এপ্রিল ২১, ২০২৩ ১৯:৫১ Asia/Dhaka

বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর একবছরেরও কম সময় হাতে আছে। নির্বাচনের বিষয়টি নিয়ে বিভিন্নমহলে এবং চায়ের আড্ডায় আলাপ আলোচনা চলছে। তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলোর। এ বিষয়ে রেডিও তেহরানকে দেয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে সিনিয়র সাংবাদিক, বাংলাদেশ ডিফেন্স জার্নাল পত্রিকার প্রধান সম্পাদক আবু রুশদ বললেন, বাংলাদেশের মতো দেশে গণতন্ত্রের বহমনতা যদি না থাকে, স্থিতিশীলতা যদি না আসে, সুষ্ঠু নির্বাচন যদি না হয় তাহলে বাংলাদেশে চরম নৈরাজ্য নেমে আসবে।

বিশিষ্ট এই সাংবাদিক আরও বলেন, আমাদের একটি গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য ছিল তা এরইমধ্যে ক্ষুণ্ণ হয়েছে।

একটি নিয়ন্ত্রিত সমাজ একটি নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্র ব্যবস্থা আমাদের দেশে চলছে। এই দেশ চলছে প্রশাসন কেন্দ্রীক, নিরাপত্তাবাহিনী কেন্দ্রীক ও গোয়েন্দা কেন্দ্রীক! এগুলোকে তো বন্ধ করতে হবে।

পুরো সাক্ষাৎকারটি শুনুন। উপস্থাপনা ও তৈরি করেছেন গাজী আবদুর রশীদ। এটি গ্রহণ করেছেন সিরাজুল ইসলাম।  

রেডিও তেহরান: জনাব আবু রুশদ, বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের ব্যাপারে আমেরিকা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো বেশ নড়েচড়ে বসেছে এবং তারা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে একটা শক্ত অবস্থান নিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। আপনারও কি তাই মনে হয়?

আবু রুশদ: আমার অভিমত হচ্ছে আমেরিকা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন অবশ্যই এ ব্যাপারে সিরিয়াস। তার কারণ বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষিতে বিশেষ করে  আমাদের উপমহাদেশে এবং এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে যে পরিবর্তনগুলো ঘটছে তাতে বাংলাদেশের মতো দেশে গণতন্ত্রের বহমনতা যদি না থাকে, স্থিতিশীলতা যদি না আসে, সুষ্ঠু নির্বাচন যদি না হয় তাহলে বাংলাদেশে চরম নৈরাজ্য নেমে আসবে।

আমাদের ঠিক পাশেই মিয়ানমার।  আর মিয়ানমারে আগুন জ্বলছে। আপনারা জানেন মিয়ানমারে সেনা শাসন কায়েম হয়েছে। সেখানে ফাইটার প্লেন দিয়ে সাধারণ গ্রামবাসীর ওপর বোমা বর্ষণ করে হত্যা করা হচ্ছে। সেখানে এধরনের যে কাজগুলো চলছে সেটি শুধুমাত্র যে রাজনৈতিক তা কিন্তু নয়; এটা একটি কৌশলগত বিষয়ও। কারণ আমাদের বঙ্গোপসাগর নিয়ে  চীন এবং পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে একটা তীব্র প্রতিযোগিতা আছে। আসিয়ান দেশগুলোর মধ্যে থাইল্যান্ড, ম্যালেয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, ব্রুনাই-এসব দেশ কিন্তু অনেকটা গণতান্ত্রিক এবং ইন্দো প্যাসিফিক স্ট্রাটিজির সাথে শামিল। আমরা সেই আগুন জ্বলা মিয়ানমারের পাশে বসে যদি গণতন্ত্রটা না রাখতে পারি তাহলে সেটি হবে দুঃখজনক। আর আমাদের একটা গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য ছিল সেটা এরইমধ্যে অবশ্য ক্ষুণ্ণ হয়েছে।

রেডিও তেহরান: আবু রুশদ, আপনি বলছিলেন গণতন্ত্রের কথা। এরইমধ্যে আমাদের যে গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য ছিল সেটা ক্ষুণ্ণ হয়েছে। নানা বিতর্ক চলছে তা নিয়ে। ফলে সেই গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনার প্রসঙ্গটি আপনি উল্লেখ করলেন। আচ্ছা গণতন্ত্র ফিরিয়ে না আনা গেলে কী ক্ষতি হবে?

বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন

আবু রুশদ: দেখুন, এখন যদি এখানে গণতন্ত্র ফিরিয়ে না আনা যায় তাহলে আমাদের সমাজে অস্থিতিশীলতা আসবে। আমাদের প্রশাসনিক ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা ব্যহত হবে। এরবাইরে ইউরোপ আমেরিকা যে বিশ্ব বলয়ের মধ্যে আছে তারা গণতান্ত্রিক। তাদের মধ্যে নির্বাচন হয়। সেখানে মুক্ত পথ প্রকাশ আছে। যদিও তাদের অনেক দুর্বলতাও আছে সেকথা স্বীকার করা যায়। তাদের অনেক কৌশলগত বিষয় আছে যেগুলো আমরা পছন্দ করি না। বিভিন্ন দেশে আগ্রাসনসহ নানা বিষয়ে আমরা তাদের পছন্দ করি না। কিন্তু বাংলাদেশের স্বার্থটা সেখানে বেশি। অবশ্য তাদেরও স্বার্থ রয়েছে আমাদের এখানে। কেননা আমাদের এখান থেকে তারা কিছুটা জনশক্তি নেয়। আমাদের এখান থেকে তারা গার্মেন্ট নেয়। আমরা একটা বড় গার্মেন্টস এক্সপোর্টার। দেখুন আমাদের একটা ছোট দেশ সেখানে ষোল কিংবা সতের কোটি লোক বসবাস করে। যদি এই দেশটিকে ঠিক করা না যায় এবং এখানে একটা নৈরাজ্য হলে ওদের দেশে চাপ পড়বে। সেখানে প্রচুর অ্যাসাইলাম চাচ্ছে। ইউরোপে অলরেডি দ্বিতীয় পর্যাায়ের অ্যাসাইলামের পর্যায়ে রয়েছে বাংলাদেশ। আমেরিকাতে প্রচুর লোকজন রাজনৈতিক আশ্রয় নিচ্ছেন। এসব প্রভাবের মধ্যে তারা পড়বে।

তবে আমি মনে করি যে আমেরিকা ইউরোপ আসলেই চাচ্ছে যে বাংলাদেশে একটা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসুক এবং ২০২১৪ কিংবা ২০১৮ সালের মতো নির্বাচন এখানে আর না হোক, একটা সুষ্ঠু নির্বাচন হোক।

শ্রোতাবন্ধুরা! বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিশিষ্ট সাংবাদিক ও বাংলাদেশ ডিফেন্স জার্নাল পত্রিকার প্রধান সম্পাদক আবু রুশদের সাক্ষাৎকার শুনছেন। ফিরছি খুব শিগগিরি আমাদের সাথেই থাকুন।

রেডিও তেহরান: আবারও ফিরে এলাম সাক্ষাৎকারে। জনাব আবু রুশদ, আপনি জানেন যে , বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্প্রতি আমেরিকা সফর করেছেন এবং তিনি বলেছেন আমেরিকা যেমন বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দেখতে চায়, আমরাও তেমনি সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাহলে ফাঁকটা কোথায়? পররাষ্ট্রমন্ত্রী বক্তব্যকে আপনি কিভাবে দেখবেন?

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠক

আবু রুশদ: দেখুন, আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এককথা বলে আমদের সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে আবার আরেক কথা বলা হয়। সংসদে আমেরিকাকে নিয়ে কীসব কথা বলা হয়েছে সেসব আসলে কূটনৈতিক কিংবা শিষ্টাচারমূলক ভাষা নয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন আমেরিকায় মি. ব্লিকেনের সাথে দেখা করতে যাচ্ছিলেন তার আগে একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি বলেছেন যে, মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হচ্ছে ভণ্ডদের আখড়া। যেটাকে ভণ্ডদের আখড়া বললেন সেখানে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কেন গেলেন? আমাদের দেশ কেন ওখানে আমাদের নির্বাচন নিয়ে কথা বলছেন? এইসব প্রশ্ন এখানে আসবে। আমাদের এখানের পরিস্থিতি নিয়ে পশ্চিমারাসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশগুলো দারুণ ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। আমি একজন সাংবাদিক হিসেবে বলছি যে আমাদের সংবাদ মাধ্যম এবং সাংবাদিকরা এসব নিয়ে অত্যন্ত বিব্রতকার অবস্থায় আছি। আমরা একটা ভীতির মধ্যে আছি। এখন এসব বিষয়গুলো তো দূর করতে হবে।

রেডিও তেহরান: আবু রুশদ, বাংলাদেশের নির্বাচন ও রাজনীতির নানা বিষয় নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে বিভিন্ন মহলে। আপনি যেকথা বললেন, দায়িত্বশীল কোনো এক ব্যক্তি বললেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় ভণ্ডদের আখড়া। প্রশ্ন ওঠে তাহলে এই দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা সেখানে যাচ্ছে কেন?  যাহোক, আপনি নির্বাচনী ফাঁক নিয়ে কথা বলছিলেন-

আবু রুশদ: দেখুন, ফাঁকটা তো ঐ জায়গাতেই যে, আমরা ঠিকভাবে কমিটেড কি না! যদি আমরা কমিটেড হতাম তাহলে আমরা বিরোধী দলের ওপরে কেন মামলা মকদ্দমা বজায় রেখেছি। আমি সম্প্রতি রিপোর্টে দেখলাম বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামসহ ২৩ জন বিএনপি নেতা-কর্মীর ওপর নজরদারি। সাড়ে চারলাখ শিক্ষকের ওপর নজরদারি। এগুলো কী! একটি গণতান্ত্রিক দেশের বৈশিষ্ট্য তো এগুলো না!

