জুন ২৭, ২০২৩ ২৩:২৮ Asia/Dhaka

হযরত খাদিজা (সালামুল্লাহি আলাইহা) মহানবীর (সা.) প্রতি ইমান আনার পর তাঁর সব সম্পদ বিলিয়ে দিয়েছিলেন। ফলে তিনি অনেক সংকটের শিকার হন।

ইমাম জাফর সাদিক্ব (আ) বলেছেন, মহানবীকে বিয়ে করার কারণেও মক্কার কাফির-মুশরিক নারীরা হযরত খাদিজা থেকে দূরে সরে যায়। তাঁর গর্ভে যখন হযরত ফাতিমা এলেন তখনই ফাতিমা মায়ের সঙ্গে কথা বলতেন ও মায়ের অনুরাগী ছিলেন সে সময় থেকেই, তিনি মাকে সে সময়ই ধৈর্য ধারণ করতে বলেছিলেন! যখন হযরত ফাতিমার জন্মলাভের সময় ঘনিয়ে আসে তখন হযরত খাদিজা কুরাইশ ও বনি হাশিমের নারীদের কাছে কাউকে পাঠান যাতে এ সময় তারা তাঁকে সাহায্য করেন। কিন্তু তাদের কেউই হযরত খাদিজাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেননি! এ অবস্থায় ধৈর্যশীল খাদিজাকে সাহায্য করতে মহান আল্লাহ পাঠালেন কয়েকজন বেহেশতি নারী তথা বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন মহিয়সী নারী। তাঁরা ছিলেন হযরত ইব্রাহিমের স্ত্রী সারা, ফেরাউনের স্ত্রী আসিয়া, ইমরানের কন্যা তথা হযরত ঈসার মাতা মারিয়াম ও মুসা নবীর বোন কুলসুম! হযরত খাদিজা আল্লাহর ধর্মের সহায়তা করেছিলেন বলে মহান আল্লাহও তাঁকে সাহায্য করলেন!

সৌদি ওয়াহাবিদের হাতে ধ্বংস হওয়ার আগে মক্কা নগরীতে হযরত খাদিজার (সা) পবিত্র মাজার

পবিত্র কুরআনের সুরা মুহাম্মাদের ৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, হে বিশ্বাসীরা! তোমরা যদি আল্লাহকে তথা তাঁর ধর্ম ও তাঁর রাসুলকে সাহায্য কর তাহলে আল্লাহও তোমাদের সাহায্য করবেন এবং তোমাদের শক্তিশালী করবেন।হযরত খাদিজাই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি রাসুলের প্রতি ঈমান আনেন এবং প্রায় একই সময়ে পুরুষদের মধ্যে প্রথম ইমান আনেন সে সময়কার তরুণ হযরত আলী।  হযরত খাদিজাই ছিলেন মহানবীর রেসালাতের মিশনের প্রথম সহযোগী ও সহায়তাকারী যা তিনি জীবনের শেষ পর্যন্ত অব্যাহত রেখেছেন। সুরা ওয়াক্বিয়ার ১০ ও ১১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:   অগ্রবর্তীগণ তো অগ্রবর্তীই। তাঁরাই আল্লাহর নৈকট্যশীল। - পবিত্র কুরআনে আরও বলা হয়েছে যারা মক্কা বিজয়ের আগে জিহাদ করেছে ও দান-খয়রাত করেছে ও যারা এসব করেছে মক্কা বিজয়ের পর তারা কখনও সমান নয়। একইভাবে যারা ইসলাম প্রচারের আগেই মহানবীকে সম্মান করেছেন ও তাঁর সেবা করেছেন এবং যারা ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধান হওয়ার পর মহানবীর স্ত্রী হয়েছেন তারা কখনও এক সমান হতে পারেন না!

 আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী আ. হযরত খাদিজা (সা.আ.) সম্পর্কে বলেছেন, ইসলাম প্রচারের প্রথম দিকে এমন কোনো ঘর ছিল না যে ঘরের ব্যক্তিরা ছিল মুসলমান কেবল মহানবীর (সা) নিজের ঘর ছাড়া। আর ওই ঘরে ছিলেন মহানবী ছাড়াও হযরত খাদিযাতুল কুবরা ও আমি আলী ছিলাম তৃতীয় ব্যক্তি। মহানবীর পর তিনিই ছিলেন প্রথম মুসলমান। সুরা আহজাবের ৩৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: অবশ্যই আত্ম-সমর্পণকারী (মুসলিম) পুরুষ ও আত্ম-সমর্পণকারী (মুসলিম) নারী, মুমিন পুরুষ ও মু'মিনা নারী, অনুগত পুরুষ ও অনুগতা নারী, সত্যবাদী পুরুষ ও সত্যবাদিনী নারী, ধৈর্যশীল পুরুষ ও ধৈর্যশীলা নারী, বিনীত পুরুষ ও বিনীতা নারী, দানশীল পুরুষ ও দানশীলা নারী, রোজা পালনকারী পুরুষ ও রোজা পালনকারী নারী, যৌনাঙ্গ হিফাযাতকারী পুরুষ ও যৌনাঙ্গ হিফাযাতকারী নারী, আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী পুরুষ ও অধিক স্মরণকারী নারী - এদের জন্য আল্লাহ প্রস্তুত রেখেছেন ক্ষমা ও মহা প্রতিদান।– হযরত খাদিজা ছিলেন এই আয়াতের দর্পণ তথা এই আয়াতে উল্লেখিত গুণগুলোর দৃষ্টান্ত। আমাদেরও উচিত এইসব গুণ অর্জনে সচেষ্ট হওয়া।

 হযরত খাদিজা (সা.আ.) ছিলেন মহানবীর সর্বোত্তম সহায়তাকারী ও সব সময়ের সঙ্গী। ইসলাম আমাদের কাছে আসতে পারতো না এই মহিয়সী নারীর অনন্য দান ও ত্যাগ-তিতিক্ষা ছাড়া। তাই আমাদেরও উচিত ইসলামের জন্য এমনিভাবে জীবনের সব কিছু বিলিয়ে দিতে সচেষ্ট হওয়া। ইসলামকে শক্তিশালী করা ও ছড়িয়ে দেয়ার ব্যাপারে হযরত খাদিজার অবদান ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মহানবী (সা) হযরত খাদিজাকে মানব-ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ চার মহামানবীর অন্যতম বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিনম্র ও খোদাভীরু আবেদ তথা ইবাদতকারী। আল্লাহ ও মহানবীর প্রতি বিশ্বাসে অবিচল এই মহামানবীর কথা ও কাজে অমিল ছিল না। তিনি কঠিন সংকটের মধ্যেও ছিলেন ধৈর্যশীল। পবিত্র এই মহামানবী রাত জেগে ইবাদত করতেন এবং সব সময় আল্লাহকে স্মরণ করতেন এবং সব সময় আল্লাহকে সন্তুষ্ট রাখতে সচেষ্ট ছিলেন। আরব দেশে অজ্ঞতার যুগে সতী-সাধ্বী নারী ছিল মুষ্টিমেয়। সে সময়ও চারিত্রিক পবিত্রতার কারণে হযরত খাদিজা ত্বাহিরা তথা পবিত্র শীর্ষক উপাধি পেয়েছিলেন! তাঁর দানশীলতাসহ নানা মহতী গুণের খ্যাতি এতই ছড়িয়ে পড়েছিল যে সে যুগেই তাঁকে সবাই নারী সমাজের নেত্রী নামে শ্রদ্ধা জানাতেন।

