সহনশীলতা ও বিনম্রতা মানুষের জন্য অলংকার: মহানবী (সা.)
আসামাউল হুসনা-৯১ (রাফিক্ব নামের তাৎপর্য)
মানুষ দুনিয়ার বুকে মহান আল্লাহর প্রতিনিধি। তবে আল্লাহর যোগ্য প্রতিনিধি হতে হলে এবং মহান আল্লাহর সত্যিকারের অনুরাগী হতে হলে তাঁর নামগুলোর অর্থ ও ব্যাখ্যা সম্পর্কে ব্যাপক ধারণা রাখতে হবে।
প্রকৃত খোদাপ্রেমিকরা জানেন কখন ও কোন অবস্থায় মহান আল্লাহ'র কোন্ কোন্ নাম-এর শরণাপন্ন হতে হবে। মহান আল্লাহর পবিত্র নামগুলো কেবল এক-একটি শব্দ নয় বরং ব্যাপক অর্থবোধক বিষয়। বিভিন্ন সময়ে এইসব নামের প্রকাশ ও বৈশিষ্ট্যগুলো ফুটে উঠে। মহান আল্লাহ'র আসমায়ুল হুসনার তালিকাভুক্ত এমনই আরেকটি নাম রাফিক্ব رفیق । এর অর্থ উপকারকারী ও সাহায্যকারী। সুরা নিসার ৬৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ রাফিক্বান শব্দটি উল্লেখ করে বলেছেন, আর যে কেউ আল্লাহর হুকুম এবং তাঁর রসূলের হুকুম মান্য করবে, তাহলে যাঁদের প্রতি আল্লাহ নেয়ামত দান করেছেন, ক্বিয়ামতের দিন সে তাঁদের সঙ্গী হবে। তাঁরা হলেন নবী, সিদ্দীক, শহীদ ও সৎকর্মশীল ব্যক্তিবর্গ। আর তাঁদের সান্নিধ্যই হল উত্তম তথা তারা কত উত্তম সহযোগী ও বন্ধু বা উপকারকারী ।
রাফিক্ব শব্দের মূল রাফাক হচ্ছে কঠোরতা ও অনমনীয়তার ঠিক বিপরীত। উদারতা ও কাজকর্ম উত্তমভাবে সম্পাদনকারী অর্থেও এর ব্যবহার রয়েছে। মহান আল্লাহ ধর্মীয় দায়িত্ব পালন থেকে শুরু করে বান্দাহর সব বিষয়ে অত্যন্ত উদার ও নমনীয়। যেমন, কেউ অসুস্থ হলে তার জন্য সহজ বিধান দিয়েছেন নামাজ-রোজাসহ সবক্ষেত্রে। আল্লাহ বান্দাহর ওপর সাধ্যাতীত কাজ বা দায়িত্ব চাপিয়ে দেন না। দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তে না পারলে অসুস্থ ব্যক্তি বসে বা শুয়ে ও এমনকি তাতেও সক্ষম না হলে ইশারায়ও নামাজ আদায় করতে পারেন। রোজা রাখার কারণে অসুস্থ হওয়ার আশঙ্কা থাকলেও তা পালনের দায়িত্ব হতে অব্যাহতি দিয়েছেন পরম করুণাময় মহান আল্লাহ।
মহানুভব মহান আল্লাহ রাফিক্ব বলেই গোনাহগার বান্দাহদের তওবার সুযোগ দেন এবং সৌভাগ্যের পথ ও পূর্ণতার পথ খোলা রাখেন। সুরা কাহাফের ৫৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, আপনার পালনকর্তা ক্ষমাশীল, দয়ালু, যদি তিনি তাদেরকে তথা কাফির ও মুশরিকদেরকে তাদের কৃতকর্মের জন্যে পাকড়াও করতেন তবে তাদের শাস্তি ত্বরান্বিত করতেন, কিন্তু তাদের জন্য রয়েছে একটি প্রতিশ্রুত সময়, যা থেকে তারা সরে যাওয়ার জায়গা পাবে না। - মহানুভব আল্লাহ সুরা নাহ্ল্-এর ৬১ নম্বর আয়াতে বলেছেন, যদি আল্লাহ লোকদেরকে তাদের অন্যায় কাজের কারণে পাকড়াও করতেন, তবে ভূপৃষ্ঠে চলমান কোন কিছুকেই ছাড়তেন না। কিন্তু তিনি প্রতিশ্রুতি সময় পর্যন্ত তাদেরকে অবকাশ দেন। অতঃপর নির্ধারিত সময়ে যখন তাদের মৃত্যু এসে যাবে, তখন এক মুহূর্তও বিলম্বিত কিংবা ত্বরান্বিত করতে পারবে না।–
পাপের যে কদর্যতা ও কালিমা তার কুফল এড়ানোর উপায় নেই। এটা অনেকটা বস্তুজগতের বিধানের মত। যেমন, পানি ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ফুটতে থাকে ও শূন্য ডিগ্রি তাপমাত্রায় বরফ হয়ে যায়। ফলে মানুষের পাপাচারের কারণে নানা বিপর্যয়, দুর্যোগ ও শাস্তি ভোগ করতে হয় পৃথিবীতে। কিন্তু মহান আল্লাহ রাফিক্ব বলেই পাপের সঙ্গে সঙ্গে শাস্তি নেমে আসে না বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এবং মহান আল্লাহ হালিম বা ধৈর্যশীল বলে পাপীদেরকে তওবা করার