কুরআনের আলো
সূরা আল-মুজাদালা: ১৮-২২( পর্ব-৪)
শ্রোতাবন্ধুরা, সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করছি আপনারা সবাই ভালো আছেন। আপনাদের হয়তো মনে আছে গত আসরে আমরা সূরা মুজাদালার ১৭ নম্বর পর্যন্ত আয়াত নিয়ে আলোচনা করেছি। আজ আমরা এই সূরার ১৮ থেকে ২২ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের সংক্ষিপ্ত তাফসির উপস্থাপন করব। প্রথমেই ১৮ ও ১৯ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
يَوْمَ يَبْعَثُهُمُ اللَّهُ جَمِيعًا فَيَحْلِفُونَ لَهُ كَمَا يَحْلِفُونَ لَكُمْ وَيَحْسَبُونَ أَنَّهُمْ عَلَى شَيْءٍ أَلَا إِنَّهُمْ هُمُ الْكَاذِبُونَ (18) اسْتَحْوَذَ عَلَيْهِمُ الشَّيْطَانُ فَأَنْسَاهُمْ ذِكْرَ اللَّهِ أُولَئِكَ حِزْبُ الشَّيْطَانِ أَلَا إِنَّ حِزْبَ الشَّيْطَانِ هُمُ الْخَاسِرُونَ (19)
“যেদিন আল্লাহ পুনরুত্থিত করবেন তাদের সকলকে, সেদিন তারা আল্লাহর [কাছেও] সেইরূপ [মিথ্যা] শপথ করবে, যেরূপ শপথ তোমাদের নিকট করে এবং তারা মনে করবে যে, তারা কোন (দলীলের) উপর প্রতিষ্ঠিত। জেনে রেখো যে, নিশ্চয় তারাই হল মিথ্যাবাদী। ” (৫৮:১৮)
“শয়তান তাদের ওপর চেপে বসেছে এবং তাদেরকে আল্লাহর যিকির ভুলিয়ে দিয়েছে। এরাই শয়তানের দল। জেনে রাখ, নিশ্চয় শয়তানের দল ক্ষতিগ্রস্ত।” (৫৮:১৯)
গত আসরে মুনাফিকদের একটি বৈশিষ্ট্য নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বলা হয়েছে, তারা দ্বীনের পবিত্র বিষয়সমূহের শপথ বিশেষ করে আল্লাহর নামে শপথের অপব্যবহার করে। এরপর এই দুই আয়াতে বলা হচ্ছে: মুনাফিক নামক এই মিথ্যাবাদীরা যে শুধু দুনিয়াতে মিথ্যা শপথ করে তাই নয় বরং তারা কিয়ামতের দিনও একই পন্থা অবলম্বন করবে। তারা মনে করে যে, কিয়ামতের দিনও মিথ্যা শপথ করে তারা আল্লাহর আদালত থেকেও মুক্তি পেতে পারবে। তারা সেদিন আল্লাহর নামে শপথ করে নিজেদের গুনাহের কাজগুলো অস্বীকার করার চেষ্টা করবে। তারা ভাবে, তাদের ক্ষমতা এত বেশি যে, তারা আল্লাহর সঙ্গেও প্রতারণা করতে পারবে! এখান থেকে তাদের নির্বুদ্ধিতার চরম অবস্থা উপলব্ধি করা যায়।
এরপর বলা হচ্ছে; মুনাফিকদের প্রধান সমস্যা হচ্ছে, শয়তান তাদের ঘাড়ে চেপে বসেছে এবং তারা নিজেদেরকে শয়তানের কাছে সঁপে দিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই যেখানে শয়তানের উপস্থিতি আছে সেখানে আল্লাহ তায়ালা এবং তাঁর জিকির বা স্মরণ অনুপস্থিত। কাজেই মুনাফিকদেরদের অবস্থা এমন অবস্থায় পৌঁছে যায় যে, তারা শয়তানের দলে ভিড়ে যায় এবং শয়তানের আনুগত্যকে আল্লাহর আনুগত্যের উপরে স্থান দেয়।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:
১- যে ব্যক্তি শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে সে ক্ষতিগ্রস্ত। এই ক্ষতি পার্থিব জীবন এবং পরকাল উভয় জগতের জন্য প্রযোজ্য। তবে কিয়ামতের দিন এই ক্ষতি সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়বে।
২- মিথ্যা যদি কারো অস্থিমজ্জার সঙ্গে মিশে যায় তাহলে সে কিয়ামতের দিন আল্লাহর আদালতেও মিথ্যা বলতে দ্বিধা করবে না এবং সে ভাববে আজ মিথ্যা বলে আল্লাহর আদালত থেকেও নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে।
৩- শয়তানের আনুগত্যই প্রকৃত ক্ষতি। এটিকে আর্থিক ক্ষতি ভাবলে ভুল হবে বরং এর মাধ্যমে মানুষের মনুষ্যত্বের অপমৃত্যু ঘটে।
