ الْآَخِرَةُ وَالْأُولَى (25) وَكَمْ مِنْ مَلَكٍ فِي السَّمَاوَاتِ لَا تُغْنِي شَفَاعَتُهُمْ شَيْئًا إِلَّا مِنْ بَعْدِ أَنْ يَأْذَنَ اللَّهُ لِمَنْ يَشَاءُ وَيَرْضَى (26) إِنَّ الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِالْآَخِرَةِ لَيُسَمُّونَ الْمَلَائِكَةَ تَسْمِيَةَ الْأُنْثَى
“মানুষ যা চায় তাই কি সে পায়?” (৫৩:২৪)
“বস্তুত আল্লাহই পরকাল আর ইহকালের মালিক।” (৫৩:২৫)
“আর আকাশে কতই না ফেরেশতা আছে [কিন্তু] তাদের সুপারিশ কোনই কাজে আসবে না, তবে [কাজে আসবে] যদি তিনি অনুমতি দেন যার জন্য আল্লাহ ইচ্ছে করবেন এবং যার প্রতি তিনি সন্তুষ্ট। ” (৫৩:২৬)
এই আয়াতগুলোতে বলা হচ্ছে, মুশরিকরা ফেরেশতাদের শাফায়াত বা সুপারিশ পাওয়ার আশায় তাদের উপাসনা করত। অথচ তাদের আরো বহু কল্পিত ও ভিত্তিহীন আকাঙ্ক্ষার মতো এই আশাটিও কোনোদিন বাস্তবায়িত হবে না। কারণ, ইহকাল ও পরকালের সবকিছু একমাত্র আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছায় পরিচালিত হয়; মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী নয়।
নিঃসন্দেহে মানুষ আশা নিয়ে বেঁচে থাকে এবং আশা হচ্ছে তার চেষ্টা-প্রচেষ্টা এবং উন্নতি-অগ্রগতির অনুপ্রেরণাদায়ক শক্তি। যদি আশা না থাকত তাহলে মানুষ কোনো কাজ করতে পারত না এবং পৃথিবীর সকল ক্রিয়াকলাপ স্থবির হয়ে পড়ত। অবশ্য মানুষকে তার যোগ্যতা, প্রতিভা, পরিবেশ-পারিপার্শ্বিকতা অনুযায়ী আশা করতে হবে। মানুষের এমন কোনো আশা করা উচিত নয় যা তার পক্ষে করা সম্ভব নয়। যদি কেউ সেরকম আশা করে তবে তাকে হতাশ হতে হবে। এই আয়াতগুলোতে ভিত্তিহীন ও কাল্পনিক আশা করা থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। যে আশা কোনো যুক্তি, বুদ্ধি বা ঐশী বাণীর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় সে আশা করা যাবে না। কারণ, এরকম আশা কখনও বাস্তবায়িত হয় না। আর এ ধরনের আশা পরিত্যাগ না করা পর্যন্ত মানুষ নিজের ও সমাজের উন্নতি করতে সক্ষম হয় না।
এই তিন আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:
১- বুদ্ধিবৃত্তি ও ঐশী বাণীর প্রতি ভ্রুক্ষেপহীনতা এবং কল্পনার জগতে গা ভাসিয়ে দিয়ে অসার আশায় বুক বাধার কারণে মানুষ ইহকাল ও পরকালে আল্লাহ তায়ালার দয়া ও অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হয়।
২- আমাদেরকে আমাদের চাওয়া-পাওয়াগুলোকে আল্লাহ তায়ালার পছন্দ-অপছন্দ অনুযায়ী ঢেলে সাজাতে হবে। তাহলেই তা থেকে কাঙ্ক্ষিত সুফল পাওয়া যাবে। আমরা যেন আমাদের আকাঙ্ক্ষাগুলো মেনে নিতে আল্লাহকে বাধ্য করতে না যাই।
৩- আল্লাহ তায়ালার ঘনিষ্ঠ ফেরেশতারা যদি তাঁর ইচ্ছা ছাড়া কারো জন্য সুপারিশ করার অধিকার না রাখে তাহলে নিষ্প্রাণ মূর্তির কাছ থেকে মানুষ কীভাবে সুপারিশ পাওয়ার আশা করে? (তাওয়াশিহ)
এবারে এই সূরার ২৭ থেকে ৩০ নম্বর পর্যন্ত আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন:
(27) وَمَا لَهُمْ بِهِ مِنْ عِلْمٍ إِنْ يَتَّبِعُونَ إِلَّا الظَّنَّ وَإِنَّ الظَّنَّ لَا يُغْنِي مِنَ الْحَقِّ شَيْئًا (28) فَأَعْرِضْ عَنْ مَنْ تَوَلَّى عَنْ ذِكْرِنَا وَلَمْ يُرِدْ إِلَّا الْحَيَاةَ الدُّنْيَا (29) ذَلِكَ مَبْلَغُهُمْ مِنَ الْعِلْمِ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنْ ضَلَّ عَنْ سَبِيلِهِ وَهُوَ أَعْلَمُ بِمَنِ اهْتَدَى (30) وَلِلَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ لِيَجْزِيَ الَّذِينَ أَسَاءُوا بِمَا عَمِلُوا وَيَجْزِيَ الَّذِينَ أَحْسَنُوا بِالْحُسْنَى