ও পরিশুদ্ধ হওয়ার সুযোগ দেন। মহান আল্লাহ তার অনুগত বান্দাহদের জন্য কাজ সহজ করে দেন ও তাদেরকে সুরক্ষা দেন যেমনটি তিনি সুরক্ষা দিয়েছিলেন আঞ্জালুস পর্বতের গুহায় আশ্রয় নেয়া সাত মহান ব্যক্তিকে। সুরা কাহাফের ১৬ নম্বর আয়াতে এ বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে যেখানে ফলপ্রসূ বা সহজ করে দেয়া অর্থে রাফিক্বের সমগোত্রীয় মিরফাক্ব শব্দ এসেছে: ( সাথীরা! তোমরা যখন তাদের থেকে পৃথক হলে এবং তারা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের এবাদত করে তাদের থেকে, তখন তোমরা গুহায় আশ্রয়গ্রহণ কর। তোমাদের পালনকর্তা তোমাদের জন্যে দয়া বিস্তার করবেন এবং তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের কাজ কর্মকে মিরফাক্ব তথা সহজ বা ফলপ্রসূ করার ব্যবস্থা করবেন। )
মহান আল্লাহ নিজে উদার ও তাই তিনি মানুষের প্রতি উদার হতে বলেছেন মুমিন বান্দাহদেরকে। আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী-আ. থেকে বর্ণিত যে একবার জিব্রাইল ফেরেশতা মহানবীর-সা. কাছে এসে বললেন, মহান আল্লাহ আপনাকে সালাম দিয়েছেন এবং তিনি তাঁর খাল্ক্ তথা মানুষের সঙ্গে নমনীয় বা উদার হতে বলেছেন। রাফিক্ব বলেই মহান আল্লাহ দয়া ও উদারতা পছন্দ করেন। তিনি সুরা আলে ইমরানের ১৫৯ নম্বর আয়াতে বলেছেন: হে নবী! আল্লাহর রহমতেই আপনি তাদের জন্য কোমল হৃদয় হয়েছেন, আপনি যদি রাগী ও কঠিন-হৃদয় হতেন তাহলে তারা আপনার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতো। কাজেই আপনি তাদের ক্ষমা করে দিন এবং তাদের জন্য মাগফেরাত কামনা করুন ও নানা কাজে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করুন।
এটা স্পষ্ট মহানবী –সা. আল্লাহর ইচ্ছায় উদার ও ক্ষমাশীল ছিলেন বলেই আরবের উগ্র, বর্বর, যুদ্ধ, দলাদলি ও সংঘাত-প্রিয় বা গোত্রবাদী জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে তাদের শক্তিশালী সভ্য জাতিতে পরিণত করতে এবং নিজের রিসালাতের দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
দয়াশীলতা ও নমনীয়তা মানুষের বন্ধুত্বকে সুদৃঢ় করে এবং যারা বেশি দয়ালু ও নমনীয় পরকালে তাদের জন্য বিশেষ পুরস্কার রয়েছে বলে মহানবী-সা. সুসংবাদ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, দুই ব্যক্তি যখন বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয় তখন তাদের মধ্যে যে তার বন্ধুর প্রতি বেশি উদার ও নমনীয় বা বিনম্র সে আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয় ও তার পুরস্কারও বেশি।
মহানবীর (সা) মতে অন্যদের সঙ্গে মানিয়ে চলা বা সহনশীলতা ও বিনম্রতা মানুষের জন্য অলংকার। তিনি বলেছেন, বিনম্রতা সব কিছুকে সুশোভিত করে ও বিনম্রতাহীনতা সব কিছুকে করে কুৎসিত। তাই মানুষের উচিত সব ক্ষেত্রে বিনম্র হওয়া ও সহিংসতা থেকে দুরে থাকা। হযরত আলী (আ) বলেছেন, বন্ধু যখন তোমার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করতে চায় তুমি তখন তার সঙ্গে লেগে থাকো, তার ক্ষিপ্ততা ও দুরে যাওয়ার মুহূর্তে তার প্রতি দয়ার্দ্র ও ঘনিষ্ঠ হও। অবশ্য কেউ যদি আপনার বিনম্রতা ও নমনীয়তার অপব্যবহার করে তাহলে তার সঙ্গে কঠোরতা দেখাতেও বলেছে ইসলাম। তাই বিনম্রতা ও দয়াশীলতা যদি বিপদের কারণ বা অকার্যকর হয়ে পড়ে সেক্ষেত্রে কঠোরতার বিকল্প নেই। #
পার্সটুডে/এমএএইচ/২১
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।