কুরআনের আলো
সূরা ক্বামার: আয়াত ৯-২২ (পর্ব-২)
শ্রোতাবন্ধুরা, সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। গত আসরে আমরা সূরা কামারের ৮ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের আলোচনা শুনেছিলাম। আজ আমরা এই সূরার ৯ থেকে ২২ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের সংক্ষিপ্ত তাফসির উপস্থাপনের চেষ্টা করব। প্রথমেই ৯ থেকে ১২ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
(9) فَدَعَا رَبَّهُ أَنِّي مَغْلُوبٌ فَانْتَصِرْ (10) فَفَتَحْنَا أَبْوَابَ السَّمَاءِ بِمَاءٍ مُنْهَمِرٍ (11) وَفَجَّرْنَا الْأَرْضَ عُيُونًا فَالْتَقَى الْمَاءُ عَلَى أَمْرٍ قَدْ قُدِرَ (12) وَحَمَلْنَاهُ عَلَى ذَاتِ أَلْوَاحٍ وَدُسُرٍ
"এদের আগে নূহের সম্প্রদায়ও [আমার আয়াতসমূহের প্রতি] মিথ্যারোপ করেছিল এবং আমার বান্দা [নূহকে] অস্বীকার করেছিল আর বলেছিল, সে পাগল আর তাকে [নানা ধরনের নির্যাতন ও হুমকির মাধ্যমে রিসালাতের দায়িত্ব পালন] থেকে বিরত রাখা হয়েছিল।”(৫৪:৯)
“সুতরাং নূহ তাঁর প্রতিপালকের কাছে [এভাবে] আবেদন জানাল: [হে আমার রব!] আমি পরাজিত হয়েছি, সুতরাং আমাকে সাহায্য করো!”(৫৪:১০)
“ফলে আমি উন্মুক্ত করে দিলাম আকাশের দ্বারসমূহ প্রবল বর্ষণশীল বারিধারার মাধ্যমে।”(৫৪:১১)
“আর আমি ভূমিতে ঝর্না উৎসারিত করলাম। ফলে [আসমান ও জমিনের] সকল পানি মিলিত হল নির্ধারিত নির্দেশনা অনুসারে।”( ৫৪:১২)
আগের আসরে কিয়ামতের দিন কাফিরদের ভয়াবহ পরিণতির কথা উল্লেখ করার পর এই তিন আয়াতে পার্থিব জগতেই তাদের পরিণতির প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হচ্ছে: অন্যান্য নবীর মতো হযরত নূহ (আ.)ও তার জাতিকে আল্লাহর একত্ববাদের প্রতি আহ্বান জানান এবং তাদেরকে কিছু অলৌকিক নিদর্শন দেখান। কিন্তু তার জাতি কোনো অবস্থাতেই সত্য গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিল না। তারা আল্লাহর নবীকে পাগল অভিহিত করে বলল: তার ঘাড়ে জিন চেপেছে এবং সে তার বোধশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। তারা হযরত নূহকে পাথর মেরে হত্যা করার হুমকি দেয়। তারা নানা ধরনের অত্যাচার, নির্যাতন ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার মাধ্যমে আল্লাহর নবীকে দাওয়াতের বাণী প্রচার থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করে। এ অবস্থায় হযরত নূহ (আ.) কাফিরদের মোকাবিলায় আল্লাহর সাহায্য কামনা করেন। আগেই আল্লাহর পক্ষ থেকে সব ধরনের সতর্কবাণী আসা সত্ত্বেও তারা তা গ্রহণ না করায় এবার আল্লাহ তায়ালা তাদের প্রতি আজাবের দরজা খুলে দেন। ভয়ঙ্কর প্লাবনে সব কাফের ধ্বংস হয়ে যায়।
এই তিন আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:
১- যুগে যুগে সব নবীকে কাফিররা পাগল বলে আখ্যায়িত করেছে। তারা এই অপবাদ প্রয়োগের মাধ্যমে নবীদেরকে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছে।
