সন্তানদের শিক্ষাদানে স্বাধীনতা ও নিয়ন্ত্রণ দুই-ই জরুরি!
সুখের নীড়-৪৬ (সন্তানদের শিক্ষাদানে অতিরিক্ত কড়াকড়ি বা শিথিলতা)
আমাদের সন্তান বা নতুন প্রজন্মকে সুশিক্ষিত ও যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হলে পরিবারেই তাদেরকে সব ধরনের সুশিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করা জরুরি।
সমাজের উন্নত চিন্তাধারা, রুচি, প্রথা ও বিশ্বাসগুলো পরিবারের মাধ্যমেই এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়ে। মোট কথা সন্তান কতটা সুশিক্ষিত, সামাজিক ও যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে তা নির্ভর করে পরিবারের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ওপর।
অতিরিক্ত কড়াকড়ি ও অতিরিক্ত শিথিলতা প্রদান সন্তানকে যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার পথে মোটেই সহায়ক নয়। যেসব বাবা মা নিজেরা কঠোরতার মধ্য দিয়ে বড় হয়েছেন তারাই সন্তানদের ওপর নিজস্ব রুচি, বিশ্বাস এবং অভ্যাস জোর করে চাপিয়ে দিতে চান। অন্যদিকে সন্তানদের আলালের ঘরের দুলালের মত চরম স্বাধীনতা দেয়া বা সব কিছুতে নির্ভরশীল করে রাখাও সন্তান প্রতিপালনের ভুল নীতি। প্রত্যেক বাবা-মা বা পরিবারের প্রধানের উচিত এ দুই চরমপন্থা এড়িয়ে চলা।
অনেক বাবা-মা অতীতে সন্তানদের স্কুলে ভর্তি করার সময় শিক্ষককে বলতেন, আমার এই সন্তানকে আপনাদের ওপর ছেড়ে দিলাম। তাদেরকে সুশিক্ষা দেয়ার জন্য প্রয়োজনে সব ধরনের কড়াকড়ি করবেন। মনে করুন যে তাদের শরীরের গোশত হল আপনাদের কেবল হাঁড়টা আমাদের! অর্থাৎ প্রয়োজনে বেদম প্রহারও করতে পারেন।
আসলে সন্তানদের সুশিক্ষিত করার জন্য যেমন খুব বেশি কড়াকড়ির মধ্যে রাখা যেমন ভালো নয় তেমনি এর বিপরীতে একেবারে লাগাম ছেড়ে দিয়ে আদর-যত্ন ও ভালবাসার মধ্য দিয়ে শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থাও সব বয়সে ও সব ক্ষেত্রে কার্যকর নয়। তাই এসব ক্ষেত্রে বাবা-মা বা প্রশিক্ষকদের উচিত মধ্যপন্থা অবলম্বন করা। স্বৈরতান্ত্রিক মানসিকতা নিয়ে কড়া শাসনের মাধ্যমে শিশুদের সুশিক্ষিত করার ধারণা অনেক ক্ষেত্রেই সন্তানদের জন্য বুমেরাং হতে পারে। এ ধরনের পদ্ধতির শিকার অনেক সন্তান ঘর থেকে পালিয়ে যায় এবং কোনো সহানুভূতিশীল ব্যক্তির আশ্রয় খুঁজতে থাকে। কখনও কখনও তারা প্রতারণার শিকার হয়ে পথভ্রষ্ট বা বিভ্রান্ত ব্যক্তিদের দলে স্থান নেয়।
পরিবারকে সন্তানদের জন্য সেনা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মত কঠোর শাস্তি ও নিয়মানুবর্তিতার ঘাঁটি হিসেবে গড়ে তুলবেন না। নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলা জীবনে কেন জরুরি তা সুন্দর ও মিষ্টি ভাষায় সন্তানদের বুঝিয়ে দিলে তারা নিজেরাই এইসব বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠবে। প্রত্যেক বিবেকবান মানুষের মত শিশু সন্তানদেরকেও যুক্তিবাদী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আলোচনা ও পরামর্শ নেয়ার শিক্ষা দেয়া জরুরি।
