এপ্রিল ০৬, ২০২৩ ২০:৪৬ Asia/Dhaka

শ্রোতাবন্ধুরা, সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করছি আপনারা সবাই ভালো আছেন।   গত আসরে আমরা সূরা কামারের ২২ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের আলোচনা শুনেছিলাম। আজ আমরা এই সূরার ২৩ থেকে ৩২ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের সংক্ষিপ্ত তাফসির উপস্থাপনের চেষ্টা করব। প্রথমেই ২৩ থেকে ২৬ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:

(23) فَقَالُوا أَبَشَرًا مِنَّا وَاحِدًا نَتَّبِعُهُ إِنَّا إِذًا لَفِي ضَلَالٍ وَسُعُرٍ (24) أَؤُلْقِيَ الذِّكْرُ عَلَيْهِ مِنْ بَيْنِنَا بَلْ هُوَ كَذَّابٌ أَشِرٌ (25) سَيَعْلَمُونَ غَدًا مَنِ الْكَذَّابُ الْأَشِرُ (26) إِنَّا مُرْسِلُو النَّاقَةِ فِتْنَةً لَهُمْ فَارْتَقِبْهُمْ وَاصْطَبِرْ

“সামূদ জাতি সতর্ককারীদেরকে অস্বীকার করেছিল।” ( ৫৪:২৩)

“তারা বলেছিল, ‘আমরা কি আমাদেরই মধ্যকার মাত্র একটা লোকের অনুসরণ করব? তাহলে তো নিশ্চয় আমরা পথভ্রষ্ট ও পাগলরূপে গণ্য হব।”( ৫৪:২৪)

“আমাদের এত মানুষের মধ্যে শুধু কি তার উপরই ওহী নাজিল হয়েছে? [না,] বরং সে বড়ই মিথ্যুক ও দাম্ভিক।”( ৫৪:২৫)

“[তারা] ভবিষ্যতে অবশ্যই জানবে, কে মিথ্যাবাদী ও দাম্ভিক।”( ৫৪:২৬)

গত আসরে নূহ ও আদ জাতির পরিণতি বর্ণনা করার পর এই আয়াতগুলোতে সামূদ জাতি সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। এই জাতি আরব উপদ্বীপের উত্তর অংশে বসবাস করত এবং তাদের নবী ছিলেন হযরত সালেহ (আ.)। তারা দম্ভ ও অহংকারের কারণে আল্লাহর প্রেরিত এই পুরুষের সাবধান বাণীর প্রতি ভ্রুক্ষেপ করেনি বরং তারা তাদের অপকর্ম অব্যাহত রাখে।  তারা শুধু যে আল্লাহর নবীর দাওয়াতের বাণী গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিল না তাই নয় বরং উল্টো হযরত সালেহ (আ.)কে পথভ্রষ্ট ও পাগল বলে আখ্যায়িত করে। তারা বলেন, এই ব্যক্তিকে অনুসরণ করলে তারাও পথভ্রষ্ট ও পাগল হয়ে যাবে। অবশ্য আরো কিছু কারণে তারা হযরত সালেহর বিরোধিতা করেছিল। তারা বলত: আমাদেরই মতো এক ব্যক্তি যে কিনা আমাদের মধ্যেই সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন করে এবং যার কোনো ক্ষমতা, সম্পদ কিংবা জনবল নেই সে কীভাবে আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদেরকে হেদায়েতের বাণী শোনানোর দাবি করে?

এই চার আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:

১- নবী-রাসূলগণ সাধারণ মানুষের মধ্যেই সাধারণ জীবনযাপন করতেন যাতে তাঁরা সকলের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ হতে পারেন।

২- কখনও কখনও মানুষ এত বেশি অধঃপতিত হয় যে, নবী-রাসূলদের মতো পবিত্র ও নিষ্কলুশ মানুষদের অনুসরণ করতেও তার অহংকারে বাধে। অথচ অত্যাচারী শাসকের আদেশ মেনে চলতে কিংবা প্রাণহীন মূর্তির পূজা করতে তাদের অহংবোধে বাধে না।

৩- যুগে যুগে সব নবীকে মিথ্যাবাদী ও দাম্ভিকের অপবাদ দেয়া হয়েছে।  অথচ কাফিররা নিজেরাই ছিল এই দু’টি চরিত্রের উৎকৃষ্ট নমুনা।

