জুলাই ০৩, ২০২৩ ১৫:২১ Asia/Dhaka

গত অনুষ্ঠানে আমরা জীববিজ্ঞানের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস এবং এ ব্যাপারে প্রাচীন ইরানিদের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে আলোচনা করেছিলাম। আজকের অনুষ্ঠানেও আমরা জীববিজ্ঞানে ইরানি মনীষী ও চিন্তাবিদদের গবেষণা কর্ম সম্পর্কে বর্ণনা দেয়ার চেষ্টা করবো। আশা করি শেষ পর্যন্ত আপনাদের সঙ্গ পাব।

ঐতিহাসিক তথ্যসূত্রে এটা স্পষ্ট যে ইরানি মুসলিম বিজ্ঞানীরাও জীববিজ্ঞানের ওপর প্রাচীন ইরানি গবেষণাকর্ম ও অভিজ্ঞতা ব্যবহার করেছেন। যদিও ইসলামের প্রাথমিক যুগে ইরানের মুসলিম বিজ্ঞানীদের জীববিদ্যা সংক্রান্ত জ্ঞান ধর্মীয় বিশ্বাস দ্বারা প্রভাবিত ছিল এবং ঐশি শিক্ষার আলোকে এ সংক্রান্ত চিন্তাগবেষণা আবর্তিত হতো কিন্তু তা ছিল প্রাক ইসলামি যুগের অভিজ্ঞতাকে ধারণ করেই। ইরানি জীববিজ্ঞানী এবং বিশ্বকোষ লেখকরা তাদের বিভিন্ন লেখনিতে পূর্বসূরীদের দেয়া তথ্য-উপাত্ত ও গ্রন্থ, বিশ্ব ভ্রমণকারীদের দেয়া বর্ণনা পর্যালোচনা করতেন এবং নিজেদের মতামত বা এমন সব নতুন তত্ত্ব তুলে ধরতেন যা কিনা বিশ্ববাসীর জন্য ছিল বিস্ময়কর। উদাহরণ স্বরূপ, ইখওয়ান আল-সাফার প্রবন্ধসমূহ, জাকারিয়া কাজভিনির 'আজায়েব আল-মাখলুকাত' গ্রন্থ, আবু রেইহান বিরুনীর রচনাসামগ্রী প্রভৃতি মূল্যবান বইয়ের কথা উল্লেখ করা যায় যেখানে মুসলিম মনীষীরা নিজস্ব মতামত তুলে ধরেছেন।

এছাড়াও কৃষি ও উদ্ভিদবিদ্যা বিষয়ে "আবু হানিফা আহমাদ বিন দাউদ দিনওয়ারি" রচিত "আল-নাবাত", সমরকান্দের নিজামী আরওয়াজির লেখা চারটি গবেষণালব্ধ প্রবন্ধসহ আরো কিছু বই ইরানে জীববিজ্ঞান সংক্রান্ত জ্ঞানের বিকাশ লাভে ভূমিকা রেখেছে। ৫৫৫ হিজরিতে মোহাম্মদ বিন মাহমুদ বিন আহমদ তুসি রচিত 'সৃষ্টির বিস্ময়' বইটি এবং হামাদুল্লাহ মোস্তোফির রচিত "নুজহাত আল-কুলুব" বইটিতে প্রাণী, তাদের দেহতত্ত্ব এবং মৌমাছি ও রেশম কীটের জীবন প্রক্রিয়া সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য রয়েছে। এটা জেনে রাখা ভালো যে খ্রিস্টীয় দশম ও এগারো শতাব্দীতে জীববিদ্যা সম্পর্কে আবু রেইহান বিরুনির দেয়া তত্ত্ব  বা  ধারণাগুলোর সাথে ১৯ শতকে এসে ম্যালথাস ও ডারউইনের মতো বিবর্তনবাদী ব্যক্তিদের চিন্তাভাবনাগুলোর পার্থক্য চোখে পড়ে। এসবের পাশাপাশি আমরা মওলানা জালালউদ্দিন রুমি এবং আত্তার নিশাপুরির মতো মহান ইরানি আধ্যাত্মিক ব্যক্তিদের কথা উল্লেখ করতে পারি যারা তাদের লেখা ও কবিতায় মানুষ ও বিশ্ব প্রকৃতির পূর্ণতায় পৌঁছার কথা উল্লেখ করেছেন। ডারউইন জীবের শারীরিক বিবর্তনের কথা বলেছেন কিন্তু মুসলিম মনীষীরা ধাপে ধাপে আধ্যাত্মিক পূর্ণতার কথা বলেছেন। 

