ইরাক ও ইউক্রেন ইস্যুতে পরস্পরবিরোধী অবস্থান
ইরাকে মার্কিন হামলাকে আগ্রাসন করতে নারাজ জন কেরি
আজকের আলোচনায় আমরা ইরাক ও ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যাপারে সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির পরস্পরবিরোধী বক্তব্য সম্পর্কে কথা বলব।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সরকারের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি ফরাসি টিভি চ্যানেলকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে তার ভাষায় ইউক্রেনে রুশ সামরিক অভিযানকে আগ্রাসন হিসেবে উল্লেখ করেছেন। একই সাথে ইরাকে মার্কিন সামরিক অভিযানকে আগ্রাসন বলা যায় কিনা সাংবাদিকের এমন এক প্রশ্নের উত্তরে জন কেরি বলেছেন, 'না, ইরাকে মার্কিন সামরিক অভিযানকে আগ্রাসন বলা যাবে না। কারণ তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের বিরুদ্ধে কখনো সরাসরি কোনো অভিযোগ ছিলনা'। ইরাক যুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ হয়েছে কিনা সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে সাবেক এই মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি দাবি করেছেন, 'ইরাকের ঘটনাবলীকে যুদ্ধাপরাধ বলা যাবে না। যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্ন অপরাধের ঘটনা ঘটেছে তবে আমি তার প্রতিবাদ করেছি এবং এ বিষয়ে কথা বলেছি'।
এক জরিপে দেখা গেছে, ইরাকে বুশ-ব্লেয়ারের আগ্রাসন, দখলদারিত্ব ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির কারণে দশ লাখেরও বেশি ইরাকি নাগরিক নিহত হয়েছে। ইরাকি বন্দীদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালানোসহ নানা ধরনের যুদ্ধাপরাধে লিপ্ত ছিল মার্কিন সেনারা। রাজধানী বাগদাদের অদূরেই অবস্থিত কুখ্যাত আবু গোরাইব কারাগারে মার্কিন সামরিক কর্মকর্তারা জেনেভা কনভেনশন লঙ্ঘন করে ইরাকি বন্দীদের ওপর বর্বরোচিতভাবে নির্যাতন চালিয়েছিল। মার্কিন সেনারা গ্রাম এলাকায় হামলা চালিয়ে বহু নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে। অবশেষে মার্কিন সেনাদের বন্দী নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের কারণে ইরাকে প্রতিরোধ শক্তি গড়ে ওঠে। আন্তর্জাতিক সমাজ ইরাকের বিরুদ্ধে বুশ-ব্লেয়ারের যুদ্ধের বিরোধিতা করলেও এতোবড় অপরাধযজ্ঞ ঠেকাতে কেউ এগিয়ে আসেনি। আমেরিকা কিংবা ব্রিটেনের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিতেও কেউ এগিয়ে আসেনি। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের পক্ষ থেকেও কোনো রকমের জবাবদিহিতা চাওয়া হয়নি। কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন ইরাকে ধর্ষণের ঘটনায় ব্লেয়ারের বিরুদ্ধে অভিযোগ আরোপের আহ্বান জানালেও কোনো সরকারই তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করার প্রস্তাব নিয়ে জাতিসংঘে যায়নি।
কিন্তু, ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যাপারে আমরা পাশ্চাত্যের আচরণে ভিন্ন চিত্র দেখতে পাচ্ছি যা কিনা সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির বক্তব্যে ফুটে উঠেছে। ন্যাটোর রাশিয়া অভিমুখে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টার বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে মার্কিন কর্মকর্তারা ইউক্রেন ইস্যুতে একচেটিয়াভাবে মস্কোকে দায়ী করার চেষ্টা করছে। অথচ ইরাকে ইঙ্গ-মার্কিন সামরিক আগ্রাসন ছিল সম্পূর্ণ বেআইনি ও অবৈধ। ইরাকে এখন যে ধ্বংসযজ্ঞ ও অমানবিক পরিস্থিতি দেখা যায় তা ওই আগ্রাসনেরই ফল। গত কয়েক শতাব্দীতে সামরিক আগ্রাসনে এ পর্যন্ত যত ইরাকি মারা গেছে তার বেশিরভাগই ইঙ্গ-মার্কিন হামলায় মারা গেছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দামের শাসনামলের চাইতেও বিদেশি আগ্রাসনে বেশি মানুষ মারা গেছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের নেতৃত্বে মার্কিন সরকার ২০০৩ সালে ইরাক সরকারের বিরুদ্ধে দুটি বড় অভিযোগ আনে। এক, ইরাকে রাসায়নিকের মতো গণবিধ্বংসি অস্ত্রের মজুদ এবং দুই, আল-কায়দার মতো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সাথে সাদ্দামের যোগসাজশ। যদিও পরবর্তীতে এসব অভিযোগের কোনটি প্রমাণিত হয়নি।
