কুরআনের আলো
সূরা আল-মুজাদালা: ৭-১১ (পর্ব-২)
শ্রোতাবন্ধুরা, সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করছি আপনারা সবাই ভালো আছেন। আপনাদের হয়তো মনে আছে গত আসরে আমরা সূরা মুজাদালার ৬ নম্বর পর্যন্ত আয়াত নিয়ে আলোচনা করেছি। আজ আমরা এই সূরার ৭ থেকে ১১ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের সংক্ষিপ্ত তাফসির উপস্থাপন করব। প্রথমেই ৭ ও ৮ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
أَلَمْ تَرَ أَنَّ اللَّهَ يَعْلَمُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ مَا يَكُونُ مِنْ نَجْوَى ثَلَاثَةٍ إِلَّا هُوَ رَابِعُهُمْ وَلَا خَمْسَةٍ إِلَّا هُوَ سَادِسُهُمْ وَلَا أَدْنَى مِنْ ذَلِكَ وَلَا أَكْثَرَ إِلَّا هُوَ مَعَهُمْ أَيْنَ مَا كَانُوا ثُمَّ يُنَبِّئُهُمْ بِمَا عَمِلُوا يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِنَّ اللَّهَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ (7) أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ نُهُوا عَنِ النَّجْوَى ثُمَّ يَعُودُونَ لِمَا نُهُوا عَنْهُ وَيَتَنَاجَوْنَ بِالْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ وَمَعْصِيَةِ الرَّسُولِ وَإِذَا جَاءُوكَ حَيَّوْكَ بِمَا لَمْ يُحَيِّكَ بِهِ اللَّهُ وَيَقُولُونَ فِي أَنْفُسِهِمْ لَوْلَا يُعَذِّبُنَا اللَّهُ بِمَا نَقُولُ حَسْبُهُمْ جَهَنَّمُ يَصْلَوْنَهَا فَبِئْسَ الْمَصِيرُ (8)
“আপনি কি লক্ষ্য করেননি যে, আসমানসমূহ ও জমিনে যা কিছু আছে নিশ্চয় আল্লাহ তা জানেন? তিন জনের কোন গোপন পরামর্শ হয় না যাতে চতুর্থজন হিসেবে আল্লাহ থাকেন না, আর পাঁচ জনেরও হয় না, যাতে ষষ্ঠজন হিসেবে তিনি থাকেন না। এর চেয়ে কমও নয় বেশিও নয়, তিনি তো তাদের সঙ্গেই আছেন, তারা যেখানেই থাকুক না কেন। তারপর কিয়ামতের দিন তিনি তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে জানিয়ে দেবেন। নিশ্চয় আল্লাহ সব বিষয়ে সম্যক অবগত।” (৫৮:৭)
“আপনি কি তাদেরকে লক্ষ্য করেন না, যাদেরকে গোপন পরামর্শ করতে নিষেধ করা হয়েছিল? তারপর তারা যা নিষিদ্ধ তারই পুনরাবৃত্তি করে এবং পাপাচরণ, সীমালঙ্ঘন ও রাসূলের বিরুদ্ধাচরণের জন্য গোপন পরামর্শ করে। [কিন্তু তারপরও] আর তারা যখন আপনার কাছে আসে তখন তারা আপনাকে এমন কথা দ্বারা সালাম ও অভিবাদন করে যা দ্বারা আল্লাহ আপনাকে অভিবাদন করেননি। আর তারা মনে মনে বলে, আমরা যা বলি তার জন্য আল্লাহ্ আমাদেরকে শাস্তি দেন না কেন? জাহান্নামই তাদের জন্য যথেষ্ট, যেখানে তারা প্রবেশ করবে, আর কত নিকৃষ্ট সে গন্তব্যস্থল!” (৫৮:৮)
এই দুই আয়াতে যে গোপন পরামর্শের কথা বলা হয়েছে তাকে মূলত কানাঘুষা বা ফিসফিস বলা যায়। সাধারণত পরিবারের সদস্যরা অথবা বন্ধুরা মিলে মানুষ এরকম ফিসফিস করে থাকে যাতে অন্যরা তা শুনতে না পায়। এই কাজকে অপছন্দনীয় ঘোষণা করে আল্লাহ তায়ালা তা করতে নিষেধ করেছেন। কারণ, একসঙ্গে অনেক মানুষের মধ্যে কয়েকজন মিলে গোপন পরামর্শ করলে বাকিরা অস্বস্তিতে ভোগে এবং তাদের কাছে মনে হয় তাদের সম্পর্কে হয়তো কোনো নেতিবাচক কথা বলা হচ্ছে। কখনও কখনও কোনো খারাপ কাজ করার পরামর্শও এভাবে হয়ে থাকে।