ইরানি পৌরাণিক কাহিনীগুলোতে এবং মহাকবি ফেরদৌসির রচিত বিখ্যাত শাহনামা মহাকাব্যে আমরা প্রাণীদের সম্পর্কে যে ধারণা পেয়েছি তাতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানুষের দ্বারা প্রাণীদের ব্যবহার পদ্ধতির বিষয় উঠে এসেছে। প্রাণীবিদ্যা হল জীববিজ্ঞানের একটি শাখা যা সমস্ত দিক থেকে প্রাণীদের সম্পর্কে গবেষণা ও নানান কাজে তাদের ওপর পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানো হয়। অর্থাৎ প্রাণীদের শরীরের গঠন অধ্যয়ন, তাদের বৈশিষ্ট্য পরীক্ষা করে তাদের রোগ শনাক্ত করা এবং সেসব রোগের চিকিৎসার উপায় বের করার জ্ঞান হচ্ছে প্রাণীবিদ্যা। আধুনিক বিশ্বে এ সংক্রান্ত বিদ্যা জীববিজ্ঞান, প্রাণী বিজ্ঞান এবং পশুচিকিত্সা প্রভৃতি শাখায় বিভক্ত হয়ে গেছে।

প্রত্নতাত্ত্বিক বিভিন্ন নিদর্শন ও পাহাড়ের গায়ে আঁকা বিভিন্ন প্রাণীর খোদাই করা চিত্র থেকে বোঝা যায় অতীতকাল থেকেই মানুষের সেবায় প্রাণীর বিভিন্ন ব্যবহার হতো। ইরানে পাহাড় খোদাই করা এরকম বহু চিত্র পাওয়া যায় যাতে দেখা যায় প্রাচীনকালে ইরানিরা বাজ পাখি দিয়ে শিকার ধরতো। এ থেকে বোঝা যায় তখনকার মানুষ এ ধরণের প্রাণীর রক্ষণাবেক্ষণ, তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও উপকারিতা সম্পর্কে ধারণা রাখতো। প্রাচীন ইরানে প্রাণীদের বিষয়ে তেমন কোনো তথ্য সংগ্রহে নেই কিন্তু এ বিষয়ে ইরানিদের জ্ঞান সম্পর্কে আমরা যা জানি তার বেশিরভাগই প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ ও পৌরাণিক গ্রন্থ থেকে পাওয়া। যেমন শাহনামা মহাকাব্য থেকে অতীতে ইরানিদের বীরত্বগাথা বর্ণনায় পশু ব্যবহারের বিষয়ে তথ্য জানা যায়।

প্রাণী সংক্রান্ত ইবনে সিনার 'কিতাব আল হেইওয়ান' গ্রন্থে উল্লেখিত প্রাণীবিদ্যায় তার অধ্যয়ন ও গবেষণা পদ্ধতি ইরানি অন্যান্য প্রাণীবিজ্ঞানীদের তুলনায় অনেক সমৃদ্ধ। ইবনে সিনা প্রাণীবিজ্ঞানকে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের সপ্তম অধ্যায় হিসেবে উল্লেখ করে একে  প্রাণীর মনোবিজ্ঞানের আগে স্থান দিয়েছেন।  

