জুন ০৪, ২০২৩ ২০:২০ Asia/Dhaka

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় সম্প্রতি পুলিশ এবং বিনপি'র সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছে। দেশটির আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। এ প্রসঙ্গে আমরা আজ কথা বলেছি সিনিয়র সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ভাষ্যকার আবদুল আউয়াল ঠাকুরের সঙ্গে।

রেডিও তেহরানকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বললেন, বর্তমান সময়ে সরকারের পায়ের নিচে মাটি সরে গেছে। সরকারের সাংগঠনিক ভিত্তি মূলত দুর্বল হয়ে গেছে।

বিশিষ্ট এই রাজনৈতিক ভাষ্যকার বলেন, একজন মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে যদি মেনে নেওয়া না হয় তার অর্থই হচ্ছে দেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে মেনে না নেওয়া এবং মানুষের অধিকারকে অস্বীকার করা। আর এটি হচ্ছে এমন একটি রাজনৈতিক প্রবণতা যা মানুষকে স্বৈরাচারে রুপান্তরিত করে। এই ধরণের প্রবণতা সবসময়ই অগণতান্ত্রিক এবং একটি ফ্যাসিবাদি মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ।

পুরো সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো। এটি উপস্থাপনা ও তৈরি করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।

রেডিও তেহরান:  ঢাকায় সম্প্রতি পুলিশ-বিএনপি সংঘর্ষ হয়েছে। বহুদিন পর বিএনপি'র সঙ্গে এই সংঘর্ষ হলো। আপনার কী মনে হয় রাজনীতি আবার সংঘাতময় হয়ে উঠল?

আবদুল আউয়াল ঠাকুর: ধন্যবাদ আপনাকে। রাজনীতি সংঘাতময় হয়ে ওঠার পূর্বাভাস সম্পর্কে ঢাকার একটি বহুল প্রচারিত দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছিল সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচন পর্যন্ত হার্ডলাইনে যাবে। আর এর মূল কারণ হচ্ছে বিএনপির আন্দোলনমূখী বাস্তবতা। বিএনপির আন্দোলনমুখী বাস্তবতাকে সরকার কীভাবে দেখছে সেটি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভর করে কিন্তু বর্তমান অবস্থাটা হচ্ছে এই যে, সরকারের পায়ের নিচের মাটি সরে গেছে। সরকারের নিজস্ব সাংগঠনিক ভিত্তি মূলত দুর্বল হয়ে গেছে। গত কয়েকটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেখা গেছে তারা নিজেরাই আন্তঃকলহ ও অর্ন্তদ্বন্দ্বের মধ্যে লিপ্ত হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে তাদের উচ্চ পর্যায় পর্যন্ত বৈঠক হয়েছে এবং মিটমাটের চেষ্টা হচ্ছে। এমনকি তাদের অভ্যন্তরেও এমন কিছু খবর প্রকাশিত হচ্ছে তা তাদের নিজস্ব রাজনীতির জন্য উদ্বেগজনক। কার্যত তাদের নিজেদের উদ্বেগকে ধামাপচাপা দিয়ে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে বিএনপির ওপর আক্রমণাত্মক পরিকল্পনার লক্ষ্যই হচ্ছে রাজনৈতিকবাবে নিজেদেরকে আড়াল করার অতি অশুভ প্রবণতা।

রেডিও তেহরান: পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত ছবিতে দেখা গেছে পুলিশ বিএনপির একজন কর্মীকে মাটিতে ফেলে গলা টিপে ধরে পেটাচ্ছে। পুলিশের এই আচরণ নিয়ে এরই মধ্যে নানামুখী সমালোচনা শুরু হয়েছে। আপনি কী বলবেন?