সন্দেহজনক গণবিধ্বংসি অস্ত্রের মজুদ ও আল-কায়দার সাথে যোগসাজশের অভিযোগ তুলে এটাকেই যুক্তি হিসাবে দাঁড় করিয়ে আমেরিকা ও তার মিত্ররা ইরাকে একতরফা হামলা চালায়। তবে, তাদের এই যুক্তির সত্যতা নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। এ কারণে ব্রিটেনসহ আরো অনেক দেশে যুদ্ধবিরোধী ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। এমনকি যুদ্ধের পটভূমি সৃষ্টির জন্য রাসায়নিক অস্ত্র তৈরি ব্যাপারে পাশ্চাত্য মিডিয়া এমনভাবে প্রচারণা চালায় যাতে যুদ্ধের পক্ষে বিশ্ব-জনমত তৈরি হয়।
ইরাকে হামলার আগে অনেক বিশ্লেষক ইঙ্গ-মার্কিন মিথ্যাচারের বিষয়ে সতর্ক ছিল। কারণ যুদ্ধের আগে ইরাক এক দশক ধরে অবরুদ্ধ ছিল। এছাড়া, ইরাকে বিদেশী গোয়েন্দা বাহিনীর অনুপ্রবেশ ও গণবিধ্বংসি অস্ত্র অনুসন্ধানের পর মার্কিন নেতৃত্বে পশ্চিমা মিত্ররা এটা নিশ্চিত ছিল যে ইরাকে কোন গণ-বিধ্বংসী অস্ত্র নেই। এ ছাড়া জাতিসংঘের কর্মকর্তারাও নিশ্চিত করেছিলেন ইরাকে কোনো গণবিধ্বংসি অস্ত্র নেই। তারপরও পশ্চিমারা ইরাকে হামলার তোড়জোড় শুরু করে।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের সাথে ওই দেশটির তেল-সম্পদ লুণ্ঠন করার একটা সম্পর্ক ছিল যাতে পরবর্তীতে তেল সমৃদ্ধ সমগ্র এ অঞ্চলের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা যায়। যদিও ইরাকের বিরুদ্ধে হামলায় তৎকালীন মার্কিন সামরিক কমান্ডার জেনারেল টমি ফ্রাঙ্কস দাবি করেছিলেন, ইরাকের জনগণের জন্য সাদ্দামের নিয়ন্ত্রণে থাকা তেলের কূপগুলো উদ্ধার করাই তাদের মূল উদ্দেশ্য কিন্তু সাদ্দামের পতন ও ইরাক দখলের পর দেখা গেল মার্কিনী সেনারা সমস্ত তেলকুপ দখল করে নিয়েছে এবং মার্কিন ঠিকাদার ও নিরাপত্তা বিষয়ক কোম্পানিগুলোর কাছে সেগুলো ন্যস্ত করেছে। ব্ল্যাক ওয়াটারের মতো কোম্পানি পরবর্তীতে আন্ নুসরা স্কয়ারে বেসামরিক ইরাকিদের ওপর ব্যাপক গণহত্যা চালায়। "ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক" ম্যাগাজিন ২০১৩ সালে জানিয়েছিল, 'যুদ্ধ শুরুর ১০ বছর পর মার্কিন হামলার ফলে ১১ লাখ ইরাকি বাস্তুচ্যুত হয়েছে। তবে রেড ক্রস অনুমান করেছে যে ইরাকি শরণার্থীর সংখ্যা ২৩ লাখ হবে। এই সংখ্যা ২০১৫ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছিল সাড়ে ৪০ লাখে। ইরাককে স্বাধীন করার নামে এ জঘন্য অপরাধযজ্ঞ চালানো হয়।
ইরাকে মার্কিন হামলার পর তিন বছরে অন্তত অর্ধেক চিকিৎসক দেশ ছেড়ে চলে যায়। ফলে ২০০৭ সালের মধ্যে পুষ্টিহীন শিশুর সংখ্যা ২৮ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছিল। এক রিপোর্টে দেখা যায় ৬০ শতাংশ ইরাকি শিশু মানসিক সমস্যায় ভুগছে। এ ছাড়া মার্কিন আগ্রাসনে ইরাকের অর্থনৈতিক ক্ষতির পাশাপাশি কৃষি, শিল্প ও স্বাস্থ্যখাতে গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগুলো ধ্বংস হয়ে যায়। দুষিত পানির কারণে বিভিন্ন ধরনের রোগ ছড়িয়ে পড়ে। মার্কিন আগ্রাসনে ইরাকের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে দায়েশ বা আইএস জঙ্গি সন্ত্রাসীদের তাণ্ডবে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প স্বীকার করেছেন তারাই এসব সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর জন্ম দিয়েছিল এবং বহু আগে থেকেই তাদেরকে সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল।
যাইহোক, এভাবে তাণ্ডব চালিয়ে সমৃদ্ধ ইরাককে কার্যত ধ্বংস করে দিয়েছে মার্কিন সরকার যা প্রকাশ্য আগ্রাসন ও যুদ্ধাপরাধ। অথচ সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি আইনশাস্ত্রে পড়ালেখা করেও টিভি চ্যানেলকে দেয়া সাক্ষাতকারে ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনকে যুদ্ধাপরাধ বলতে রাজি নন। অথচ তিনি ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলাকে যুদ্ধাপরাধ ও আগ্রাসন হিসেবে অভিহিত করেছেন। এ থেকে ইরাক ও ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যাপারে মার্কিন দ্বিমুখী নীতি ফুটে উঠেছে।#
পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।