এপ্রিল ১৩, ২০২৩ ১৪:৪১ Asia/Dhaka
  • বিশ্ব কুদস দিবস: এবারের পরিস্থিতি ফিলিস্তিনিদের অনুকূলে, বেকায়দায়  ইসরাইল

মজলুম ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানিয়ে আগামীকাল পালিত হবে বিশ্ব কুদস দিবস। ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সচেতনতা গড়ে তুলতে ইরানের ইসলামি বিপ্লবের স্থপতি মরহুম ইমাম খোমেনি প্রতি বছর রমজানের শেষ শুক্রবার বিশ্ব কুদস দিবস পালনের ডাক দিয়েছিলেন।

প্রতি বছরের মতো এবারও এমন সময় বিশ্ব কুদস দিবস পালিত হচ্ছে যখন ইসরাইল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যকার উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে। শুধু ফিলিস্তিন নয় দক্ষিণ লেবানন ও সিরিয়ার সাথেও ইসরাইলের উত্তেজনা বিরাজ করছে। সিরিয়ায় ইসরাইলি হামলায় ইরানের দু'জন সামরিক উপদেষ্টা নিহত হওয়ার ঘটনা উত্তেজনার পারদ অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে যা ইসরাইলের জন্য মোটেই শুভকর নয়। অন্যদিকে, ভেতর থেকেও ইসরাইল চরম বিপাকে আছে। নেতানিয়াহুর সরকারের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন চরম আকার ধারণ করেছে। সব মিলিয়ে যা অবস্থা তাতে ইসরাইল অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে খারাপ অবস্থানে রয়েছে।

অধিকৃত ফিলিস্তিনে এবারের উত্তেজনার প্রথম কারণ হচ্ছে, বিশ্ব কুদস দিবসকে সামনে রেখে ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রায় প্রতিদিন ফিলিস্তিনিরা হতাহত হচ্ছে। বিশেষ করে আল আকসা মসজিদে গভীর রাতে নামাজরত মুসল্লিদের ওপর হামলা চালিয়ে ইসরাইল এমন এক ন্যক্কারজনক কাজ করেছে যা খোদ ইহুদি অভিবাসী ও ইসরাইলি সেনাদের কাছেও গ্রহণযোগ্য ছিলনা।

দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, ইসরাইল এবার নজিরবিহীন অভ্যন্তরীণ তীব্র রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা সংকটে আছে। অবস্থা এমন যে ইসরাইলের প্রেসিডেন্ট বেশ ক'বার গৃহযুদ্ধ এবং ভেতর থেকে ইসরাইলের ধ্বসে পড়ার ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছেন।  এমন পরিস্থিতিতে ইসরাইলের ভঙ্গুর মন্ত্রিসভা অভ্যন্তরীণ সংকট থেকে বাঁচতে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে আগ্রাসনের মাত্রা বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে তারা আল আকসা মসজিদে নামাজরত মুসল্লিদের ওপর ভয়াবহ হামলা চালিয়ে বহু লোককে আহত করেছে। এর বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনের প্রতিরোধকামী সংগঠনগুলো তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে এবং সমগ্র ওই অঞ্চলে নতুন করে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। তেলআবিবের সাম্প্রতিক কিছু নৃশংসতার জবাবে গাজা ও দক্ষিণ লেবাননের প্রতিরোধকামী যোদ্ধারা ইসরাইলের দিকে রকেট ছুঁড়েছে। মুহুর্মুহু রকেটের আঘাতে ইসরাইল হতচকিত হয়ে গেছে। আগের বছরগুলোর তুলনায় এবারের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং ফিলিস্তিনিরা আরো বেশি দৃঢ় ও সংকল্পবদ্ধ হয়েছে যা ইসরাইলের ঘুম কেড়ে নিয়েছে।

এবারের পরিস্থিতির ভিন্নতার অন্যতম কারণ হচ্ছে, ফিলিস্তিনের নতুন প্রজন্মকে নিয়ে গড়ে ওঠা প্রতিরোধ শক্তি পুরাতন প্রতিরোধ শক্তিগুলোর চাইতে আরো বেশি উদ্যমী ও সাহসী। জর্দান নদীর পশ্চিম তীর, বায়তুল মোকাদ্দাস ও গাজার বিভিন্ন গ্রুপের সমন্বয়ে শক্তিশালী প্রতিরোধ যোদ্ধা গড়ে তোলা হয়েছে। তারা প্রচণ্ড সাহসী এবং তারা বিশ্বাস করে রাজধানী তেলআবিবসহ ইসরাইলের ভেতরে সামরিক অভিযান চালানো  উচিত। নতুন প্রজন্মের এই যোদ্ধারা ইসরাইলের সাথে যে কোনো আপোষকামিতার তীব্র বিরোধী। তাদের তৎপরতার ফলে গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা ক্ষেত্রে ইসরাইলের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে এবং ইসরাইলি কর্মকর্তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে।

এ অঞ্চলের পরিস্থিতি পাল্টে যাওয়ার আরেকটি নিদর্শন হচ্ছে, ইসরাইল জর্দান নদীর পশ্চিম তীর থেকে ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের উৎখাত করতে তো পারেনি বরং প্রতিরোধ যোদ্ধারা ইসরাইলের জন্য আরো বেশি বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, গাজা উপত্যকার মতো পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিরাও সামরিক দিক দিয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যা কিনা পুরো পরিস্থিতিকে পাল্টে দিয়েছে। এমনকি ফিলিস্তিন স্বশাসন কর্তৃপক্ষও তাদের তুলনায় দুর্বল অবস্থানে রয়েছে।

