কুরআনের আলো
সূরা আল-হাদিদ: ২৫-২৯ (পর্ব-৫)
শ্রোতাবন্ধুরা, সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করছি আপনারা সবাই ভালো আছেন। আপনাদের হয়তো মনে আছে গত আসরে আমরা সূরা হাদিদের ২৪ নম্বর পর্যন্ত আয়াত নিয়ে আলোচনা করেছি। আজ আমরা এই সূরার ২৫ থেকে ২৯ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের সংক্ষিপ্ত তাফসির উপস্থাপন করব। প্রথমেই ২৫ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
لَقَدْ أَرْسَلْنَا رُسُلَنَا بِالْبَيِّنَاتِ وَأَنْزَلْنَا مَعَهُمُ الْكِتَابَ وَالْمِيزَانَ لِيَقُومَ النَّاسُ بِالْقِسْطِ وَأَنْزَلْنَا الْحَدِيدَ فِيهِ بَأْسٌ شَدِيدٌ وَمَنَافِعُ لِلنَّاسِ وَلِيَعْلَمَ اللَّهُ مَنْ يَنْصُرُهُ وَرُسُلَهُ بِالْغَيْبِ إِنَّ اللَّهَ قَوِيٌّ عَزِيزٌ (25)
“অবশ্যই আমি আমার রাসূলগণকে পাঠিয়েছি স্পষ্ট প্রমাণসহ এবং তাদের সঙ্গে দিয়েছি কিতাব ও ন্যায়ের পাল্লা, যাতে মানুষ সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে। আমি আরও নাযিল করেছি লোহা যাতে রয়েছে প্রচণ্ড শক্তি এবং রয়েছে মানুষের জন্য বহুবিধা কল্যাণ। এটা এ জন্যে যে, আল্লাহ প্রকাশ করে দেন কে না দেখেও তাঁকে ও তাঁর রাসূলগণকে সাহায্য করে। নিশ্চয় আল্লাহ মহা শক্তিমান, পরাক্রমশালী।” ৫৭:২৫
এই আয়াতে নবুওয়াত এবং মানুষকে মহা সাফল্যের দিকে আহ্বান সম্পর্কে বলা হয়েছে, যুগে যুগে মানুষকে বিভ্রান্তির পথ থেকে মুক্তি দিয়ে সত্য-সরল পথে পরিচালিত করতে আল্লাহর নবীগণ কিতাব ও মুজিযা নিয়ে পৃথিবীতে এসেছেন। মানুষ যাতে পরস্পরের সঙ্গে ন্যায়পূর্ণ আচরণ করতে পারে এবং পরস্পরের অধিকার লঙ্ঘন না করে সেজন্য অসংখ্য নবী-রাসূল আল্লাহ পাঠিয়েছেন।
তবে পৃথিবীর অনেক মানুষ আল্লাহর নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করে এবং পৃথিবীতে জুলুম ও পাপাচারের পথ বেছে নেয়। তাদেরকে প্রতিহত করার জন্য শক্তি ও প্রয়োজনীয় উপকরণ প্রয়োজন। মানব সভ্যতার শুরু থেকে এ পর্যন্ত মানুষ যে উপকরণটি অনেক বেশি ব্যবহার করেছে তা হচ্ছে লোহা এবং বর্তমান সময়ে লোহা ছাড়া সব কল-কারখানা ও যন্ত্রপাতি অচল।
অতীতে যেকোনো যুদ্ধে লোহার তৈরি তরবারি ও ঢাল ব্যবহার করা হতো এবং দাম্ভিক শক্তিগুলোকে মোকাবিলা করার জন্য এসব প্রয়োজন হতো। বর্তমান সময়ে সেসবের স্থান করে নিয়েছে বন্দুক, কামান ও ট্যাংক। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, জালিমদের বিরুদ্ধে জিহাদ করার জন্য মুমিন-মুজাহিদদের সমন্বয়ে গঠিত মুসলিম বাহিনী প্রয়োজন; যারা আল্লাহর দ্বীন ও তাদের অনুসারীদের রক্ষা করার জন্য আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করবে।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:
১- নবী-রাসূলগণ মানুষকে গুনাহ ও জুলুম পরিহার করে নেক কাজ করার জন্য জোর-জবরদস্তি করতেন না। তাঁরা বরং সত্য ও মিথ্যার মানদণ্ডগুলো তাদের সামনে স্পষ্ট করে দিতেন যাতে মানুষ তার স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দিয়ে তাদের কাঙ্ক্ষিত পথ বেছে নিতে পারে।
২- মানুষকে সৎপথ প্রদর্শনের পাশাপাশি নবী-রাসূলদের অন্যতম দায়িত্ব ছিল সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা।
৩- সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে হলে শক্তিপ্রয়োগের ক্ষমতা থাকতে হয়। কারণ, যারা সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠার বিরোধী তাদের সঙ্গে কখনও কখনও সংঘাত অনিবার্য হয়ে পড়ে।
এবারে সূরা হাদিদের ২৬ ও ২৭ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا نُوحًا وَإِبْرَاهِيمَ وَجَعَلْنَا فِي ذُرِّيَّتِهِمَا النُّبُوَّةَ وَالْكِتَابَ فَمِنْهُمْ مُهْتَدٍ وَكَثِيرٌ مِنْهُمْ فَاسِقُونَ (26) ثُمَّ قَفَّيْنَا عَلَى آَثَارِهِمْ بِرُسُلِنَا وَقَفَّيْنَا بِعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ وَآَتَيْنَاهُ الْإِنْجِيلَ وَجَعَلْنَا فِي قُلُوبِ الَّذِينَ اتَّبَعُوهُ رَأْفَةً وَرَحْمَةً وَرَهْبَانِيَّةً ابْتَدَعُوهَا مَا كَتَبْنَاهَا عَلَيْهِمْ إِلَّا ابْتِغَاءَ رِضْوَانِ اللَّهِ فَمَا رَعَوْهَا حَقَّ رِعَايَتِهَا فَآَتَيْنَا الَّذِينَ آَمَنُوا مِنْهُمْ أَجْرَهُمْ وَكَثِيرٌ مِنْهُمْ فَاسِقُونَ (27)
“আর অবশ্যই আমি নূহ এবং ইবরাহীমকে রাসূলরূপে পাঠিয়েছিলাম এবং তাদের বংশধরগণের জন্য স্থির করেছিলাম নবুওয়াত ও কিতাব, কিন্তু তাদের অল্পই সৎপথ অবলম্বন করেছিল; আর তাদের অধিকাংশই ফাসিক বা সত্যত্যাগী ও পাপাচারী।” ৫৭:২৬
“তারপর আমি তাদের অনুগামী করেছিলাম আমার রাসূলগণকে এবং অনুগামী করেছিলাম মার্ইয়াম-তনয় ঈসাকে, আর তাকে আমরা দিয়েছিলাম ইঞ্জীল এবং তার অনুসারীদের দিয়েছিলাম করুণা ও দয়া। আর তারা যে সন্ন্যাসবাদ বেছে নিয়েছিল সেটা তো তারা নিজেরাই [আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের জন্য] প্রবর্তন করেছিল। আমি তাদেরকে এটার বিধান দেইনি; অথচ এটাও ওরা যথাযথভাবে পালন করেনি। অতঃপর তাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছিল, তাদেরকে আমি দিয়েছিলাম তাদের পুরস্কার। আর তাদের অধিকাংশই ছিল অবাধ্য ও পাপাচারী।” ৫৭:২৭
আগের আয়াতগুলোর ধারাবাহিকতায় এই আয়াতে বলা হয়েছে, হযরত নূহ ও ইব্রাহিম থেকে শুরু করে হযরত মূসা ও ঈসা আলাইহিমুস সালাম পর্যন্ত সব বড় বড় নবীকে কিতাব ও শরিয়ত প্রদান করা হয়েছিল। তাদের দায়িত্ব ছিল মানবজাতিকে সৌভাগ্যলাভের পথে পরিচালিত করা। তবে প্রতিটি যুগে, প্রত্যেক নবীর জামানায় বেশিরভাগ মানুষ নবীদের দাওয়াতের বাণী গ্রহণ করেনি এবং তাঁদের প্রতি ঈমান আনেনি।
সর্বশেষ নবীর পূর্ববর্তী নবী ছিলেন হযরত ঈসা (আ.)। তাঁকে আল্লাহ তায়ালা ইঞ্জিল কিতাব প্রদান করেছিলেন এবং এই নবীর অনুসারীদের মধ্যে দয়া ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। কিন্তু তারা শরিয়তের বিধান ত্যাগ করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মনগড়া লক্ষ্যে পার্থিব জীবনের আরাম-আয়েশ ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। দুঃখজনকভাবে এই কাজ তাদেরকে সত্য পথ থেকে বিচ্যুত করে এবং যাদের কারণে তারা সন্যাসবাদের জীবন বেছে নিয়েছিল তাদের জন্য খারাপ পরিণতি বয়ে আনে।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- নবী-রাসূলগণ আল্লাহর বাণী মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া এবং তাদেরকে সৎপথ প্রদর্শনের চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁদের দাওয়াতের বাণী গ্রহণ বা বর্জন সাধারণ মানুষের ওপর নির্ভর করে। নবী-রাসূলগণ কাউকে সত্য গ্রহণ করতে বাধ্য করেন না।
২- ইতিহাসের প্রতিটি যুগে নবুওয়াতের ধারা বহাল ছিল। তবে আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রজ্ঞা অনুযায়ী যখন নবী ও কিতাবের উপস্থিতি প্রয়োজন মনে করতেন না তখন পৃথিবীতে কোনো নবী থাকত না।
