মে ০৮, ২০২৩ ১৯:৫৮ Asia/Dhaka

আজকের আলোচনায় আমরা ইরানের আরেকজন প্রখ্যাত মনীষী খাজা নাসিরুদ্দিন তুসির জীবনি ও তার গবেষণা কর্ম নিয়ে আলোচনা করবো। তিনি ইরানের সবচেয়ে প্রভাবশালী বিজ্ঞানী ও পণ্ডিতদের অন্যতম। তিনি এই নামে বিখ্যাত হলেও তাঁর আসল নাম হল মুহাম্মদ ইবনে হাসান জাহরুদি তুসি। তিনি জন্ম নিয়েছিলেন উত্তর-পূর্ব ইরানের তুস শহরে খ্রিষ্টীয় ১২০১ সনের ফেব্রুয়ারি মাসে। খাজা নাসিরুদ্দিন তুসির কয়েকটি লেখায় তুস শহরকে তার জন্মস্থান হিসেবে উল্লেখ করা হলেও হামদুল্লাহ মোস্তোফিসহ কোনো কোনো ইতিহাসবিদ বলেছেন, খাজা নাসিরুদ্দিন তুসি আসলে ওয়ারশাহ

খাজা নাসিরুদ্দিন তুসির পূর্বপুরুষরা তুসে আসেন এবং এই তুসেই তার জন্ম হয়েছিল বলে তিনি তুসি নামে খ্যাত হন। খাজা নাসিরুদ্দিন তুসির বাবার নাম ছিল মুহাম্মদ ইবনে হাসান। তিনি ছিলেন একজন ধর্মতাত্ত্বিক ও হাদিস-বিশেষজ্ঞ। খাজা তার বাবার কাছেই কুরআন ও ধর্মতত্ত্বসহ নানা শাস্ত্রের প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করেন। আর নিজের চাচা নুরুদ্দিন মুহাম্মদ ইবনে আলীর কাছে পড়েন হাদিস শাস্ত্র। এরপর তিনি যুক্তিবিদ্যা ও দর্শন পড়েন এবং ধর্মীয় শিক্ষা ও বিজ্ঞানের প্রচলিত নানা শাখায় ব্যাপক দক্ষতা অর্জন করেন।

খাজা নাসিরুদ্দিন তুসি ক্যালকুলাস, জ্যামিতি ও অ্যালজাবরাতেও দক্ষতা অর্জন করেন। সঙ্গীত শাস্ত্রও আয়ত্ত করেছিলেন তিনি। এরপর তিনি যৌবনেই জন্মভূমি ছেড়ে চলে যান নিশাপুরে। খাজা নাসিরুদ্দিন সেখানে গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যায়ও পারদর্শী হন। উত্তর-পূর্ব ইরানে অবস্থিত প্রাচীন খোরাসানের অন্যতম প্রধান শহর নিশাপুর ছিল কয়েক শতক ধরে মুসলিম বিশ্বের জন্য জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। এই মহান মনীষীর জীবদ্দশায়ও নিশাপুরের সেই খ্যাতি বজায় ছিল।  

খাজা নাসিরুদ্দিন তুসি নিশাপুরে অল্প কিছুকাল থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বহু শাখায় পারদর্শী হন। গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা ও ধর্মতত্ত্ব ছাড়াও আধ্যাত্মিক রহস্য, যুক্তিবিদ্যা, দর্শন, নীতি শাস্ত্র, সাহিত্য ও চিকিৎসা-বিজ্ঞানে অসাধারণ পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন খাজা নাসিরুদ্দিন তুসি। এ ছাড়াও তিনি গড়ে তুলেছিলেন অনেক জ্ঞানী-গুণী ও বিজ্ঞানী। পণ্ডিত ও বিজ্ঞানীদের অনেকেই খাজা তুসিকে দার্শনিকদের প্রধান বলে অভিহিত করেছেন।

খাজা নাসিরুদ্দিন তুসি ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী, ধৈর্যশীল, দয়ালু ও সুদর্শন। সুসংস্কৃতির বিকাশ ও দরিদ্রকে সহায়তার জন্য তিনি সম্ভাব্য সব কিছুই করতেন। খাঁটি ইসলাম তথা বিশ্বনবী (সা)’র পবিত্র আহলে বাইতের আদর্শ প্রচারের জন্য তিনি ব্যাপক প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন।

খাজা নাসির উদ্দিন তুসি নিশাপুরে যখন পড়াশুনা শেষ করছিলেন তখন মোঙ্গল হামলার শিকার হয় এই শহর।  বর্বর মোঙ্গলরা নিশাপুর ছাড়াও ইরানের শহরগুলোকে একের পর এক গুড়িয়ে দেয়। কেবল ইসমাইলি দূর্গগুলোই এই সর্বগ্রাসী মঙ্গল হামলাগুলোর সামনে রুখে দাঁড়িয়েছিল।

এ সময় ইসমাইলি রাজা ছিলেন আলাউদ্দিন মুহাম্মদ। আর কুহেস্তানের গভর্নর ছিলেন নাসিরুদ্দিন মুহতাশাম। তিনি জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিস্তারে ব্যাপক উৎসাহ দিতেন এবং বিজ্ঞান-গবেষণায় পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। মুহতাশাম খাজা নাসির উদ্দিন তুসিকে কুহেস্তানে আসার আমন্ত্রণ জানান। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে খাজা নাসির উদ্দিন এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। তিনি দীর্ঘকাল সেখানে থাকেন এবং এখানেই তিনি অধ্যয়নের পাশাপাশি কয়েকটি বইও লিখেছেন। তবে খাজার কয়েকটি লেখনী থেকে জানা যায় ইসমাইলি দূর্গগুলোতে থাকার সময় নানা কষ্ট ও দুর্ভোগের শিকার হয়েছিলেন এই মহান মনীষী এবং তিনি অনিচ্ছা সত্ত্বেও এইসব দুর্গে বসবাস করতে বাধ্য হয়েছিলেন।