এবারে সূরা মুজাদালার ২০ ও ২১ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
إِنَّ الَّذِينَ يُحَادُّونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ أُولَئِكَ فِي الْأَذَلِّينَ (20) كَتَبَ اللَّهُ لَأَغْلِبَنَّ أَنَا وَرُسُلِي إِنَّ اللَّهَ قَوِيٌّ عَزِيزٌ (21)
“নিশ্চয় যারা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের সঙ্গে শত্রুতা করে, তারা হবে চরম লাঞ্ছিতদের অন্তর্ভুক্ত।”(৫৮:২০)
“আল্লাহ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন যে, আমি এবং আমার রাসূলগণ অবশ্যই বিজয়ী হব। আল্লাহ শক্তিমান, পরাক্রমশালী।”(৫৮:২১)
আগের আয়াতগুলোতে মুনাফিকদের মিথ্যাচার ও তাদের শয়তানের দলে ভিড়ে যাওয়ার প্রতি ইঙ্গিত করার পর এই দুই আয়াতে বলা হচ্ছে: এরা হচ্ছে নিকৃষ্টতম মানুষ এবং তারা আল্লাহর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে পারবে না।
শয়তানি মতবাদের বিরুদ্ধে ঐশী মতবাদের বিজয়ের দু’টি দিক রয়েছে। এর একটি হচ্ছে বাহ্যিক বিজয়। মুমিন ব্যক্তিরা নবী-রাসূলগণকে সহযোগিতা করলে এই বিজয় অর্জিত হয়। আরেকটি হচ্ছে চিন্তাগত ও যৌক্তিক বিজয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে সব সময় মিথ্যার ওপর সত্যের বিজয় হয়েছে এবং এই বিজয় ক্রমর্ধমানশীল রয়েছে। পবিত্র কুরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে, আল্লাহ তায়ালা মিথ্যার ওপর সত্যের চূড়ান্ত বিজয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। একইসঙ্গে তিনি মানব রচিত যেকোনো মতবাদের বিরুদ্ধে নবী-রাসূলগণের মতবাদকে বিজয়ী করার ঘোষণা দিয়েছেন।
এই দুই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:
১- দ্বীনের বিষয়ে মিথ্যাচার করলে পার্থিব জগতে কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হতে হয় এবং এ ধরনের মানুষ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের শিক্ষার বিরুদ্ধাচরণ করে।
২- মিথ্যার অনুসারীরা আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণ করার কারণে চরম লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়।
৩- মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যের চূড়ান্ত বিজয়ের ঐশী প্রতিশ্রুতি এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। আল্লাহর রাসূলের হাদিস অনুযায়ী, ইমাম মাহদি (আ.)-এর আবির্ভাবের পর এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হবে।
এবারে এই সূরার সর্বশেষ আয়াত অর্থাৎ ২২ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত, তর্জমা ও তাফসির শোনা যাক:
لَا تَجِدُ قَوْمًا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ يُوَادُّونَ مَنْ حَادَّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَلَوْ كَانُوا آَبَاءَهُمْ أَوْ أَبْنَاءَهُمْ أَوْ إِخْوَانَهُمْ أَوْ عَشِيرَتَهُمْ أُولَئِكَ كَتَبَ فِي قُلُوبِهِمُ الْإِيمَانَ وَأَيَّدَهُمْ بِرُوحٍ مِنْهُ وَيُدْخِلُهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ أُولَئِكَ حِزْبُ اللَّهِ أَلَا إِنَّ حِزْبَ اللَّهِ هُمُ الْمُفْلِحُونَ (22)