পবিত্র কুরআনে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে: তোমরা ভেবো না যে, গোপনে কথা বলো বলে আল্লাহ তা শুনতে পান না এবং তোমাদের গোপন পরিকল্পনা জেনে যান না। বরং, আল্লাহর জ্ঞান সর্বব্যাপী এবং কোনো কিছুই তাঁর অগোচরে থাকে না। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মাদানী জীবনে মুনাফিকরা প্রকাশ্যে নিজেদেরকে মুসলমান বলে দাবি করত কিন্তু বাস্তবে তাদের ঈমান ছিল না। রাসূলের সঙ্গে দেখা হলে তারা চাটুকারিতা করত এবং তাঁকে খুশি করার জন্য সব রকম চেষ্টা করত। কিন্তু গোপনে তারা আল্লাহ ও রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করতো এবং এমন সব কাজ করার সিদ্ধান্ত নিত যা ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে।
এই দুই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:
১- আল্লাহর অসীম জ্ঞানের সামনে সবকিছু সমান। বিশাল আসমানসমূহ ও জমিন, প্রকাশ্য ও গোপন কথা এবং মানুষের ছোট-বড় সব আমল এর অন্তর্গত।
২- আল্লাহ তায়ালার কাছে স্থান ও কালের কোনো প্রশ্ন নেই। তিনি স্থান ও কালের ঊর্ধ্বে সবকিছুর ওপর তিনি ক্ষমতাবান।
৩- মহান আল্লাহ আমাদের সব কথা ও আচরণ লক্ষ করেন। তিনি আমাদের প্রতিটি কর্মের খুঁটিনাটি সম্পর্কে জানেন। কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালার এই জ্ঞানের ভিত্তিতে আমরা পুরস্কার কিংবা শাস্তি পাব।
৪- চাটুকারিতা ও মোসাহেবি হচ্ছে মুনাফিকের সুস্পষ্ট লক্ষণ। আমরা যেন যেকোনো প্রশংসাসূচক বাক্যে গলে না যাই কারণ তা আমাদের সঙ্গে প্রতারণার জন্য প্রয়োগ করা হয়ে থাকতে পারে।
(তাওয়াশিহ)
এবারে সূরা মুজাদালার ৯ ও ১০ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا إِذَا تَنَاجَيْتُمْ فَلَا تَتَنَاجَوْا بِالْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ وَمَعْصِيَةِ الرَّسُولِ وَتَنَاجَوْا بِالْبِرِّ وَالتَّقْوَى وَاتَّقُوا اللَّهَ الَّذِي إِلَيْهِ تُحْشَرُونَ (9) إِنَّمَا النَّجْوَى مِنَ الشَّيْطَانِ لِيَحْزُنَ الَّذِينَ آَمَنُوا وَلَيْسَ بِضَارِّهِمْ شَيْئًا إِلَّا بِإِذْنِ اللَّهِ وَعَلَى اللَّهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُونَ (10)
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা যখন গোপন পরামর্শ কর, সে পরামর্শ যেন পাপাচরণ, সীমালংঘন ও রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ সম্পর্কে না হয়। তোমরা কল্যাণমূলক কাজ ও খোদাভীরুতা অবলম্বনের পরামর্শ কর। আর সেই আল্লাহকে ভয় কর, যাঁর নিকট তোমরা পুনরুত্থিত হবে।” (৫৮:৯)
“গোপন পরামর্শ তো কেবল শয়তানের প্ররোচনায় হয় মুমিনদেরকে দুঃখ দেয়ার জন্য। তবে আল্লাহর অনুমতি ছাড়া শয়তান তাদের সামান্যতম ক্ষতি সাধনেও সক্ষম নয়। অতএব মুমিনরা যেন কেবল আল্লাহর উপরই নির্ভর করে।” (৫৮:১০)
আগের আয়াতগুলোর ধারাবাহিকতায় এখানেও গোপন পরামর্শ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। আল্লাহ বলছেন, গোপন পরামর্শ শয়তানের কাজ। কারণ, যারা এটা করে উপস্থিত বাকি লোকদের প্রতি তাদের আস্থা নেই। এর মাধ্যমে তাদের প্রতিও উপস্থিত বাকি লোকদের সন্দেহ হয়। নিঃসন্দেহে এর ফলে মুমিনদের পরস্পরের মধ্যে আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয় যা পরবর্তীতে শত্রুতায় পরিণত হতে পারে।
অবশ্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে গোপনে কথা বলা পছন্দনীয় কাজ। উদাহরণ হিসেবে অসহায় মানুষদের সাহায্য করার বিষয়ে গোপনে কথা বলার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এর ফলে যাকে সাহায্য করা হচ্ছে তার নাম গোপন থাকে ও তার সম্মান রক্ষা হয়। অন্যদিকে যারা সাহায্য করছেন তারাও লৌকিকতার গুনাহ থেকে বেঁচে যান এবং তাদের নামও গোপন থাকে। প্রকাশ্যে দান করার অনুমতি থাকলেও আল্লাহ গোপনে দান করাকে পছন্দ করেন। প্রকাশ্যে সেই দানটি পছন্দনীয় যেটি আরো দশ জনকে দান করতে উৎসাহিত করার জন্য করা হয়।
এই দুই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:
১- গুরুত্বহীন কাজে গোপন পরামর্শ করাকে হারাম করা হয়েছে। তবে কোনো মুমিনের সম্মান রক্ষা বা পরিবার ও সমাজের কল্যাণার্থে এ কাজ করা যেতে পারে।
২- কখনো কখনো মানুষকে ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ করা ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখার কাজটি গোপনে করতে হয়। তাহলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
৩- যে কাজে অন্য মানুষ দুঃখ, কষ্ট বা ভয় পায় সেটিই শয়তানের কাজ। ঈমানদারের জন্য এমন কাজ শোভা পায় না।
৪- শয়তানের ষড়যন্ত্রের মোকাবিলায় মুমিন ব্যক্তিরা আল্লাহর ওপর ভরসা করেন এবং এই বিশ্বাস পোষণ করেন যে, আল্লাহ না চাইলে শত্রুরা তাদের কোনো ক্ষতি করতে পারে না।
এবারে সূরা মুজাদালার ১১ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا إِذَا قِيلَ لَكُمْ تَفَسَّحُوا فِي الْمَجَالِسِ فَافْسَحُوا يَفْسَحِ اللَّهُ لَكُمْ وَإِذَا قِيلَ انْشُزُوا فَانْشُزُوا يَرْفَعِ اللَّهُ الَّذِينَ آَمَنُوا مِنْكُمْ وَالَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ دَرَجَاتٍ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ (11)
“হে মু’মিনগণ! যখন তোমাদের বলা হয় মজলিসের স্থান প্রশস্ত করে দাও, তখন তোমরা স্থান করে দেবে; তাহলে আল্লাহও তোমাদের জন্য স্থান প্রশস্ত করে দেবেন এবং যখন বলা হয় উঠে যাও, তখন কালবিলম্ব না করে উঠে যাবে। তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে আল্লাহ তাদেরকে মর্যাদায় উন্নত করবেন; আল্লাহ লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন, তোমরা যা করো সে সম্পর্কে আল্লাহ সবিশেষ অবহিত।” (৫৮:১১)
এই আয়াতে মজলিস বা যেকোনো বৈঠকের আদব বর্ণনা করে বলা হচ্ছে: যখন কোনো বৈঠকে নতুন কেউ আগমন করবে তাকে তোমরা বসার জন্য স্থান করে দেবে। এর ফলে তোমাদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরো মজবুত হবে। এরপর বলা হচ্ছে, নতুন কোনো আগন্তুককে সম্মান জানানোর জন্য উঠে দাঁড়ানোর প্রয়োজন হলে উঠে দাঁড়াবে। জায়গা দখল করে বসে থেকে শুধু নিজের আরাম-আয়েশের চিন্তা করবে না। যদি তোমরা এই নির্দেশনা মেনে চলো তাহলে আল্লাহ তায়ালাও তোমাদের রিজিকে প্রশস্ততা দান করবেন। যদি কোনো বৈঠকে কোনো আলেম বা জ্ঞানী ব্যক্তি আগমন করেন তাহলে তার সম্মানে এমনভাবে দাঁড়াতে হবে যাতে বাকি সবার কাছে তার মর্যাদা স্পষ্ট হয়ে যায়।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- ওঠা ও বসার ক্ষেত্রে অপরের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও সামাজিক রীতি মেনে চলা ঈমানের অঙ্গ এবং ইসলাম এর ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে।
২- পাবলিক প্লেস বা সাধারণ মানুষের সমাগমস্থলে স্বার্থপরতা পরিহার করতে হবে এবং সবাইকে সব সুযোগ সুবিধা ভোগ করতে দিতে হবে।
৩- অন্যের সুবিধার জন্য কাজ করলে আল্লাহ তায়ালা দুনিয়া ও আখিরাতে আমার সব ধরনের সুবিধার ব্যবস্থা করে দেবেন।
৪- ইসলামি সমাজে ঈমানদার ও আলেম ব্যক্তিবর্গ সর্বাধিক মর্যাদা পাওয়ার অধিকার রাখেন।
তো শ্রোতাবন্ধুরা! এরইসঙ্গে শেষ করছি কুরআনের আলোর আজকের আয়োজন। আমাদের সঙ্গ দেয়ার জন্য আপনাদের অনেক ধন্যবাদ।
পার্সটুডে/এমএমআই/ বাবুল আখতার/১২
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।