এবারে সূরা কামারের ২৭ থেকে ২৯ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:

(27) وَنَبِّئْهُمْ أَنَّ الْمَاءَ قِسْمَةٌ بَيْنَهُمْ كُلُّ شِرْبٍ مُحْتَضَرٌ (28) فَنَادَوْا صَاحِبَهُمْ فَتَعَاطَى فَعَقَرَ (29) فَكَيْفَ كَانَ عَذَابِي وَنُذُرِ

“নিশ্চয় আমি তাদের জন্য পরীক্ষাস্বরূপ উষ্ট্রী পাঠাচ্ছি। অতএব আপনি তাদের আচরণ লক্ষ্য করুন এবং ধৈর্যধারণ করুন।”  ( ৫৪:২৭)

“আর তাদেরকে জানিয়ে দিন যে, উষ্ট্রী ও তাদের মধ্যে পানি বন্টন করা হয়েছে। পানির অংশের জন্য প্রত্যেকে পালাক্রমে উপস্থিত হবে নিজের নির্ধারিত সময়ে।”  ( ৫৪:২৮)

“অতঃপর তারা তাদের সঙ্গীকে ডাকল, ফলে সে কর্মে লিপ্ত হলো এবং উষ্ট্রীকে ধরে হত্যা করল।”  ( ৫৪:২৯)

স্বাভাবিকভাবেই যে কেউ নবুওয়াতের দাবি করলেই তার কথা বিশ্বাস করা যায় না।  তাকে এমন মুজিযা দেখাতে হবে যা থেকে তার নবুওয়াতের সত্যতার প্রমাণ পাওয়া যায়। হযরত সালেহ (আ.)-এর নবুওয়াতের প্রমাণস্বরূপও আল্লাহ তায়ালা মুজিযা পাঠালেন। আল্লাহর ইচ্ছায় পাহাড় ফেটে অন্যান্য উটের তুলনায় বিশালদেহী একটি মাদি উট বেরিয়ে এলো।  উটটি এত বেশি পানি পান করত যে, কুয়ার পানি সংগ্রহের সময় বণ্টন করে দিতে হয়েছিল। কারণ, মানুষ পানি নিলে উট খেতে পেত না আবার উট পানি পান করা শুরু করলে মানুষের পক্ষে পানি সংগ্রহ করা সম্ভব ছিল না। অবশ্য এটি ছিল আল্লাহ তায়ালার একটি পরীক্ষা। মানুষ যেন বণ্টনকৃত পালা অনুসরণ করে কুয়ায় যায় এবং আল্লাহর আদেশ পালনের অভ্যাস গড়ে তোলে সেজন্য এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। 

এদিকে সামূদ জাতির নেতাদের পক্ষে এই মুজিযা সহজে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। তারা উটটিকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করে এবং এই কাজে এক ব্যক্তিকে নিয়োগ দেয়।  একথা বুঝতে পেরে হযরত সালেহ (আ.) তাঁর জাতিকে এই বলে সতর্ক করে দেন যে, আল্লাহর মুজিযা স্বচক্ষে দেখার পর তা প্রত্যাখ্যান করলে আল্লাহর গজবের শিকার হতে হবে। কিন্তু তারা এই সতর্কবাণী প্রত্যাখ্যান করে এবং সত্যি সত্যি সেই ভয়ঙ্কর কাজটি করে ফেলে। অর্থাৎ উটটিকে হত্যা করে।

এই আয়াতগুলোর কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:

১- মুজিযা বা অলৌকিক নিদর্শন যে শুধু নবীদের নবুওয়াতের সত্যতার প্রমাণ তাই নয়। সেইসঙ্গে এটি মানুষকে পরীক্ষা করারও একটি বড় মাধ্যম। মুজিযা দেখার পর প্রমাণিত হয় কে সত্য গ্রহণে আগ্রহী ছিল এবং কে গোয়ার্তুমি ও অহংকারের কারণে আগে থেকেই সত্য প্রত্যাখ্যানের পরিকল্পনা নিয়ে রেখেছিল।

২- আল্লাহ তায়ালা মানুষের সামনে সত্য প্রকাশ না করা পর্যন্ত তাদেরকে শাস্তি দেন না।