এ সময় ইসমাইলি রাজা আলাউদ্দিন তার রাজ্যে খাজার উপস্থিতির কথা জানতে পারেন এবং তাঁকে রাজ-দরবারের সদস্য হওয়ার প্রস্তাব দেন। খাজা নাসির উদ্দিন এই প্রস্তাব মেনে নেন। তিনি এখানে গণিত বিষয়ে কয়েকটি বই লিখেছিলেন।

এই যুগে ইরানের শহরগুলো মোঙ্গল হামলায় বিপর্যস্ত ও বিধ্বস্ত হয়েছিল। তারা জনগণের ওপর নির্যাতন ও নিপীড়ন চালাচ্ছিল। মোঙ্গলরা বাগদাদ ও ইসমাইলি দুর্গগুলোও দখল করতে চেয়েছিল। আর এ লক্ষ্য অর্জন করতে মোঙ্গল শাসক হালাকু খান এ অঞ্চলে এক লাখ বিশ হাজার সেনার এক শক্তিশালী বাহিনী জড়ো করে। 

প্রথমে কুহেস্তানের গভর্নর মুহতাশাম মোঙ্গল সেনাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। এরপর হালাকু খান একের পর এক ইসমাইলি দুর্গ দখল করে। হালাকু খান এক দূত পাঠিয়ে ইসমাইলি রাজা রোকনউদ্দিন খোরশাহকে আত্মসমর্পণ করতে বলে। অবশেষে তিনিও হালাকু খানের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। হালাকু খান খাজা নাসির উদ্দিন ও তার পরিবার-পরিজনের কোনো ক্ষতি করেনি। কারণ, প্রথমত এ সময় চিকিৎসক হিসেবেও খাজা নাসির উদ্দিন এবং তাঁর সন্তানদেরও বেশ নাম-ডাক ছিল।  দ্বিতীয়ত তারা গণহত্যা ঠেকানোর জন্য মোঙ্গল সেনাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে ইসমাইলি রাজাকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। রাজাও তাদের পরামর্শেই আত্মসমর্পণ করেন।

বলা হয় হালাকু খান অত্যন্ত নিষ্ঠুর ও নির্দয় হওয়া সত্ত্বেও জ্ঞান-বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক ছিল এবং রসায়ন ও জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ের জ্ঞান অর্জনে আগ্রহী ছিল। তাই হালাকু খাজা নাসির উদ্দিনকে তার দরবারের সদস্য করে। নানা বিষয়ে, বিশেষ করে গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যায় পাণ্ডিত্যের অধিকারী খাজা নাসির উদ্দিন ছিলেন হালাকুর দরবারের প্রভাবশালী সদস্য। তিনি নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে হালাকু খানকে পরামর্শ দিতেন। 'জ্ঞান-বিজ্ঞানের ইতিহাস' শীর্ষক বইয়ে জর্জ সার্টন লিখেছেন, খাজা নাসির উদ্দিন তুসি হালাকু খানের ওপর গভীর প্রভাব রেখেছিলেন। হালাকু সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েই তুসির সঙ্গে শলা-পরামর্শ করত। কারণ, হালাকু নানা বিষয়ে তুসির ব্যাপক পাণ্ডিত্য সম্পর্কে সচেতন ছিল'।

খাজা নাসির উদ্দিন মঙ্গল হামলার সময় নানা বিজ্ঞানে পারদর্শী একজন পণ্ডিত বা বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছিলেন। এ সময় তিনি নিশাপুর ছেড়ে চলে যান ইসমাইলি দূর্গে। সেখানে তিনি কয়েকটি বই লিখেছিলেন। মোঙ্গল কমান্ডার হালাকু খান ইরান অভিযান শেষে  ও ইসমাইলিদেরকে বিতাড়িত করার পর খাজা নাসির উদ্দিনকে তার দরবারের সদস্য হওয়ার আমন্ত্রণ জানায়।

ইসমাইলিদেরকে দমনের পর হালাকু খান বাগদাদে হামলা চালিয়ে আব্বাসিয় রাজবংশকে ক্ষমতাচ্যুত করার সিদ্ধান্ত নেয়। খান এ বিষয়ে খাজা নাসির উদ্দিনের পরামর্শ চায়। খাজা এ বিষয়ে আগেই ভেবেছিলেন। তিনি তার দূরদর্শিতার মাধ্যমে বুঝতে পেরেছিলেন যে আব্বাসিয় শাসকরা ভবিষ্যতে নানা সংকটের শিকার হবেন এবং ইরাক খুব সহজেই মঙ্গলদের করায়ত্ত হবে। হালাকু খাজাকে বিশ্বাস করতেন এবং বাগদাদ অবরোধের পদক্ষেপ নেন। অবশেষে ৬৫৬ হিজরিতে আব্বাসিয় খলিফা ও তার তিন পুত্র এবং অন্যান্য বড় কর্মকর্তাদের বাগদাদ থেকে বিতাড়িত করে মঙ্গলরা। এভাবে বাগদাদ মোঙ্গলদের হস্তগত হয়। হালাকু খান খলিফাকে হত্যার নির্দেশ দেন।#

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

 

ট্যাগ