জুলাই ২৩, ২০২৩ ১৭:৪৮ Asia/Dhaka

গত কয়েক পর্বে আমরা কারবালা বিপ্লবের ঐতিহাসিক নানা পটভূমি ও ঘটনা-প্রবাহের গতি-প্রকৃতি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আমরা দেখেছি যে মক্কা ও মদিনার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ও সাহাবিদের অনেকেই জানতেন যে ইমাম হুসাইন (আ) যদি কুফার দিকে যান তাহলে তিনি সেখানে শহীদ হবেন।

অন্যদিকে কুফাবাসীদের এক বিপুল অংশ মুয়াবিয়ার ও ইয়াজিদি শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আশা করতেন। মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর ইমামের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ ও ইমামের নেতৃত্বে খোদাদ্রোহী ইয়াজিদি প্রশাসনের প্রতি বিদ্রোহের আহ্বানের মাত্রা বহু গুণ বেড়ে যায়। তারা যদি শেষ পর্যন্ত তাদের অবস্থানে অবিচল থাকতো তাহলে ইতিহাস হত ভিন্ন ধরনের। এমনকি আমন্ত্রণকারীদের মধ্যে কয়েক শ ব্যক্তিও যদি ইমামের সঙ্গী হতেন  এবং জেনারেল হুরের মত ইয়াজিদ বাহিনীর আরও কয়েকজন জেনারেল ইয়াজিদের দল ত্যাগ করে ইমামের পক্ষে যোগ দিতেন তাহলেও হয়তো ইতিহাসের চাকা ঘুরে যেত তথা ইমামের শিবির বাহ্যিক ও নৈতিক বিজয় দুটোই হয়ত অর্জন করতো।

কিন্তু দুঃখজনকভাবে ইয়াজিদ বাহিনীর নৃশংসতার কয়েকটি মহড়া দেখেই বেশিরভাগ কথিত বিপ্লবী কুফাবাসী চুপসে যায়। তারা ইমামের প্রতিনিধি তথা ইমামের চাচাতো ভাই মুসলিম ইবনে আকিলকে নিঃসঙ্গ অবস্থায় শহীদ হতে বাধ্য করে।ইমাম হুসাইনের কাছে মুসলিম ইবনে আকিলের (র.) শাহাদাতের মর্মান্তিক খবর পৌঁছার পরও ইমাম কুফা অভিমুখে যাত্রা অব্যাহত রাখেন। কুফায় ইমামের রাজনৈতিক সমর্থক গোষ্ঠীর প্রায় সবাই পালিয়ে বেড়াবেন বা ইমামের সহায়তায় এগিয়ে আসতে সাহসী হবেন না-এটা জানা সত্ত্বেও ইমাম কেন কুফার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন?

“আল্লাহর রাসূলের (সা.) রক্ত মাংস, যা আবা আব্দিল্লাহর শরীরে আছে, তা রাসূল (সা.) হতে পৃথক হবে না এবং বেহেশতে তাঁর সাথে সম্মিলিত হবে।”

এ প্রশ্নের উত্তর হল যারা ইমামের জন্য একান্তই নিবেদিত-প্রাণ তাঁরা ঠিকই কুফা থেকে ইমামের শিবিরে যোগ দিবেন এবং তাঁদের সংখ্যা যতই কম হোক না কেন ইমাম তাঁদেরকে নিয়ে সর্বোচ্চ ত্যাগ ও শাহাদাতের অমর সংস্কৃতির সর্বোত্তম প্রকাশ ঘটানোর জন্য দৃঢ়-প্রতিজ্ঞ ছিলেন। মহানবীর (সা) উপদেশ এবং পরিস্থিতির আলোকে ভগ্ন-হৃদয়, ভীরু ও মৃতপ্রায় জাতিকে বীরত্ব, সাহসিকতা ও দায়িত্বশীলতার পাঠ শেখাতে ইয়াজিদের বিশাল বাহিনীর মোকাবেলায় ইমাম হুসাইন (আ) তাঁর নিবেদিতপ্রাণ সঙ্গী ও নবী-পরিবারের পুরুষ সদস্যদের নিয়ে শেষ পর্যন্ত শাহাদতের অমিয় সুধা পান করেন। কিন্তু তার আগে রেখে যান বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের অমর এক মহাঅধ্যায়। তাঁদের ওই বীরত্বপূর্ণ শাহাদাত ইসলামের ইতিহাসকে যত বেশি প্রভাবিত করেছে পরবর্তীকালে আর অন্য কিছুই ইসলামের জন্য এত বেশি প্রভাব ও শক্তির উৎস হতে পারেনি।