ইরানে প্রাণীবিদ্যা বিষয়ে গবেষণা কর্মের সাথে জড়িতদেরকে দুইভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমত, একদল ব্যক্তি যাদের সাথে সরাসরি প্রাণীদেরকে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। এই দলটি বিভিন্ন প্রাণী সম্পর্কে প্রচুর তথ্য জানে এবং এসবের বর্ণনা দিত পারে যা কিনা প্রাণীবিদ্যার খুবই গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করে। আর দ্বিতীয় শ্রেণীর ব্যক্তিরা পশু চিকিৎসা ও গবেষণা কাজে নিয়োজিত যারা পশুর বিভিন্ন রোগ নিরাময়ের উপায় ও ল্যাবরেটরিতে ওষুধ তৈরিতে ভূমিকা রাখে।

যাকারিয়া বিন মুহাম্মদ বিন মাহমুদ কাজভিনি লেখা 'আজায়েব আল মাখলুকাত এবং গারায়েব আল মওজুদাত' নামক গ্রন্থে প্রাণী জগতের অনেক দিক উঠে এসেছে। তিনি আরবিতে  এ বইটি রচনা করেন এবং এরপর  ১২৮১ সালে নিজেই শামসুদ্দিন জুইয়ানির  জন্য ফার্সিতে এ গ্রন্থটি অনুবাদ করেন। কাজভিনি তার এ বইয়ের শুরুতে পবিত্র কুরআনের আয়াত উদ্ধৃত করেন এবং দুটি গল্প তুলে ধরেন। এরপর তিনি বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেন।

কাজভিনি বলেছেন, এ বইয়ে তিনি বিশ্বপ্রকৃতির রহস্য নিয়ে চিন্তাশীল ব্যক্তিদের মতামত ও বিতর্কগুলো নিয়ে আলোচনা ও পর্যালোচনার চেষ্টা করেছেন যাতে সৃষ্টির বহু রহস্য উদঘাটন করা যায় এবং মহান সৃষ্টিকর্তার ক্ষমতার বিষয়টি উপলব্ধি করা যায়।

কাজভিনি প্রাণী সম্পর্কে আলোচনার শুরুতে খনিজ, উদ্ভিদ এবং প্রাণীর বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করার সময় ইন্দ্রিয় অনুভূতিকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসাবে উল্লেখ করেছেন যা প্রাণীদেরকে অন্য দু'টি গোষ্ঠী থেকে আলাদা করেছে।  প্রাণীদের এই ইন্দ্রিয় অনুভূতি মহান সৃষ্টিকর্তার এক অপূর্ব দান যে কারণে প্রাণীরা যে কোনো বিপদ আপদ থেকে নিজেদেরকে রক্ষা  করতে পারে। কাজভিনি প্রাণী জগতের মধ্যে যে শ্রেণীভাগ করেছেন তার মধ্যে জিনদেরকেও অন্তর্ভুক্ত করেছেন। প্রাণীদের শ্রেণী বর্ণনা করার পাশাপাশি তিনি তাদের বিভিন্ন প্রজাতির পরিচয় বা বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন।

ইরানে বহুকাল ধরে জীববিজ্ঞানের ওপর গবেষণা চলে আসছে। "প্রাণীর উপকারিতা" আরেকটি মূল্যবান গ্রন্থ যা থেকে ইরানে অতীতে জীববিজ্ঞান এবং প্রাণীদের ওপর গবেষণালব্ধ মূল্যবান জ্ঞান বর্তমানে ইরানিদের হাতে এসে পৌঁছেছে। এ বইটির লেখক আব্দুল হাদি বিন মোহাম্মদ  বিন মাহমুদ বিন ইব্রাহিম মারাগি। হিজরি ১৩ শ' শতাব্দীতে তিনি এ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। বইটিতে প্রাণী এবং তাদের শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের চিকিৎসা ও ঔষধি বৈশিষ্ট্য নিয়ে বর্ণনা রয়েছে। #

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