মে ১২, ২০২৩ ১৯:৩৯ Asia/Dhaka

ড. মাহমুদ হেসাবির দিক নির্দেশনায় ১৯৩১ সালে 'ইরানিয়ান ফিজিক্স সোসাইটি'কে আরো উন্নত ও সমৃদ্ধ করার জন্য 'ফিজিক্স এ্যান্ড কেমেস্ট্রি সোসাইটি অব ইরান' নামে প্রথম একটি সংস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়। বিজ্ঞান গবেষণা সংক্রান্ত নব গঠিত এই সোসাইটির অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল ইরানে পদার্থবিদ্যা সংক্রান্ত গবেষণা ও শিক্ষার মানকে উন্নত করা এবং শিক্ষাবিদদের জ্ঞান ও তথ্যকে আরো সমৃদ্ধ করা। পদার্থ বিজ্ঞান এমন একটি বিষয় ইরানে যার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে এবং আধুনিক যুগেও এ ক্ষেত্রে ইরানি গবেষকরা কাজ করে যাচ্ছেন। আজকের অনুষ্ঠা

প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ বস্তুর আকার, গঠন ও এর বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বোঝার বা জানার চেষ্টা করতো। তারা এটাও অনুসন্ধানের চেষ্টা করতো কেন একেক বস্তুর গঠন প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য একেক রকমের? কেন কোন কোনো বস্তুর ওজন বেশি হয়? অ্যারিস্টটলের আগে পদার্থবিদ্যা সম্পর্কিত গবেষণার বেশিরভাগই জ্যোতির্বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে করা হয়েছিল। কিন্তু জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ে যেসব প্রশ্ন উত্থাপিত হতো তার বেশিরভাগ জবাব ছিল কুসংস্কারাচ্ছন্ন অথবা যেসব বৈজ্ঞানিক জবাব পাওয়া যেত তার বেশিরভাগই ছিল ভুলে ভরা।

খ্রিস্টিয় ১৭ শতকের আগে ইতালির পদার্থবিজ্ঞানী, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, গণিতজ্ঞ ও দার্শনিক গ্যালিলিও পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণালব্ধ তত্ত্বিক জ্ঞানকে বৈধতা দেওয়ার জন্য বিভিন্ন পরীক্ষার ফলাফল ব্যবহার করেছিলেন। তিনি বিভিন্ন গবেষণার ফলাফলকে তাত্বিক কাঠামোর মধ্যে আনতেন এবং সেই ফরমুলাকে ব্যবহার করে তিনি বেশ কয়েকটি সফল পরীক্ষা চালান। গ্যালিলিও পর নিউটনও গবেষণা ক্ষেত্রে তার নিজস্ব তত্ব বা থিওরি তুলে ধরেন এবং তার পরীক্ষা ও গবেষণাকর্মও ছিল সফল।

এইভাবে, বৈজ্ঞানিক এবং ব্যবহারিক ক্ষেত্রে পদার্থবিজ্ঞান বিশেষ স্থান অধিকার করে নেয় এবং শুরু হয় নতুন যুগের সূচনা। দিনকে দিন পদার্থবিজ্ঞান আরো উন্নত ও সমৃদ্ধ হতে থাকে এবং এর বিষয়বস্তু তথা শাখাপ্রশাখাগুলো আরো বিস্তৃত হতে থাকে। বর্তমানে পদার্থবিজ্ঞান এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে এর সূত্রগুলোতে ক্ষুদ্রতম পারমাণবিক মাত্রা থেকে মহাকাশের জটিল সব বিষয় পর্যন্ত অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বর্তমানে পদার্থবিদ্যা অন্যান্য বিজ্ঞানের সাথে শক্তিশালী শেকলের মতো যুক্ত হয়েছে এবং খুব দ্রুত গতিতে এর উন্নয়ন ঘটছে।

ইরানে, প্রাচীনকাল থেকেই আজ অবধি গবেষকরা পদার্থবিজ্ঞানকে মৌলিক বিজ্ঞানগুলোর মধ্যে একটি হিসাবে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে আসছেন। বহু চিন্তাবিদ ও গবেষক এ ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন। আধুনিক ইরানে বিশ্ববিদ্যালয়ের  নামকরা একজন পদার্থবিজ্ঞানী হচ্ছেন অধ্যাপক মাহমুদ হেসাবি। পদার্থবিজ্ঞানে গবেষণা ও অগ্রগতিতে তিনি অসামান্য অবদান রেখেছেন।