আবদুল আউয়াল ঠাকুর: দেখুন, বিষয়টিকে খুব গভীরভাবে দেখা দরকার। আমরা রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার কথা আমরা বলি। ১৯৭১ সালে যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করেছি, সংগ্রাম করেছি তাতে ত্রিশ লাখ মারা গেছে বলে আমরা মনে করি। আমাদের মানুষের রক্তদানের অন্যতম মৌলিক বৈশিষ্ট্য ছিল আমাদের মৌলিক অধিকার অর্জন করা। যার মধ্যে রয়েছে বাকস্বাধীনতা। আর যে বাকস্বাধীনতার জন্য মানুষ লড়াই করল তারপর আমরা যে সংবিধান পেলাম সেই সংবিধান মূলত ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের অনুবর্তি। অর্থাৎ ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে যতটুকু স্বাধীনতা স্বীকার করা হয়েছিল বর্তমান সময়ে সেটুকুও নেই। মূল প্রসঙ্গ বিএনপি নয়; মূল প্রসঙ্গ হচ্ছে মানুষকে মানুষ হিসেবে মেনে নেওয়া। এই ছবি এবং প্রবণতা প্রমাণ করে সরকার তার নাগরিককে মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়না। যেটি মৌলিক মানবিক অধিকার এবং আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সম্পূর্ণ বিপরীত ধারা। এখানে একজন মানুষ রাজনীতি করবে। হ্যাঁ রাজনৈতিক মতপার্থক্য মানুষে মানুষে থাকতেই পারে। একজন মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে যদি মেনে নেওয়া না হয় তার অর্থই হচ্ছে দেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে মেনে না নেওয়া এবং মানুষের অধিকারকে অস্বীকার করা। আর এটি হচ্ছে এমন একটি রাজনৈতিক প্রবণতা যা মানুষকে স্বৈরাচারে রুপান্তরিত করে। এই ধরণের প্রবণতা সবসময়ই অগণতান্ত্রিক এবং একটি ফ্যাসিবাদি মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ।

রেডিও তেহরান: মিউজিক বিরতির পর আবারও ফিরে এলাম সাক্ষাৎকারে। জনাব আবদুল আউয়াল ঠাকুর, সামনে জাতীয় নির্বাচন। সে নির্বাচন অনুষ্ঠানে নানামুখী শঙ্কা উদ্বেগ উৎকণ্ঠা রয়েছে। এর ভেতরে এই সংঘাত। অনেকের আশঙ্কা এই সংঘাত নির্বাচন পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। আপনার কি মনে হয়?

আবদুল আউয়াল ঠাকুর: দেখুন, এই সংঘাত এবং নির্বাচন পর্যন্ত যে কথাটি আপনি বললেন এই কথা দুটির মধ্যে যদি এবং কিন্তুর সমন্ময় আছে। আপনি যদি মনে করেন নির্বাচন এবং নির্বাচন পর্যন্ত তাহলে ধরতে হবে আপনি এর একটি সমাপ্তি রেখা টানতে চাচ্ছেন। অর্থাৎ নির্বাচনে সরকারের এমন কিছু নীল নকশা থাকতে পারে যেটা নির্বাচন হয়ে গেলে আর সংঘাতের প্রয়োজন হবে না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে  এখন পর্যন্ত মাঠে যতগুলো কথা রাজনৈতিক দলগুলে বলছে সেসব কথার মূল কথা হচ্ছে তারা বর্তমান সরকারে অধীনে নির্বাচনে যেতে রাজি না। যতক্ষণ পর্যন্ত না তত্ত্বাবধায়ক সরকার কিংবা নির্বাচনকালীন কোনো সরকার গঠিত না হয় ততক্ষণ তারা নির্বাচনে যাবে না। তবে এই সরকার নিয়ে ভিন্ন আলোচনা আছে। কেউ বলছেন নির্বাচন পূর্ব সরকার কেউ বলছেন নির্বাচনের মাঠ তৈরির সরকার। তবে যে ধরনের সরকারই হোক না কেন মূল কথা হচ্ছে বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন না করার জন্য কোনো না কোনোভাবে এক ধরনের রাজনৈতিক ঐক্যমত তৈরি হয়েছে। সরকারি দল ব্যতীত দেশের অন্যসব রাজনৈতিক দল এমনকি সরকারের অংশীদার জাতীয় পার্টি পর্যন্ত মনে করে এই সরকারের অধীনে নির্বাচন করা যাবে না। কারণ তাদের নেতারাই রাতের ভোট, কালো ভোট এসব কথা বলে নানা আলোচনা করেছে। সবকিছু মিলিয়ে নির্বাচন পর্যন্ত কথাটাকে নিয়ে আমি যদি একটু বিস্তৃত আলোচনায় যাই  তাহলে বলতে হবে যে আসলে নির্বাচনকে কীভাবে কে দেখছে! সরকার হয়তো  দেখছে একভাবে অন্যদিকে বিরোধী দল দেখছে আরেকভাবে। ফলে নির্বাচন বিষয়টিকে নিয়ে এখন দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে। সুতরাং সংঘাত কতদিন থাকবে সেটি নির্ভর করবে ক্ষমতার টানাটানিতে কে যেতে তাও ওপর।