প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বে ফিলিস্তিন স্বশাসন কর্তৃপক্ষ সবসময়ই ইসরাইলের সাথে আপোষ আলোচনার ওপর জোর দিয়ে আসছে। তারা  এখন সবচেয়ে দুর্বল অবস্থানে রয়েছে এবং পরিস্থিতি প্রতিরোধ যোদ্ধাদের অনুকূলে রয়েছে।  মধ্যপ্রাচ্যের  খ্যাতনামা রাজনৈতিক  বিশ্লেষক আব্দুল বারি আতাওয়ান এ ব্যাপারে বলেছেন, এটা এখন  খুবই স্পষ্ট যে ইসরাইল বিরোধী প্রতিরোধকামী শক্তির মোকাবেলায় ফিলিস্তিন স্বশাসন কর্তৃপক্ষের নিরাপত্তা ও সামরিক শক্তি কার্যত ভেঙে পড়েছে। জেনিন, নাবলুস, বালথা প্রভৃতি এলাকার ইজ্জাদ্দিন আল-কাস্সাম ব্রিগেডসহ অন্যান্য প্রতিরোধকামী যোদ্ধাদের দমন বা মোকাবেলার শক্তি স্বশাসন কর্তৃপক্ষের নিরাপত্তা বাহিনীর নেই।

অন্যদিকে, বিগত বছরগুলোর তুলনায় ইসরাইলের অভ্যন্তরের চিত্রও আমুল পাল্টে গেছে। বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু প্রায় দেড় বছর ক্ষমতার বাইরে থাকার পর গত বছর ডিসেম্বর ফের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব হাতে পান। ক্ষমতায় আসার জন্য নেতানিয়াহু উগ্রডানপন্থী গ্রুপের সঙ্গে জোট গড়তে বাধ্য হন। নেতানিয়াহুর উগ্র এই মন্ত্রিসভা গত ১০০ দিনে ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলা চালানো ছাড়াও ইসরাইলের অভ্যন্তরেও বিরোধীদেরকে দমনের চেষ্টা চালাচ্ছে।

নেতানিয়াহু বিচারবিভাগের সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য বিতর্কিত পদক্ষেপ নেয়ায় মূলত অভ্যন্তরীণ গোলযোগ শুরু হয়। কারণ তার এ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে পার্লামেন্ট ও মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতা বিচারবিভাগের থাকবে না। নেতানিয়াহুর এ পদক্ষেপের বিরুদ্ধে ইসরাইলে নজিরবিহীন বিক্ষোভ শুরু হয়। গত সপ্তাহে প্রায় সাত লাখ ইসরাইলি নাগরিক সরকার বিরোধী বিক্ষোভে অংশ নেয়। এ ঘটনায় ইসরাইলে রাজনৈতিক ফাটল সৃষ্টির পাশাপাশি নিরাপত্তা ক্ষেত্রেও শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। এমনকি সেনাবাহিনীর বেশ কিছু সদস্য নেতানিয়াহু বিরোধী বিক্ষোভে শামিল হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে ইসরাইলের প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হারেতযুগ গৃহযুদ্ধ বেধে যাওয়া এবং ভেতর থেকে ইসরাইলের ধ্বসে পড়ার ব্যাপারে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন।    

বিচারবিভাগ সংস্কারের উদ্যোগকে কেন্দ্র করে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হলেও বাস্তবতা হচ্ছে এটা গত চার বছর ধরে চলা রাজনৈতিক অচলাবস্থা ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার বিরোধের প্রতিক্রিয়া মাত্র। এ কারণে ইসরাইলের প্রেসিডেন্ট ওই হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন।

যাইহোক, ফিলিস্তিনের প্রতিরোধকামী সংগঠনগুলোর দৃঢ় অবস্থানের কারণে ইসরাইলের মন্ত্রিসভা ও সেনাবাহিনীতে ফাটল ধরেছে। ইসরাইলের অনেক কর্মকর্তা ফিলিস্তিনিদের ওপর প্রচণ্ড হামলা চালানোর পক্ষপাতী। আবার অনেকে মনে করেন ব্যাপক হামলা কিংবা যুদ্ধ করার মতো পরিস্থিতি ইসরাইলের নেই। এ প্রসঙ্গে তারা অভ্যন্তরীণ নাজুক পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করেছেন। যদিও ইসরাইল সম্প্রতি দক্ষিণ লেবানন ও গাজা উপত্যকায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে কিন্তু ওই আগ্রাসনের পাল্টা জবাব থেকে তাদের দুর্বলতা ফুটে উঠেছে। ইসরাইল এবার গাজায় তাদের লক্ষ্যবস্তুতে গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছিল। তবে, প্রতিরোধকামীরা উন্নত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় সজ্জিত হওয়ায় ইসরাইল এবার বিমান কিংবা হেলিকপ্টার দিয়ে হামলা করার সাহস পায়নি।

মধ্যপ্রাচ্যের আরো কিছু পরিবর্তন দখলদার ইসরাইলের পতনকে তরান্বিত করেছে। ইরানের সাথে সৌদি আরবসহ অন্য আরব দেশের সম্পর্ক উন্নয়ন, আরবলীগে সিরিয়ার যোগদান, দামেস্ক-রিয়াদ সম্পর্ক উন্নয়ন, ইয়েমেন যুদ্ধ বন্ধে কূটনৈতিক উদ্যোগ প্রভৃতি ঘটনা ইসরাইলের অনুকূলে নয়।

এ সব কারণে একেবারেই ব্যতিক্রম পরিবেশে আগামীকাল বিশ্ব কুদস দিবস পালিত হতে যাচ্ছে। কেননা সবকিছুই এখন মুসলিম জাহানের অনুকূলে এবং ইসরাইল ও তার মিত্রদের প্রতিকূলে। #

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।