“যারা পরকালে বিশ্বাস করে না, তারাই ফিরিশতাদেরকে নারী-বাচক নাম দিয়ে থাকে।” (৫৩:২৭)
“অথচ [এ বিষয়ে] তাদের কোন জ্ঞান নেই, তারা শুধু অনুমানের অনুসরণ করে। আর সত্যের মুকাবিলায় অনুমানের কোনই মূল্য নেই।” (৫৩:২৮)
“অতএব যে আমার স্মরণে বিমুখ এবং যে শুধু পার্থিব জীবনই কামনা করে তাকে এড়িয়ে চলুন।” (৫৩:২৯)
“এটাই তাদের জ্ঞানের শেষ সীমা। নিশ্চয় আপনার রব, তিনিই ভাল জানেন কারা তার পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে এবং তিনিই ভাল জানেন কারা হেদায়াতপ্ৰাপ্ত। (৫৩:৩০)
আমরা এর আগেও বলেছি, মক্কার মুশরিকরা আল্লাহ তায়ালাকে বিশ্বজগতের স্রষ্টা বলে জানত কিন্তু কিয়ামত দিবস এবং সেখানকার পুরস্কার ও শাস্তির প্রতি তাদের কোনো বিশ্বাস ছিল না। এ কারণে এই আয়াতগুলোতে বলা হচ্ছে: যারা আল্লাহর নামে এসব কুসংস্কার চাপিয়ে দেয় এবং এই ভ্রান্ত বিশ্বাসের ভিত্তিতে মূর্তিপূজা করে তারা পরকালে বিশ্বাস করে না এবং নিজেদের কৃতকর্মের পরিণতির ব্যাপারেও তারা সম্পূর্ণ উদাসীন। পরের আয়াতে মানবসমাজের একটি ক্ষতির প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হচ্ছে: সৃষ্টি ও পরকাল সম্পর্কে বহু মানুষের বিশ্বাস তাদের ধারণাপ্রসূত। অথচ তাদের উচিত ছিল বিষয়গুলো সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানা এবং জেনেবুঝে এসব বিষয়ে ঈমানি চেতনা ঠিক করা। স্বাভাবিকভাবে যারা বিশ্বের সৃষ্টি সম্পর্কে জানতে চান তারা নবী-রাসূলদের কাছে ছুটে যান এবং তাদের দেখানো পথে চলতে শুরু করেন। পক্ষান্তরে যারা এ পথে চলে না তারা পার্থিব জীবনের সম্পদ ও ভোগবিলাস ছাড়া আর কিছু বোঝে না।
এই আয়াতগুলোর শিক্ষণীয় কয়েকটি বিষয় হচ্ছে:
১-পার্থিব জীবনের অন্য দশটি বিষয়ে অনুমান নির্ভরতায় তেমন কোনো ক্ষতি নাও হতে পারে কিন্তু ধর্মীয় বিশ্বাসের ক্ষেত্রে অনুমাননির্ভরতা মানুষকে অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন করতে পারে। কারণ, পার্থিব জীবন একটিই; মৃত্যুর পর সবকিছু দেখে আরেকবার এই পৃথিবীতে ফিরে আসা সম্ভব নয়।
২- মানুষকে দ্বীনের দাওয়াত দেয়ার ক্ষেত্রে আগে তাদের কাছে যাওয়া উচিত যারা সত্যপীপাসু। কিন্তু যারা আল্লাহ বিমুখ এবং যাতে সত্য উপলব্ধি করতে না হয় এজন্য চোখ ও কান বন্ধ করে রেখেছে তাদের কাছে দাওয়াতে বাণী নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।
৩- পার্থিব জগতের ভোগবিলাসে লিপ্ত হওয়া আল্লাহকে ভুলে যাওয়ার অন্যতম বড় কারণ। অবশ্য স্বাভাবিকভাবে পৃথিবীতে জীবনযাপন করা আল্লাহর দৃষ্টিতে পছন্দনীয় কাজ। কিন্তু পৃথিবীর প্রতি অতিরিক্ত আকর্ষণ ও অপ্রচলিতভাবে ভোগবিলাসে মত্ত হয়ে পড়া মানুষের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
তো শ্রোতাবন্ধুরা! এরইসঙ্গে শেষ করছি কুরআনের আলোর আজকের আয়োজন। মহান আল্লাহ এ আলোচনা থেকে আমাদের সবাইকে শিক্ষা গ্রহণ করার তৌফিক দান করুন।#
পার্সটুডে/এমএমআই/এমবিএ/২৮
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।