রেডিও তেহরান:  আবদুল আউয়াল ঠাকুর। আমরা সাক্ষাৎকারের একেবারে শেষ দিকে। সবশেষে আপনার কাছে জানতে চাইব, অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, রাজনৈতিক সংঘাত নির্বাচনকে অনিশ্চিত করে তুলতে পারে। আপনার পর্যবেক্ষণ কি?

আবদুল আউয়াল ঠাকুর: রাজনৈতিক সংঘাত নির্বাচনকে অনিশ্চিত করে তুলতে পারে একথার অর্থ দাঁড়াবে এই যে রাজনৈতিক সংঘাতকে কেন্দ্র করে যদি আমরা নির্বাচনকে বিবেচনা করতে যাই-তাহলে এরইমধ্যে আমার আলোচনায় আমি বলেছি নির্বাচনকে আমরা কীভাবে দেখছি। আমরা কি নির্বাচনকে নির্বাচনের জন্য দেখছি নাকি নির্বাচনে নিজের ঘরে কলাগাছ কিংবা তালগাছ রেখে আলোচনায় অংশ নিচ্ছি। সরকার যেসব আলোচনা করছে সেসব আলোচনার মধ্যে একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দৃষ্টিভঙ্গি এখনও পরিষ্কার নয়। বিষয়টি নিয়ে কিন্তু এখনও  সরকারের পক্ষের যারা বিশ্লেষক তারাও অনেকে কথা বলেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক দাবি করেছেন নির্বাচন না দিয়ে অনন্তকাল ক্ষমতায় থাকা যায়। এসব কথাও কিন্তু গভীর পর্যবেক্ষণের দাবি রাখে। আসলে আমরা নির্বাচনকে কীভাবে দেখছি এবং নির্বাচন করার জন্য যে প্রস্তুতি সেই প্রস্তুতি কোন পক্ষের কত আছে! বিরোধী দল বলছে নির্বাচন করতে হলে নির্বাচনকালীন সরকার লাগবে বর্তমান সরকারের অধীনে তারা নির্বাচনে যাবে না। অন্যদিকে সরকারপক্ষ বলছে তারা ক্ষমতা ছেড়ে নির্বাচন করবে না। এ অবস্থা যদি চলতে থাকে তাহলে আসলেও নির্বাচনটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। যদিও সময় হচ্ছে সর্বোচ্চ বিষয় যা সবকিছুকে একটা সমাধানের দিকে নিয়ে যায়। অর্থাৎ সময় বলে দেবে। তবে সময়ের ঘণ্টাধ্বনি ঠিক আগের মতো নয়; এরমধ্যে এমন কিছু সংকেত ইথারে ছড়িয়ে পড়ছে যা কানে কানে জনগণের কাছে ভিন্ন বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে। আর এই ভিন্ন বার্তা যদি অন্য কোনো শব্দের সাথে মিলে যায় তাহলে তার অর্থ রাজনীতিতে ভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করতে পারে। আর সেই বার্তাটাই কিন্তু এখন সবার আশঙ্কা যা আপনি নিজেও করেছেন।

তো জনাব আবদুল আউয়াল ঠাকুর, বাংলাদেশের বর্তমান উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে রেডিও তেহরানের সাথে কথা বলার জন্য আপনাকে আবারও অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

আবদুল আউয়াল ঠাকুর: আপনাকে আমার পক্ষ থেকে এবং রেডিও তেহরানকে অসংখ্য ধন্যবাদ।#

পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/৪

 

ট্যাগ