২- ঈমানদারদেরকে তাদের দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে এবং শত্রুর মোকাবিলায় পরাজিত হলে হতাশ হওয়া যাবে না। কারণ, আল্লাহর শক্তি বিশ্বের সকল শক্তির ঊর্ধ্বে।
৩- বৃষ্টির পানি আল্লাহর রহমতের নিদর্শন হলেও এই বৃষ্টি কখনও কখনও আল্লাহর গজবের উপকরণেও পরিণত হয়।
এবারে এই সূরার ১৩ থেকে ১৭ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
(13) تَجْرِي بِأَعْيُنِنَا جَزَاءً لِمَنْ كَانَ كُفِرَ (14) وَلَقَدْ تَرَكْنَاهَا آَيَةً فَهَلْ مِنْ مُدَّكِرٍ (15) فَكَيْفَ كَانَ عَذَابِي وَنُذُرِ (16) وَلَقَدْ يَسَّرْنَا الْقُرْآَنَ لِلذِّكْرِ فَهَلْ مِنْ مُدَّكِرٍ (17) كَذَّبَتْ عَادٌ فَكَيْفَ كَانَ عَذَابِي وَنُذُرِ
“আর আমি তাকে (অর্থাৎ নূহকে) কাঠ ও পেরেক নির্মিত [জাহাজে] আরোহণ করালাম।” ”( ৫৪:১৩)
“জাহাজটি আমার তত্ত্বাবধানে ভেসে চলল। [এটি ছিল] সেই নবীর জন্য পুরস্কার যাকে অমান্য ও অস্বীকার করা হয়েছিল।””
( ৫৪:১৪)
“আমি এটাকে [অর্থাৎ জাহাজটিকে] এক নিদর্শনরূপে রেখে দিয়েছি; অতএব উপদেশ গ্রহণকারী কেউ আছে কি?””
( ৫৪:১৫)
“সুতরাং কেমন ছিল আমার শাস্তি ও সতর্কবাণী!””( ৫৪:১৬)
“এবং নিশ্চয় আমি কুরআনকে উপদেশ গ্রহণের জন্য সহজ [ও বোধগম্য] করে দিয়েছি। অতএব উপদেশ গ্রহণকারী কেউ আছে কি?”( ৫৪:১৭)
নূহের জাতির প্রতি আজাব পাঠানোর আগে আল্লাহ তায়ালা তাকে একটি বিশাল জাহাজ নির্মাণের আদেশ করেন। কোনো প্রাণী যাতে বিলুপ্ত হয়ে না যায় সেজন্য সব প্রাণীকে জোড়ায় জোড়ায় জাহাজে ওঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। এখান থেকেই বোঝা গিয়েছিল যে, ভয়াবহ এক প্লাবন অত্যাসন্ন। তা না হলে এমন নির্দেশ আল্লাহ তায়ালা দিতেন না।
প্লাবন শুরু হওয়ার পর আল্লাহর নির্দেশে হযরত নূহের জাহাজ চলতে শুরু করে এবং তাতে আরোহণকারী ঈমানদারগণ প্রাণে রক্ষা পান। অন্যদিকে সকল কাফির বেঘোরে প্রাণ হারায়। এরপর প্লাবন থেমে গেলে জাহাজের আরোহীরা নির্বিঘ্নে নীচে নেমে আসেন। কিন্তু সেই কাঠ ও লোহার পেরেক দিয়ে তৈরি জাহাজটি আল্লাহর ইচ্ছায় অবশিষ্ট থেকে যায় কাফিরদের একথা বোঝানোর জন্য যে, নবী-রাসূলদের সতর্কবাণী অস্বীকার করলে আল্লাহর আজাবের শিকার হতে হবে।
পরে আয়াতে পবিত্র কুরআনের সহজবোধ্যতার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। কুরআনের ভাষারীতি এমন যে, তা তেলাওয়াত করা সহজ ও শ্রুতিমধুর। এই মহাগ্রন্থের বিষয়বস্তু এমনভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে, তা উপলব্ধি করা যেকোনো মানুষের জন্যই সহজ। তবে এই সহজ বিষয়বস্তুর মর্মবাণী অত্যন্ত সুদৃঢ় ও কঠিন। এত সহজ হওয়া সত্ত্বেও গোটা জগতবাসী একত্রিত হয়ে চেষ্টা করলেও এই কুরআনের আয়াতের মতো একটি আয়াতও কারো পক্ষে রচনা করা সম্ভব নয়।
এই পাঁচ আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:
১- আল্লাহ তায়ালা চাইলে কাঠের তৈরি জাহাজকেও ভয়াবহ প্লাবন থেকে রক্ষা করতে পারেন।
২- যারা নবী-রাসূলদের অস্বীকার করবে পার্থিব জগত ও আখিরাতে তাদেরকে কঠিন আজাবের মুখোমুখি হতে হবে।
৩- ফেরাউনের দেহ যেমন নীল নদ থেকে তুলে সংরক্ষণ করা হয়েছে তেমনি হযরত নূহের জাহাজও মানুষের শিক্ষা গ্রহণের লক্ষ্যে রক্ষা করা হয়েছে। (তাওয়াশিহ)
এবারে সূরা কামারের ১৮ থেকে ২২ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
(18) إِنَّا أَرْسَلْنَا عَلَيْهِمْ رِيحًا صَرْصَرًا فِي يَوْمِ نَحْسٍ مُسْتَمِرٍّ (19) تَنْزِعُ النَّاسَ كَأَنَّهُمْ أَعْجَازُ نَخْلٍ مُنْقَعِرٍ (20) فَكَيْفَ كَانَ عَذَابِي وَنُذُرِ (21) وَلَقَدْ يَسَّرْنَا الْقُرْآَنَ لِلذِّكْرِ فَهَلْ مِنْ مُدَّكِرٍ (22) كَذَّبَتْ ثَمُودُ بِالنُّذُرِ
“আদ সম্প্রদায় [তাদের নবীকে] প্রত্যাখ্যান করেছিল, ফলে কি কঠোর হয়েছিল আমার শাস্তি ও সতর্ক বাণী!” ( ৫৪:১৮)
“নিশ্চয় আমি তাদের উপর এক নিরবচ্ছিন্ন অমঙ্গল দিনে পাঠিয়েছিলাম এক প্রচণ্ড শীতল ঝড়োহাওয়া।”( ৫৪:১৯)
“[সেই ঘুর্ণিঝড় সুঠামদেহের অধিকারি আদ জাতির] মানুষকে উৎপাটিত খেজুর গাছের কাণ্ডের ন্যায় উৎপাটন করেছিল। ”( ৫৪:২০)
“সুতরাং কেমন ছিল আমার শাস্তি ও সতর্কবাণী!”( ৫৪:২১)
“আর অবশ্যই আমি কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি উপদেশ গ্রহণের জন্য; অতএব উপদেশ গ্ৰহণকারী কেউ আছে কি?”( ৫৪:২২)
হযরত নূহের ঘটনা বর্ণনা করার পর এই আয়াতগুলোতে আদ জাতির পরিণতির কথা বলা হয়েছে। আল্লাহর নবী আদ জাতিকে তাদের অপকর্ম সম্পর্কে যতই সতর্ক করুক না কেন তারা তাকে অপমান করতে থাকে এবং নিজেদের সুঠাম দেহ নিয়ে অহংকার প্রদর্শন করে। তারা কখনও কল্পনাও করতে পারেনি একদিন এক ঘুর্নিঝড় এসে তাদের এই সুঠাম দেহগুলোকে খেজুর গাছের কাণ্ডের মতো যত্রযত্র আছড়ে ফেলে রাখবে। ওই ভয়াবহ ঝড় এক সপ্তাহ ধরে বইতে থাকে এবং এর ফলে একজন কাফিরও প্রাণে রক্ষা পায়নি। এরপর আল্লাহ তায়ালা আবার মানুষকে বলছেন, তারা কেন অতীত জাতিগুলোর পরিণতি থেকে শিক্ষা নেয় না?
এই আয়াতগুলোর শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে:
১- আল্লাহ তায়ালা নবী-রাসূল পাঠিয়ে মানুষকে বারবার সতর্ক করে দেন। এরপরও যারা সতর্কবাণীতে কান না দেয় তারা যেন ঘোরতর পরিণতির অপেক্ষায় থাকে।
২- পানির মতো বাতাসও আল্লাহর হুকুমের অধীন। কখনও বাতাস মানুষের জন্য প্রশান্তিদায়ক আবার কখনও ভয়াবহ আজাবের অনুষঙ্গ।
৩- পবিত্র কুরআন কোনো ইতিহাস গ্রন্থ নয়। তা সত্ত্বেও এর কোনো কোনো অংশে অতীতের সত্য অস্বীকারকারী কাফির ও দাম্ভিক জাতিগুলোর পরিণতি বর্ণনা করা হয়েছে যাতে মানুষ সত্য গ্রহণ করে।
তো শ্রোতাবন্ধুরা! এরইসঙ্গে শেষ করছি কুরআনের আলোর আজকের আয়োজন। মহান আল্লাহ এ আলোচনা থেকে আমাদের সবাইকে শিক্ষা গ্রহণ করার তৌফিক দান করুন।
পার্সটুডে/এমএমআই/এমবিএ/৫
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।