কোনো কোনো পরিবার শিশুদের সুশিক্ষিত করার ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ শিথিলতার নীতি গ্রহণ করেন। তারা সব কিছুকেই শিশু-কিশোরদের ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দেন। ফলে এ ধরনের সন্তান ননির পুতুল বা আলালের ঘরের দুলালের মতই অযোগ্য হয়ে বেড়ে ওঠে। সন্তানের অযৌক্তিক আবদার ও ইচ্ছাগুলোর কাছে বাবা-মা বার বার নতজানু হওয়ায় এ ধরনের সন্তান উচ্চাভিলাষী হয়ে ওঠে। কারণ, তারা দেখতে পায় যে চাওয়া মাত্রই বাবা-মা যখন তাদের কাছে সব কিছু এনে দিচ্ছেন তাহলে তাদের আর স্বনির্ভর, স্বশিক্ষিত বা সক্রিয় কর্মী হওয়ার দরকারইবা কি? মোট কথা অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানদের পরিপূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া যেমন বিপজ্জনক তেমনি তাদের স্বাধীনতা পুরোপুরি কেড়ে নেয়াও যোগ্য ও সুসন্তান হিসেবে তাদের বেড়ে ওঠার পথে বড় ধরনের বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
যেসব সন্তান পরিবারে অতিরিক্ত আদর-যত্নের মধ্যে বড় হয় তারা সমাজে নানা ধরনের প্রতিকূলতার মোকাবেলায় ধৈর্য ধরতে পারে না বরং সহজেই গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেয় এবং বিপদ-আপদে সহজেই ভেঙ্গে পড়ে বা হতাশ হয়ে যায়। এসব সন্তান অনেক সময় সমাজের অনৈতিক ও মন্দ ধারার সংস্কৃতির শিকার হয় খুব সহজেই।
সন্তানদেরকে ত্যাগ, ধৈর্য ও সহনশীলতার মত গুণগুলো শেখানোর সবচেয়ে ভালো স্থান হচ্ছে পরিবার। এসব বিষয় তাদেরকে ভালোভাবে শেখানো না হলে তারা কর্ম জীবনে বা সমাজের অন্য লোকদের সঙ্গে মেশার সময় স্বার্থপরের মতই আচরণ করতে অভ্যস্ত হবে।
আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী –আ. বলেছেন, আপনার সন্তানদেরকে নিজস্ব স্বভাব-চরিত্র ও রীতির আলোকে শিক্ষিত করার চেষ্টা করবেন না। কারণ, তারা আপনার যুগের লোক নয়, বরং তারা অন্য যুগের জন্য সৃষ্টি হয়েছে।
আপনার সন্তান কোন্ বিষয়ে উচ্চ পর্যায়ের শিক্ষা নিতে চায় বা কোন্ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হতে চায় তা তাকেই নির্বাচন করতে দিন। আপনি কেবল তাকে পরামর্শ দিতে পারেন। কিন্তু আপনি তাকে জোর করে প্রকৌশল বা চিকিৎসা শাস্ত্র পড়ার জন্য বাধ্য করতে পারেন না। সব বিষয়ে সন্তানের ওপর খবরদারি করা বা নজরদারি করা হলে সন্তান ব্যক্তিত্বহীনভাবে বড় হয়ে উঠবে। অধ্যাপক শহীদ মুর্তাজা মুতাহ্হারির ভাষায় সন্তানকে একটা মাত্রা পর্যন্ত দিক নির্দেশনা দেয়া ও আদেশ-নির্দেশ দেয়া যেমন জরুরি তেমনি তাকে একটা পর্যায় পর্যন্ত স্বাধীনতা দেয়াও জরুরি।
মনে রাখা দরকার মানুষের শরীরের ওপর কড়াকড়ি করা যায়, কিন্তু আত্মা বা মনের ওপর কড়াকড়ি করা যায় না। জীবনকে ঘুরিয়ে আনা যায় না এবং জীবনকে বিগত দিনের বেড়াজালে আটকেও রাখা যায় না। সন্তান আমাদের জন্য আল্লাহর নেয়ামত। আমরা তাদের মালিক নই, আমরা তাদের সংরক্ষণকারী মাত্র। #
পার্সটুডে/এমএএইচ/০৩
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।