আপনি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী এমন কোন সম্প্রদায় পাবেন না, যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের সঙ্গে শত্রুতা পোষণকারীদেরকে ভালোবাসে; হোক না এই শত্রুতা পোষণকারীরা তাদের পিতা, পুত্র, ভ্রাতা অথবা তাদের জাতি-গোত্র। তাদের অন্তরে আল্লাহ ঈমান লিখে দিয়েছেন এবং তাদেরকে শক্তিশালী করেছেন তাঁর পক্ষ হতে রূহ দ্বারা। তিনি তাদেরকে প্রবেশ করাবেন এমন জান্নাতে যার [গাছপালার] নিম্নদেশে নদীমালা প্রবাহিত, সেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট। তারাই আল্লাহর দল। জেনে রেখো যে, আল্লাহর দলই সফলকাম।”(৫৮:২২)
এই আয়াতে আল্লাহ তায়ালা তাঁর একটি চিরায়ত বিধান বর্ণনা করে বলছেন: আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি ভালোবাসা এবং আল্লাহর শত্রুদের প্রতি ভালোবাসা একই অন্তরে শোভা পায় না। যদি কেউ মুখে দাবি করে যে, সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছে কিন্তু বাস্তবে তার এমন সব আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে যারা আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণ করে তাহলে ওই ব্যক্তি প্রকৃত মুমিন নয়।
যদি কেউ আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্য তাঁর বিরুদ্ধাচরণকারী আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারে তাহলে সত্যি সত্যি আল্লাহ তায়ালা সন্তুষ্ট হয়ে যান এবং ওই ব্যক্তিকে পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন। ওই ব্যক্তি আল্লাহর অনুগ্রহপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।
যেসব মুনাফিক মুখে ঈমানের দাবি করত কিন্তু অন্তরে আল্লাহর প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করত তাদেরকে এই সূরার ১৯ নম্বর আয়াতে শয়তানের দলভুক্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই আয়াতে আল্লাহর শত্রুদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্নকারী মুমিন ব্যক্তিদেরকে আল্লাহর দলভুক্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে এবং শত্রুদের বিরুদ্ধে তাদের বিজয়ের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
এই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:
১- ঈমানদার ব্যক্তিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং আল্লাহর শত্রুদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা হচ্ছে প্রকৃত ঈমানের পূর্বশর্ত। সব নবী-রাসূল আল্লাহর শত্রুদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন।
২- একই অন্তরে পরস্পরবিরোধী দু’টি শক্তির প্রতি ভালোবাসা স্থান পেতে পারে না। আল্লাহ তায়ালা একজন ব্যক্তিকে দু’টি অন্তর দান করেননি যে, দুই অন্তর দিয়ে পরস্পরবিরোধী দু’টি শক্তিকে ভালোবাসবে। কাজেই আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা ও দ্বীনের শত্রুদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা এক ব্যক্তির প্রতি সম্ভব নয়।
৩- ইসলামে ঈমানি সম্পর্ককে পারিবারিক, বংশীয়, আত্মীয়জনিত এবং জাতীয় সম্পর্কের ঊর্ধ্বে স্থান দিতে বলা হয়েছে।
তো শ্রোতাবন্ধুরা! এরইসঙ্গে শেষ করছি কুরআনের আলোর আজকের আয়োজন। আমাদের সঙ্গ দেয়ার জন্য আপনাদের অনেক ধন্যবাদ।
পার্সটুডে/এমএমআই/ বাবুল আখতার/১৩
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।