বাংলাদেশ তো আসলে গণতন্ত্রের জন্য স্বাধীন হয়েছিল। আমাদের বঙ্গবন্ধু গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছেন। কিন্তু আমরা বাস্তবে তার প্রয়োগ তো দেখছি না। একটি নিয়ন্ত্রিত সমাজ একটি নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্র ব্যবস্থা আমাদের দেশে চলছে। এই দেশ চলছে প্রশাসন কেন্দ্রীক, নিরাপত্তাবাহিনী কেন্দ্রীক ও গোয়েন্দা কেন্দ্রীক! এগুলোকে তো বন্ধ করতে হবে। আমেরিকা যেটি চাচ্ছে আমরা সেগুলো মুখে বলছি মাত্র কিন্তু কাজে এখনও সেগুলো দেখতে পাচ্ছি না।

রেডিও তেহরান: আপনার কথার রেশ ধরেই জানতে চাইব, যখন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমেরিকা সফর করছিলেন তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে বক্তব্য দিয়েছেন যে আমেরিকা চাইলে যেকোন দেশে সরকার পাল্টে দিতে পারে। প্রধানমন্ত্রী কেন এই বক্তব্য দিলেন এবং তিনি কোন কিছু আশঙ্কা করছেন কিনা? আপনার বিশ্লেষণ কি বিষয়টি নিয়ে?

আবু রুশদ: দেখুন, একটা দেশের সর্বোচ্চ ব্যক্তি বা প্রধানমন্ত্রী এবং সবচেয়ে বড় কথা উনি বঙ্গবন্ধু কন্যা। উনি যখন এই কথাটি বললেন, কেন বললেন এবং কি উদ্দেশ্যে বলেছেন সেটি তো আর আমি বলতে পারব না। তবে জিনিষটি এই সিগনিফিক্যান্ট যে উনি আমেরিকাকে টু দি পয়েন্ট বলেছেন। কিন্তু এই সমস্ত সরকার পরিবর্তন কী শুধু আমেরিকাই করে? আমাদের প্রতিবেশী কোনো রাষ্ট্র কী এর আগে এরকম কোনো কিছু করেনি! এসব বিষয় তো ওপেন সিক্রেট। চীনও এখন বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন কার্যকলাপ করছে। রাশিয়ানরা আফ্রিকাতে অনেক বিক্ষিপ্ত অবস্থা তৈরি করেছে। আমেরিকানরা অবশ্যই পৃথিবীর এক নম্বর শক্তি। তারা হয়তো চাইলে অনেক কিছুই করতে পারেন। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কি আমেরিকানরা আমাদের কোনো ক্ষতি করেছে বলে তো আমি মনে করতে পারি না। আমাদের নিরাপত্তার জন্য তারা সহায়তা করেছে, ১৯৯১ সালে যখন বাংলাদেশে বড় ঘূর্ণিঝড় হয়েছে তখন তাদের মেরিনটিম পুরো একটা জাহাজ নিয়ে চলে এসেছে এখানে আমাদেরকে তারা ট্রেনিং করিয়েছে, জাতিসংঘ বাহিনীতে আমাদের বাহিনীর সেনাদেরকে নিয়ে যাওয়ার সহায়তা করেছে। আমাদেরকে তারা অনুদান দেয়। এসব বিষয়গুলো তো আমাদেরকে দেখতে হবে। শুধু তারা আমাদের দেশে গণতন্ত্র চাচ্ছে- এখন কেউ যদি মনে করে যে এটা বিরোধী দল চাচ্ছে বিএনপি বা জামায়াতে ইসলামকে ফেসিলেটেড করছে এজন্য আমাকে আমেরিকার বিরুদ্ধে বলতে হবে এটা তো আসলে ঠিক না।

রেডিও তেহরান: জনাব আবু রুশদ, বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং তা নিয়ে বিভিন্নমহলের তৎপরতা, বক্তব্য, আলোচনা এবং বাস্তবতা নিয়ে আপনি আলোচনা করছিলেন। আমাদের হাতে আজ আর সময় না থাকায় আজ এখানেই শেষ করতে হচ্ছে। আমাদেরকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে আবারও অশেষ ধন্যবাদ।

শ্রোতাবন্ধুরা! আগামী সপ্তায় আমরা এ বিষয় নিয়ে আজকের অতিথির সাথেই কথা বলব। আলাপনের আগামী পর্বটিও শুনতে আমাদের সাথেই থাকছেন বলে আশা রাখছি। সবাই ভালো সুস্থ ও নিরাপদ থাকুন।#

পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/২১

ট্যাগ