মহানবী (সা) ২৫ বছর বয়সে নিজের চেয়ে দশ বছরের চেয়েও বেশি বয়স্ক হযরত খাদিজাকে বিয়ে করেছিলেন। মহানবীও চারিত্রিক পবিত্রতার ক্ষেত্রে ছিলেন সর্বোত্তম। হযরত খাদিজার ঘরে মহানবীর দুই পুত্র সন্তান কাসেম ও আবদুল্লাহ জন্ম নিয়েছিলেন। কিন্তু তারা খুব কম বয়সেই মারা যান। মহানবীর চার কন্যা জাইনাব, রুকাইয়া, উম্মে কুলসুম ও ফাতিমাও- (তাঁদের সবার প্রতি সালাম) জন্ম নিয়েছিলেন খাদিজার ঘরে। কেবল ইব্রাহিম নামক এক পুত্র ছাড়া মহানবীর অন্য স্ত্রীদের ঘরে কোনো সন্তান জন্ম নেয়নি। ইব্রাহিমও খুব কম বয়সে মারা যান। হযরত খাদিজা যতদিন বেঁচে ছিলেন তাঁর সম্মানে মহানবী অন্য কোনো স্ত্রী গ্রহণ করেননি। হযরত খাদিজার মৃত্যুর পরও তিন বছর পর্যন্ত কোনো নারীকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেননি মহানবী (সা)। তিনি সব সময় হযরত খাদিজাকে শ্রদ্ধাভরে ও কৃতজ্ঞ চিত্তে সজল চোখে স্মরণ করতেন। হযরত খাদিজাই সবচেয়ে দীর্ঘকাল রাসুলের স্ত্রী ছিলেন। হযরত খাদিজার পর মহানবী কয়েকটি বিয়ে করেছিলেন কেবল ইসলামের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রয়োজনেই।  

হে খাদিজা! আল্লাহ প্রতিদিন তোমার সম্পর্কে কয়েকবার ফেরেশতাদের কাছে গর্ব করেন!: মহানবী (সা)

আরবের শীর্ষস্থানীয় ধনী হিসেবে খ্যাত হযরত খাদিজা তাঁর সব সম্পদ বিলিয়ে দিয়েছিলেন ইসলাম ও মুসলমানদের কল্যাণে।  মহানবী (সা) হযরত খাদিজার অর্থ দিয়ে ঋণগ্রস্তদের ঋণমুক্ত এবং বিপদগ্রস্ত, অভাবগ্রস্ত ও অক্ষমদের সহায়তা করতেন। দরিদ্র ও অভাবী সাহাবিদেরকেও মহানবী সাহায্য করতেন হযরত খাদিজার অর্থ দিয়ে। যারা মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করতে চাইতেন তাদের সফরের খরচ দেয়া হত হযরত খাদিজার অর্থ থেকে। তাই মহানবী (সা) বলেছিলেন, খাদিজার সম্পদে যত বেশি কল্যাণ পেয়েছি আর কারো সম্পদে ততটা পাইনি। তিনি আরও বলেছেন, ইসলাম বিস্তারের মাধ্যম ছিল দুটি: খাদিজার সম্পদ ও আলীর তরবারি! -উল্লেখ্য কাফির মুশরিকরা যখন মুসলমানদের ওপর কঠোর অবরোধ আরোপ করে তাদেরকে শেবে আবিতালিব নামক উপত্যকায় বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকতে বাধ্য করেছিল তখন খাদিজার সম্পদ ব্যয় করা না হলে মুসলমানরা অনাহারে মারা যেত এবং ইসলাম শেষ হয়ে যেতো!

হযরত খাদিজার ইস্পাত-কঠিন বা অনন্য অবিচল ইমানের কারণে তিনি ছিলেন মহান আল্লাহ, রাসুল ও ফেরেশতাদেরও পছন্দের ব্যক্তি। এ প্রসঙ্গে মহানবী (সা) বলেছিলেন, হে খাদিজা! মহান আল্লাহ প্রতিদিন তোমার অস্তিত্ব নিয়ে কয়েকবার ফেরেশতাদের কাছে গর্ব প্রকাশ করেন!অনন্য ঈমান ও ত্যাগের কারণে মহান আল্লাহ নিজে হযরত খাদিজার কাছে সালাম পাঠাতেন। ইসলাম গ্রহণের কারণে তিনি বন্ধু ও পরিচিত মহলের অনেকেরই নানা তিরস্কার ও যন্ত্রণা সহ্য করেছেন। তিনি সে যুগের সব রাজনৈতিক ও সামাজিক আঘাতের শিকার মনঃক্ষুণ্ণ ও আহত মহানবীকে যোগাতেন উপশম আর প্রশান্তি। মহান খাদিজা মহানবীর রেসালাতের মিশন অব্যাহত রাখতে সহায়তা দিতেন এবং তিনি নিজেও এই পথেই উন্নতি ও পূর্ণতা অর্জন করেছেন।#

পার্সটুডে/এমএএইচ/২৭

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন