জুন ১২, ২০২৩ ১৫:০২ Asia/Dhaka

গত অনুষ্ঠানে আমরা ইরানের আরেকজন খ্যাতনামা মনীষী আবু বকর মুহাম্মাদ বিন যাকারিয়া রাযির গবেষণাকর্ম এবং চিকিৎসা শাস্ত্রে তার অবদান নিয়ে কিছু কথা বলেছিলাম। এ ছাড়া ইরানের আরো কয়েকজন রসায়নবিদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা ইরানের আরেকজন বিখ্যাত মনীষী ইবনে সিনার জীবনী ও তার গবেষণা কর্মের সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেব।

মুসলমান দার্শনিকদের মাঝে আবু আলি হোসাইন ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে সিনা সবচেয়ে বড়ো মুসলিম দার্শনিক হিসেবে পরিগণিত। তিনি অবশ্য সারা বিশ্বে ইবনে সিনা নামেই বেশি পরিচিত। বিখ্যাত এই ইরানি দার্শনিক কেবল দর্শন বিষয়েই যে কাজ করেছেন, তা নয় বরং চিকিৎসা বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত ইত্যাদি বিষয়েও তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তিনি ৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে বোখারায় জন্মগ্রহণ করেন। মার্কিন বিখ্যাত ইতিহাসবিদ ও লেখক জর্জ সার্টন ইবনে সিনাকে মুসলিম ভূখণ্ডের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দার্শনিক হিসেবে মনে করেন। স্থান এবং কালভেদে সর্বকালের একজন শ্রেষ্ঠ দার্শনিক হিসেবেও ইবনে সিনাকে তিনি ব্যাপক গুরুত্ব দিয়েছেন। তাই তিনি যে ইরানি আর ইসলামি সভ্যতার জন্যেই গুরুত্বপূর্ণ তা নয় বরং বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে তিনি একটি অবিস্মরণীয় মুখ।

ইবনে সিনার পরবর্তীকালের দাশর্নিক ও চিন্তাবিদদের ওপর তাঁর যে অসামান্য প্রভাব পড়েছে তা কেবল মুসলিম বিশ্বের মাঝেই সীমাবদ্ধ নয় বরং ইউরোপসহ পশ্চিমা বিশ্বের মনীষীদের ওপরও তাঁর চিন্তাদর্শের প্রভাব পড়েছে। সেজন্যে পশ্চিমা বিশ্বে তিনি মুসলিম বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক হিসেবে খ্যাতিমান।

ইবনে সিনার গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলোর একটি হলো দর্শনের মৌলিক বিষয়গুলোকে তিনি যুক্তিপ্রমাণ সহযোগে এমনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন যা মুসলিম বিশ্বসহ পশ্চিমা বিশ্বেও সমানভাবে সমাদৃত হয়েছে। সেজন্যে তিনি দর্শনের ভিত্তিটাকে যথেষ্ট দৃঢ়তা দিতে সক্ষম হয়েছিলেন একইভাবে একটি দার্শনিক ব্যবস্থাও উপহার দিতে সক্ষম হয়েছেন।

এরিস্টটলের অনুসারী দার্শনিক ইবনে সিনাই সর্বপ্রথম কোনো ব্যক্তি যিনি মুসলিম বিশ্বে একটি দার্শনিক ব্যবস্থা তুলে ধরেন। আবু আলি সিনা গ্রিক দার্শনিকদের সৃষ্টিকর্মগুলোকে অত্যন্ত মনোযোগের সাথে পর্যালোচনা করেছেন এবং সেগুলোর মধ্য থেকে সবোর্ত্তম যেটি তাঁর মনে হয়েছে সেটিকেই গ্রহণ করেছেন এবং এরিস্টটলের দর্শনকে ইসলামী আদর্শে রূপায়িত করে মুসলিম মনীষীদের হাতে সোপর্দ করেন।   
ইবনে সিনা ছিলেন এরিস্টটলের দর্শনের অনুসারী। এ দিক থেকে তাঁর শিক্ষক ফারাবির সাথে মিল রয়েছে। ব্রিটিশ রসায়নবিদ রজার ব্যাকন ইবনে সিনাকে এরিস্টটলের পর সবচেয়ে বড়ো দার্শনিক বলে মনে করতেন। এরই ভিত্তিতে এরিস্টটল এবং ফারাবির পরবর্তী তৃতীয় শিক্ষক হিসেবে উপাধি দেওয়া হয়েছিল। অবশ্য ইবনে সিনা যতোই জীবনের শেষ প্রান্তের দিকে যাচ্ছিলেন ততোই এরিস্টটল থেকে দূরে সরে যাচ্ছিলেন এবং প্লেটো আর ইসলামি আধ্যাত্মিকতার অনুবর্তী হচ্ছিলেন।