৩- নবী-রাসূলগণের শত্রুরা তাদের অশুভ লক্ষ্য চরিতার্থ করার জন্য ভাড়াটে গুণ্ডা ও রক্তপিপাসু ব্যক্তিদের নিয়োগ দেয়।

এবারে সূরা কামারের ৩০ থেকে ৩২ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:

(30) إِنَّا أَرْسَلْنَا عَلَيْهِمْ صَيْحَةً وَاحِدَةً فَكَانُوا كَهَشِيمِ الْمُحْتَظِرِ (31) وَلَقَدْ يَسَّرْنَا الْقُرْآَنَ لِلذِّكْرِ فَهَلْ مِنْ مُدَّكِرٍ (32) كَذَّبَتْ قَوْمُ لُوطٍ بِالنُّذُرِ

“অতএব কিরূপ কঠোর ছিল আমার শাস্তি ও ভীতিপ্রদর্শন!” ( ৫৪:৩০)

“নিশ্চয় আমি তাদের উপর পাঠিয়েছিলাম শুধুমাত্র একটি বিকট আওয়াজ [ও প্রাণঘাতী বজ্রপাত]; ফলে তারা হয়ে গেল খোয়াড় প্ৰস্তুতকারীর বিখণ্ডিত শুষ্ক খড়ের ন্যায়।”( ৫৪:৩১)

“আর অবশ্যই আমি কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি স্মরণ করিয়ে দেয়ার [ও উপদেশ গ্রহণের] জন্য; অতএব উপদেশ গ্রহণকারী কেউ আছে কি?”( ৫৪:৩২)

হযরত সালেহ (আ.)-এর নবুওয়াতের সত্যতা নির্ণয়কারী উটটিকে হত্যা করার পর আল্লাহ তায়ালা সামূদ জাতির প্রতি এক কঠিন বজ্রপাত নাজিল করলেন। বজ্রপাতে সামূদ জাতির লোকজন যে যার স্থানে শুকনা খড়ের মতো নিশ্চুপ হয়ে পড়ে রইল। তাদের সবাই খোয়াড় প্রস্তুতকারীর চূর্ণ-বিচূর্ণ ডাল-পাতার মত হয়ে গেল।

সামূদ জাতির এই ভয়ঙ্কর পরিণতির কথা বর্ণনা করার পর আল্লাহ তায়ালা আরেকবার মানুষকে একথা স্মরণ করিয়ে দেন যে, পবিত্র কুরআন নাজিলের উদ্দেশ্য সতর্ক করা ও উপদেশ প্রদান করা; যাতে মানুষ তার সামনে থাকা বিপদগুলো চিনতে এবং তা থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করতে পারে। দুনিয়া ও আখিরাতে যেন সে আল্লাহর গজব ও আজাবের শিকার না হয়।

এই তিন আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:

১- উটের হত্যাকারী এক ব্যক্তি হলেও তার এই হত্যাকাণ্ডের প্রতি যেহেতু সবার সমর্থন ছিল তাই পবিত্র কুরআনে এই জঘন্য কাজের জন্য সবাইকে দায়ী করা হয়েছে। এ কারণে সামূদ জাতির সবাই আল্লাহর গজবের শিকার হয়েছে।

২- আল্লাহ তায়ালার শক্তির সামনে প্রতিরোধ গড়ে তোলার সাধ্য কারো নেই। সামূদ জাতির সুঠামদেহী মানুষগুলো শুকনো খড়কুটার মতো মাটিতে পড়ে ছিল।

৩- পবিত্র কুরআন কোনো ইতিহাস গ্রন্থ নয় তবে এতে অতীতের কিছু জাতির পরিণতি বর্ণনা করা হয়েছে যাতে মানুষ তা থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদের জীবনকে সংশোধন করতে পারে।

তো শ্রোতাবন্ধুরা! এরইসঙ্গে শেষ করছি কুরআনের আলোর আজকের আয়োজন। মহান আল্লাহ এ আলোচনা থেকে আমাদের সবাইকে শিক্ষা গ্রহণ করার তৌফিক দান করুন।

 

পার্সটুডে/এমএমআই/এমবিএ/৬

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।