৩- সকল নবী-রাসূল ও তাঁদের কিতাবের প্রতি বিশ্বাস এবং তাঁদের প্রশংসা করা প্রতিটি ঈমানদারের দায়িত্ব।
৪- সব যুগে ধর্মের নামে এমন কিছু আচার-আচরণ ধর্মীয় বিধিবিধানে যুক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে যা আল্লাহর বিধান নয়। এসব আচারকে বিদআত বলা হয়। দ্বীনের অনুসারীরা মনে করে এভাবে তারা আল্লাহকে খুশি করতে পারবে কিন্তু বিধানটি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রবর্তন না করার কারণে এতে নেকি অর্জনের পরিবর্তে গুনাহ হয়।
এবারে সূরা হাদিদের শেষ দু’টি আয়াত অর্থাৎ ২৮ ও ২৯ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَآَمِنُوا بِرَسُولِهِ يُؤْتِكُمْ كِفْلَيْنِ مِنْ رَحْمَتِهِ وَيَجْعَلْ لَكُمْ نُورًا تَمْشُونَ بِهِ وَيَغْفِرْ لَكُمْ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ (28) لِئَلَّا يَعْلَمَ أَهْلُ الْكِتَابِ أَلَّا يَقْدِرُونَ عَلَى شَيْءٍ مِنْ فَضْلِ اللَّهِ وَأَنَّ الْفَضْلَ بِيَدِ اللَّهِ يُؤْتِيهِ مَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ ذُو الْفَضْلِ الْعَظِيمِ (29)
“হে মুমিনগণ! আল্লাহর [অবাধ্যতা থেকে] তাকওয়া অবলম্বন কর এবং তাঁর রাসূলের উপর ঈমান আনো;
তাহলে তিনি তাঁর অনুগ্রহে তোমাদেরকে দেবেন দ্বিগুণ পুরস্কার এবং তিনি তোমাদেরকে দেবেন নূর, যার
সাহায্যে তোমরা [দুনিয়া ও আখেরাতে] পথ চলবে। আর তিনি তোমাদেরকে ক্ষমা করবেন এবং
আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” ৫৭:২৮
“এটা এজন্যে যে, আহলে কিতাবগণ যেন এটা না ভাবে যে, আল্লাহর অনুগ্রহের উপর [মুসলমানদের] কোন অধিকার নেই। তারা জেনে রাখুক, নিশ্চয় অনুগ্রহ [একমাত্র] আল্লাহরই ইচ্ছাধীন, যাকে ইচ্ছে তাকে তিনি তা দান করেন। আর আল্লাহ্ মহা অনুগ্রহশীল।”৫৭:২৯
এই দুই আয়াতে মুসলমানদের উদ্দেশ করে আল্লাহ তায়ালা বলছেন: তোমরা প্রদর্শনমূলক ঈমানদার থেকে প্রকৃত ঈমানদারে পরিণত হও। তোমরা আল্লাহকে ভয় করে চলো তাহলে দুনিয়া ও আখিরাতে তাঁর রহমত লাভে ধন্য হতে পারবে। তোমাদের জীবনে আল্লাহর নূর প্রজ্জ্বলিত হবে। এভাবে আল্লাহ তোমাদের অতীত গুনাহ মাফ করে দেওয়ার পাশাপাশি ভবিষ্যতে তোমাদেরকে জান্নাতের অধিবাসী করবেন। এরপর এই সূরার শেষ আয়াতে বলা হচ্ছে: তোমরা মুসলমানরা যদি রাসূলের শিক্ষা গ্রহণ করো এবং পবিত্র কুরআনের বিধান মেনে চলো তাহলে অমুসলিমদের মধ্যে এই ধারনা জাগবে না যে, শুধুমাত্র তারাই তাদের নবীর অনুসরণ করে জান্নাতলাভ করবে এবং তোমরা আল্লাহর ক্ষমা ও অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হবে।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:
১- ঈমান আনার সঙ্গে সঙ্গে তাকওয়া বা খোদাভীতি শক্তিশালী করতে হবে যাতে তা মানুষের অন্তরের অন্তস্তলে পৌঁছে যায়।
২- মুমিন গুনাহ থেকে পুতপবিত্র নয়। তবে তাকে সব সময় গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা এবং তাকওয়া অবলম্বন করতে হবে। তাহলে আল্লাহ তায়ালা তার গুনাহ মাফ করে দেবেন।
৩- অন্য মানুষ জান্নাতে যাবে নাকি জাহান্নামি হবে সেটি দেখার দায়িত্ব আমাদের নয়। কারণ, আল্লাহ তায়ালার দয়া ও অনুগ্রহ এত ব্যাপক যে তিনি কখন কাকে ক্ষমা করে দেবেন তা আমাদের সীমাবদ্ধ জ্ঞান দিয়ে অনুধাবন করা সম্ভব নয়।
তো শ্রোতাবন্ধুরা! এরইসঙ্গে শেষ করছি কুরআনের আলোর আজকের আয়োজন। আমাদের সঙ্গ দেয়ার জন্য আপনাদের অনেক ধন্যবাদ।
পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/