মাহমুদ হেসাবি ১৯০৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাজধানী তেহরানে জন্ম গ্রহণ করেন। শিশু জীবনের প্রথম চার বছর তিনি তেহরানে কাটিয়েছেন এবং সাত বছর বয়সে লেবাননের রাজধানী বৈরুতে প্রাইমারি স্কুলে পড়ালেখা শুরু করেন। একই সময়ে তিনি তার মায়ের কাছ থেকে ধর্মীয় শিক্ষা এবং ফারসি সাহিত্য শিখেছিলেন। তিনি কোরআন শরীফ ও দিওয়ানে হাফিজ পুরাই মুখস্ত বলতে পারতেন। এ ছাড়া শেখ সাদির বুস্তান ও গোলেস্তান, ফেরদৌসির শাহনামা, মাওলানা রুমির মাসনাভি প্রভৃতি খুব ভালোভাবে রপ্ত করেছিলেন। প্রাইমারি ও হাইস্কুল জীবন শেষ করে তিনি বৈরুতে আমেরিকান কলেজে পড়াশোনা অব্যাহত রাখেন। তিনি মাত্র ১৭ বছর বয়সে সাহিত্যে অনার্স এবং ১৯ বছর বয়সে জীববিজ্ঞানে অনার্স পড়া শেষ করেন। এরপর অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী মাহমুদ হেসাবি বৈরুতে ফ্রান্সের পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকৌশল অনুষদ থেকে সড়ক ও নির্মাণ ক্ষেত্রে স্লাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এ ছাড়া তিনি চিকিৎসা, গণিতশাস্ত্র ও জ্যোতির্বিদ্যায়ও জ্ঞানার্জন করেন। ২৫ বছর বয়সে তিনি পদার্থবিজ্ঞানে ‌উচ্চতর ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন।

আমেরিকার অত্যাধুনিক পরীক্ষা কেন্দ্রগুলোতে অধ্যাপক মাহমুদ হেসাবি পছন্দের কাজ বা চাকরি পাওয়ার পরও তিনি ইরানে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। ইরানে ফিরে আসার পর দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে তিনি বিরাট অবদান রাখেন। উদাহরণ স্বরূপ তিনি প্রথম ইরানে অবকাঠামো নির্মাণের জন্য জমির মাপজোক ও জরিপ কাজ আধুনিকায়ন করা, প্রথম অত্যাধুনিক রাস্তা নির্মাণ কৌশল, প্রথম যাযাবরদের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন করা, উচ্চতর জ্ঞানচর্চা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, শিক্ষক সমিতি গঠন করা, প্রথম বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের হাসপাতাল নির্মাণ, প্রথম রেডিও স্টেশন স্থাপন, প্রথম আবহাওয়া কেন্দ্র স্থাপন, ইরানের স্থানীয় সময় নির্ধারণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে অবদান রাখেন।

এ ছাড়া, তিনি ইরানে প্রথম রেডিওলজি ডিভাইস স্থাপন ও তার চালু করেন। তিনি শিক্ষা বিষয়ক উচ্চ পরিষদ গঠন, ইরানে প্রথম আধুনিক মানমন্দিরের ভিত্তি স্থাপন, প্রথম জলবিদ্যুত উৎপাদনের জন্য টারবাইন তথা জেনারেটরের ব্যবহার শুরু করেন। অধ্যাপক মাহমুদ হেসাবি ফার্সি ভাষা বিষয়ক সংস্থা প্রতিষ্ঠা এবং তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনার বিধিমালা প্রণয়নে অবদান রেখেছিলেন। তিনি মোসাদ্দেক সরকারের মন্ত্রিসভার সংস্কৃতিমন্ত্রীও ছিলেন কিছুদিন।

অধ্যাপক মাহমুদ হেসাবি ডাবল তরঙ্গের ব্যাখ্যা সম্বলিত কানুন গ্রন্থ লিখে খ্যাতি অর্জন করেন। এ ছাড়া হাইস্কুলে পাঠযোগ্য পদার্থবিজ্ঞানের ওপর তিনি বই লিখেন। আর্থিক ব্যবস্থাপনা নিয়েও তিনি একটি গ্রন্থ রচনা করেন। আন্তর্জাতিক ম্যাগাজিনে বিজ্ঞান সংক্রান্ত অনেক নিবন্ধ লিখেও তিনি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। অধ্যাপক মাহমুদ হেসাবি ইংরেজি, আরবি, ফ্রান্স ও জার্মানি ভাষায়ও পূর্ণ দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। এ ছাড়া তিনি বেশ কিছু নিবন্ধন ও গবেষণা কাজে সংস্কৃতি, পাহলাভি, গ্রিক, ইতাল, রুশ ও তুর্কি ভাষার ব্যবহার করেছে। ১৯৮৭ সালে ইরানের ফিজিক্স কংগ্রেসের পক্ষ থেকে তিনি 'আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের জনকের উপাধি লাভ করেন। তিনি ১৯৯০ সালে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সোসাইটির পক্ষ থেকে 'দ্যা ফার্স্ট সায়েন্টিফিক ম্যান অব দ্যা ওয়ার্ল্ড' মর্যাদার স্বীকৃতি পান। এর পাশাপাশি অধ্যাপক মাহমুদ হেসাবি তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকেও শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের মর্যাদা পেয়েছিলেন। ইরানের এই প্রখ্যাত গবেষক ও শিক্ষাবিদ ড. মাহমুদ হাসবী ১৯৯২ সালের সেপ্টেম্বরে হৃদরোগে  আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার জন্য জেনেভা বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে ভর্তি হন এবং সেখানেই তিনি মারা যান। #

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/১২

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