কারবালায় ইমাম হুসাইন(আ)সহ নবী-পরিবার ও নবী-পরিবারের সমর্থক ত্যাগী বীরদের নজিরবিহীন আত্মত্যাগ এবং নজিরবিহীন অসহায়ত্ব ও নৃশংসতার শিকার হওয়ার বিষয়গুলো মুসলিম সমাজের বিবেকবান মানুষের বিবেকের ভিত্তিমূলে প্রবল বেদনা ও হাহাকারের মহাপ্লাবন বইয়ে দিয়েছিল। ফলে অনুশোচনার আগুনে দগ্ধ হয়েছিল সমর্থক মহল ও ন্যুনতম বিবেকধারী সব ব্যক্তি। অন্যদিকে আসল সত্য প্রকাশ হয়ে পড়ায় নড়বড়ে হয়ে পড়ে উমাইয়া শাসকগোষ্ঠীর শাসনের নৈতিক ভিত্তিমূল।  তাই খুব দীর্ঘকাল ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেনি উমাইয়া শাসকগোষ্ঠী। ইমাম হুসাইন (আ) যদি বিপুল সংখ্যক সমর্থকদের নিয়ে ইয়াজিদি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করে ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠা করতেন তাহলে কখনও ত্যাগ ও শাহাদাতের সংস্কৃতির প্রেমময় ভাবাবেগ ও আকুলতার প্রসার ঘটতো না। শাহাদাতের টগবগে আবেদনে মুমিনদের হৃদয় টইটম্বুর হত না। ইমামের শাহাদাতকামী দূরদৃষ্টির ব্যাখ্যা লুকিয়ে আছে এখানেই।

অন্যরা যখন বাহ্যিক জয়-পরাজয়ের হিসেব কষছিলেন তখন ইমাম হিসাব করছিলেন ইসলামের চারাগাছের জন্য সবচেয়ে জরুরি হয়ে পড়া মৃতসঞ্জীবনীর যোগান দেয়ার অপরিহার্যতা বা শাহাদাতের গুরুত্ব তুলে ধরার পন্থা সম্পর্কে।ধর্মীয় অন্তর্দৃষ্টি ও দূরদৃষ্টি না থাকায় ইমামের শুভাকাঙ্ক্ষীদের অনেকেই ইমাম হুসাইনের বিপ্লবের সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনার তাৎপর্য  বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিল। তারা চিন্তা করছিলেন ইমামের বাহ্যিক জীবন বাঁচানো যায় কিভাবে। কারণ তারা ছিলেন অনেকেই ইমামের বন্ধু ও নিকট-আত্মীয়। কিন্তু ইমাম অন্তর্দৃষ্টি ও দূরদৃষ্টি দিয়ে চিন্তা করছিলেন ইসলামের জীবন বাঁচানো যায় কিভাবে তথা মৃতপ্রায় ইসলামকে আবারও কিভাবে জীবন্ত ও প্রাণবন্ত করা যায়?! 

আশুরা তরবারির ওপর রক্তের বিজয়ের দিন

যিলহজ্জ মাসের ৮ তারিখে, ইমাম হুসাইন (আ) যখন মক্কা হতে ইরাকের উদ্দেশ্যে রওনা হচ্ছিলেন তখন তিনি হাজীদের উদ্দেশ্যে দেয়া এক ভাষণে বলেন : বনী আদমের জন্যে মৃত্যু, ঠিক যুবতী মেয়েদের গলার হারের মতই মানানসই। তিনি আরও বলেন : “আমি যেন দেখতে পাচ্ছি আমার শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলিকে কারবালা এবং নাওয়াবিস ভূমির মাঝে মরুভূমির নেকড়েরা ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে !” “আল্লাহর রাসূলের (সা.) রক্ত মাংস, যা আবা আব্দিল্লাহর শরীরে আছে, তা রাসূল (সা.) হতে পৃথক হবে না এবং বেহেশতে তাঁর সাথে সম্মিলিত হবে।” অনুরূপভাবে,যখন তিনি মক্কা হতে বের হতে চাচ্ছিলেন তখন তিনি এক লাইনের এক পত্রে বনী হাশিমদের লিখেছিলেন “তোমাদের মধ্য হতে যে আমার সাথে মিলিত হবে সেই শহীদ হবে, আর যে আমাকে সহযোগিতা করা হতে বিরত থাকবে সে কৃতকার্য হবে না।” অর্থাৎ তিনি শাহাদতের মাঝেই কৃতকার্যতাকে দেখেছেন। #

পার্সটুডে/এমএএইচ/২৩

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

 

ট্যাগ