কুরআনের আলো
সূরা আল-হাশর: ২০-২৪ (পর্ব-৪)
শ্রোতাবন্ধুরা, সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করছি আপনারা সবাই ভালো আছেন। আপনাদের হয়তো মনে আছে গত আসরে আমরা সূরা হাশরের ১৯ নম্বর আয়াত পর্যন্ত আলোচনা করেছিলাম। আজ আমরা এই সূরার ২০ থেকে ২৪ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের সংক্ষিপ্ত তাফসির উপস্থাপন করব। প্রথমেই এই সূরার ২০ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
لَا يَسْتَوِي أَصْحَابُ النَّارِ وَأَصْحَابُ الْجَنَّةِ أَصْحَابُ الْجَنَّةِ هُمُ الْفَائِزُونَ (20)
“জাহান্নামের অধিবাসী এবং জান্নাতের অধিবাসী সমান নয়। জান্নাতবাসীরাই তো সফলকাম।” ৫৯:২০
আগের আসরের আয়াতগুলোর ধারাবাহিকতায় এই আয়াতে মুত্তাকিদের সঙ্গে আল্লাহর ব্যাপারে উদাসীন ব্যক্তিদের তুলনা করা হয়েছে। আল্লাহ রব্বুল আলামিন এরশাদ করছেন, তোমাদের এটা দেখার প্রয়োজন নেই যে, পৃথিবীতে কারা পার্থিব জগতের চাওয়া পাওয়া পূর্ণভাবে অর্জন করেছে এবং কারা পার্থিব জগতের প্রয়োজনগুলোই মেটাতে পারেনি। তোমরা বরং এটা দেখবে যে, মৃত্যু পরবর্তী জীবনে এই দুই দলের মধ্যে কোন দল সফল হয়? কোন দলটি জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হয় আর কোন দলটি চিরকালীন শান্তির আবাস জান্নাতে প্রবেশ করে।
এই আয়াতের দু’টি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হচ্ছে:
১- পার্থিব জীবনের জন্য কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করার আগে আমাদেরকে সাতপাঁচ ভেবে নিতে হবে। আমরা যেন মৃত্যুকে এই জীবনের সমাপ্তি মনে না করি বরং মৃত্যুর মাধ্যমে আমরা যে চিরকালীন আবাসে প্রবেশ করতে যাচ্ছি সেটা ভাবি। আমাদেরকে সেই চিরকালীন আবাসের সুখ-সমৃদ্ধির জন্য চেষ্টা করতে হবে। পার্থিব জগতকে সেই চিরকালীন আবাসের শষ্যক্ষেত্র মনে করে তাকওয়া অবলম্বন করতে হবে।
২- হক ও বাতিল বা সত্য ও মিথ্যার মাঝখানে তৃতীয় কোনো পথ নেই। কাজেই মানুষের কর্মফল হয় জান্নাত হবে অথবা জাহান্নাম। পরকালে এর বাইরে তৃতীয় কোনো স্থান আল্লাহ রাখেননি।
এবারে সূরা হাশরের ২১ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
“যদি আমি এই কুরআন পর্বতের উপর অবতীর্ণ করতাম, তাহলে নিঃসন্দেহে আপনি দেখতেন যে, ওটা আল্লাহর ভয়ে বিনীত ও বিদীর্ণ হয়ে গেছে। আমি এসব দৃষ্টান্ত বর্ণনা করি মানুষের জন্য, যাতে তারা চিন্তা-ভাবনা করে।” ৫৯:২১
) لَوْ أَنْزَلْنَا هَذَا الْقُرْآَنَ عَلَى جَبَلٍ لَرَأَيْتَهُ خَاشِعًا مُتَصَدِّعًا مِنْ خَشْيَةِ اللَّهِ وَتِلْكَ الْأَمْثَالُ نَضْرِبُهَا لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَ (21)
পবিত্র কুরআনের একটি বর্ণনাভঙ্গি হচ্ছে কোনো বিষয়কে পরোক্ষ উদাহরণের মাধ্যমে তুলে ধরা। এই আয়াতেও মানুষের অন্তরে সেই প্রভাব সৃষ্টিকারী পদ্ধতি অনুসরণ করে বলা হচ্ছে, আল্লাহর কালাম যদি সুদৃঢ় পর্বতমালার ওপর অবতীর্ণ হয় তাহলে তা ফেটে যাবে এবং ভেঙেচুড়ে চুড়মার হয়ে মাটির সঙ্গে মিশে যাবে। অথচ এই কুরআনের বাণী কিছু মানুষের অন্তরে বিন্দুমাত্র প্রভাব সৃষ্টি করে না। মনে হয় যেন, তাদের অন্তর পাথরের চেয়েও শক্ত হয়ে গেছে। এ ধরনের মানুষ আল্লাহ তায়ালার সামনে বিনয়ী হওয়ার পরিবর্তে দম্ভ ও অহংকার দেখায়। তারা আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে চলতে অস্বীকার করে। সূরা বাকারার ৭৪ নম্বর আয়াতেও একই বিষয়ে বলা হয়েছে, এ ধরনের মানুষ পাহাড় ও জড় বস্তুর চেয়েও নিকৃষ্ট।
এই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হলো:
১- ইসলামে মানুষকে দ্বীনের দাওয়াত দেওয়ার সময় কখনও কখনও পরোক্ষ উদাহরণ অথবা ঐতিহাসিক সত্য ঘটনা বর্ণনা করা হয়।
২- কুরআনের বর্ণনা অনুযায়ী, পৃথিবীতে কিছু মানুষ আছে যারা শুধু চতুষ্পদ জন্তুর চেয়েই খারাপ নয় বরং তারা জড় পদার্থ ও পাহাড়ের চেয়েও নিকৃষ্ট।
৩- মানুষের অন্তর কঠিন হয়ে যাওয়ার উদাহরণ হচ্ছে, সে আল্লাহর কালামে পাক নিয়ে চিন্তাভাবনা করে না এবং কুরআনের সতর্কবাণী থেকে শিক্ষা নেয় না।
এবারে সূরা হাশরের ২২ থেকে ২৪ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
هُوَ اللَّهُ الَّذِي لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ عَالِمُ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ هُوَ الرَّحْمَنُ الرَّحِيمُ (22) هُوَ اللَّهُ الَّذِي لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الْمَلِكُ الْقُدُّوسُ السَّلَامُ الْمُؤْمِنُ الْمُهَيْمِنُ الْعَزِيزُ الْجَبَّارُ الْمُتَكَبِّرُ سُبْحَانَ اللَّهِ عَمَّا يُشْرِكُونَ (23) هُوَ اللَّهُ الْخَالِقُ الْبَارِئُ الْمُصَوِّرُ لَهُ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَى يُسَبِّحُ لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ (24)
“তিনিই আল্লাহ, যিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই, তিনি অদৃশ্য এবং দৃশ্যের পরিজ্ঞাতা, তিনিই অতি দয়াময়, পরম দয়ালু।” ৫৯:২২
“তিনিই আল্লাহ যিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই, তিনিই [বিশ্বজগতের] অধিপতি, যেকোনো ত্রুটি থেকে পবিত্র, পূর্ণ শান্তিময়, নিরাপত্তা দানকারী, প্রতাপশালী, পর্যবেক্ষক, মহা পরাক্রমশালী, অপ্রতিরোধ্য ও অতীব মহিমান্বিত। যারা [তাঁর] শরীক স্থির করে আল্লাহ তা হতে পবিত্র ও মহান। ” ৫৯:২৩
“তিনিই আল্লাহ, স্রষ্টা, উদ্ভাবনকর্তা, আকৃতিদানকারী; সুন্দরতম নামসমূহ [ও গুণাবলী] তাঁরই; আসমান ও যমীনে যা কিছু আছে সবই তাঁর মহিমা ঘোষণা করে। তিনি মহাপরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।” ৫৯:২৪
সূরা হাশরের এই শেষ তিন আয়াতে মহান আল্লাহর কিছু গুণবাচক নাম বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ হচ্ছে মহান রবের বিশেষ নাম। এই তিনটি আয়াতই সেই আল্লাহ নাম দিয়ে শুরু হয়েছে। এরপর তিন আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের মোট ১৫টি গুণবাচক নাম বর্ণনা করা হয়েছে। তিন আয়াতে যে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে তা হলো- জাত ও সেফাত বা সত্ত্বা ও গুণাবলীতে আল্লাহ এক ও একক এবং তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই।
মহান আল্লাহ বিশ্বজগতের স্রষ্টা এবং এই জগতের সব প্রকাশ্য ও গোপন বিষয়ের ওপর তাঁর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। বিশ্বজগতের কোনো বস্তুই তার জ্ঞানের বাইরে নয়। তাঁর রহমতের ব্যাপ্তিও বিশাল এবং সবকিছুই সেই রহমতের অন্তর্গত। তিনি বিশ্বজগতের অধিপতি, মালিক ও শাসনকর্তা; তিনি সব ধরনের ত্রুটি, অসম্পূর্ণতা ও অজ্ঞতা থেকে মুক্ত ও পবিত্র; তিনি কারো প্রতি অবিচার করেন না এবং সবাই তার কাছে নিরাপদ; তাঁর নাম স্মরণ করলে নিরাপত্তা লাভ হয় এবং অন্তর প্রশান্তি লাভ করে।
সৃষ্টিজগতের সবকিছুর ওপর তাঁর পূর্ণ আধিপত্য রয়েছে। তিনি অপ্রতিরোধ্য এবং তাঁকে মোকাবিলা করার শক্তি কারো নেই। তিনি কোনো সংকল্প করলে তা প্রতিহত করার কেউ নেই। একমাত্র তিনিই এমন সত্ত্বা যার রহমত অসীম ও অফুরন্ত। সমগ্র বিশ্ব চরাচরব্যাপী পরিব্যাপ্ত এবং বিশ্ব-জাহানের প্রতিটি জিনিসই তাঁর বদান্যতা ও অনুগ্রহ লাভ করে থাকে। তাঁর অবস্থান সবকিছুর ঊর্ধ্বে এবং এসব গুণাবলীতে তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই।
তিনি এমন এক স্রষ্টা যিনি তার সকল সৃষ্টিকে অস্তিত্ব ও আকার দিয়েছেন। সৃষ্টি করার জন্য তিনি কারো কাছ থেকে যেমন সাহায্য নেননি তেমনি অন্য কারো মডেলও অনুসরণ করেননি। তিনি সকল সৌন্দর্যের আধার। বিশ্বের সকল সৃষ্টি তাঁর প্রশংসা ও মহিমা ঘোষণা করে এবং তিনি সকল ত্রুটি থেকে পবিত্র।
এই তিন আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:
১- মহান আল্লাহর জ্ঞান ও রহমতের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সবকিছু তাঁর জ্ঞানের অধীন। আমাদের গতিবিধির ওপর তাঁর পূর্ণ দখল রয়েছে বলে যেমন আমাদের মধ্যে ভীতি কাজ করে তেমনি তাঁর বিশাল রহমত আমাদের মধ্যে আশার সঞ্চার করে।
২- বিশ্বজগতের প্রতিপালক এমন এক সত্ত্বা সৃষ্টিজগতের সবকিছুর ওপর যার পূর্ণ আধিপত্য রয়েছে।
৩- আল্লাহর নির্দেশ প্রতিহত করার শক্তি কারো নেই। তাঁর পক্ষ থেকে যা কিছু আসে তা উত্তম ও নিরাপত্তা বিধায়ক। ক্ষতি বা অনিষ্টকর কিছু তাঁর কাছ থেকে আসে না।
৪- প্রশংসা ও মহিমা তাঁরই প্রাপ্য যিনি পূর্ণতার অধিকারী, যেকোনো ত্রুটি থেকে পবিত্র এবং যার কাছ থেকে তাঁর বান্দারা নিরাপত্তা ও কল্যাণ ছাড়া অন্য কিছু পায় না।
তো শ্রোতাবন্ধুরা! এরইসঙ্গে শেষ করছি কুরআনের আলোর আজকের আয়োজন। আগামী আসরেও আপনাদের সঙ্গ পাওয়ার আশা রাখছি।
পার্সটুডে/এমএমআই/ বাবুল আখতার/ ২০
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।