তাঁর রূপক গল্পগুলো কিংবা তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ 'মানত্বেকুল মাশরেকিন' পড়লেই এ বক্তব্যের প্রমাণ মিলবে। আবু আলি সিনাকে ফারাবির স্থলাভিষিক্ত কিংবা ইসলামি সভ্যতার কালজয়ী এক মহান প্রতিনিধি হিসেবে গণ্য করা যায়। অন্যভাবে বলা যায় কালের বিচারে ইবনে সিনা যদিও ফারাবির পরবর্তীকালের, তবু বিভিন্ন দিক থেকে ইবনে সিনাকে ফারাবির চেয়ে অগ্রসর মনে হয়। যেমন, কোনো বস্তুর সত্ত্বা এবং স্বরূপগত স্বাতন্ত্র্য নিয়ে ফারাবি তেমন কোনো কাজ করেন নি, কিন্তু ইবনে সিনা এ সম্পর্কে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে এবং নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্লেষণ করেছেন।

আবু আলি হোসাইন ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে সিনা

ইবনে সিনার দার্শনিক চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপক প্রভাব পড়েছে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য দর্শনের ওপর। দেহ এবং আত্মা সম্পর্কে ইবনে সিনার একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি আছে যা কিছুটা এরিস্টটলের মতের অনুকূল হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এরিস্টটলের বিপরীত। দেহ ও আত্মার মাঝে পুরোপুরি দ্বৈত স্বরূপে বিশ্বাসী তিনি।

যে সময় পশ্চিমা জগতে এরিস্টটলের দার্শনিক চিন্তা বাতিল হতে যাচ্ছিল, সে সময় ইরানে এরিস্টটলের দর্শনের ব্যাপক অনুবাদ হচ্ছিল। ইবনে সিনা তখন এরিস্টটলের চিন্তাদর্শ নিয়ে ভীষণভাবে চর্চা করেন এবং এরিস্টটলের দর্শনকে ভালোভাবে আত্মস্থ করেন। ইবনে সিনা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ উপলব্ধির ব্যাপারে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতেন। তিনি মনে করতেন ভাব এবং অনুভূতি-এ দুয়ের মধ্যকার উপলব্ধি কোনো বস্তুর গুণগত দিক তথা রঙ এবং স্বাদের মতো বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত।

ইবনে সিনার কোনো কোনো দৃষ্টিভঙ্গি নবীর রেসালাত এভং নব্যুয়াতের সাথে সম্পর্কিত। নবূয়্যত সম্পর্কে তাঁর মতামত হলো এটি চারটি গুরুত্বপূর্ণ স্তরের ওপর নির্ভরশীল। একটি হলো বুদ্ধিবৃত্তি, একটি হলো ধারণা বা কল্পনা, আরেকটি হলো দৈব বা অলৌকিক এবং শেষটা হলো সামাজিক এবং রাজনৈতিক স্তর। তিনি ধর্মীয় এবং বুদ্ধির দুই জগতকে একটি স্তরে এনে সমন্বয় করার চেষ্টা করেছেন।

তাঁর এই প্রচেষ্টায় গ্রিক দর্শন এবং ইসলামি মাযহাবের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। ইবনে সিনা মনে করতেন আত্মিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক অন্তর্দৃষ্টিই হলো সবচেয়ে বড়ো এবং উন্নত অনুগ্রহ যা ইসলামের নবীকে দান করা হয়েছে। তিনি বিশ্বাস করতেন যে নবী কারিম (সা) চিন্তাদর্শগত দিক থেকে এতো বেশি শক্তিশালী ছিলেন যে বুদ্ধিবৃত্তির সত্যতাকে তিনি জীবন্ত অবস্থায় এবং ইমান হিসেবে জনগণকে সরবরাহ করতেন।

ইবনে সিনা খোদা এবং বিশ্বজগত সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করেছেন। তিনি মনে করতেন খোদার অস্তিত্ব থাকাটা ওয়াজিব অর্থাৎ আবশ্যিক এবং সৃষ্টির সকল বস্তুই এই আবশ্যিক সত্ত্বার কাছে মুখাপেক্ষী। ইবনে সিনার মতে এই বিশ্ব সৃষ্টির আদি থেকেই খোদার মুখাপেক্ষী। ফলে পদার্থ এবং আকৃতি উভয়ই অস্তিত্ব লাভ করার জন্যে খোদার মুখাপেক্ষী। আবু আলি সিনা তাঁর জীবনের কোনো একটি মুহূর্তও পড়ালেখা বা গবেষণা ছাড়া কাটাননি এমনকি যে সময়টায় সরকারী আর বিচারিক কাজে কাটিয়েছিলেন তখনো।
রাতভর ছাত্রদের নিয়ে লেখালেখি, গবেষণা করতেন আর তাদেরকে পাঠদান করতেন। দর্শনকেন্দ্রিক তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বই হলো শেফা, নাজাত, এশারাত ও তাম্বিহাত এবং দনেশনমেয়ে আলায়ি। তিনি কমপক্ষে ২৩০ টি বই লিখেছেন। মহান এই দার্শনিকের লেখা বইগুলো এখন জাতীয় ঐতিহ্য সংস্থা এবং ইরানের বিখ্যাত গবেষকদের মাধ্যমে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের কাজ চলছে। এসব গবেষণাকর্মের কিছু কিছু ছাপাও হয়েছে।#

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/১২

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