গল্প ও প্রবাদের গল্প:
জীবনবৃক্ষের গল্প
প্রিয় পাঠক ও শ্রোতাবন্ধুরা! সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করি যে যেখানেই আছেন ভালো ও সুস্থ আছেন। আজ আমরা শুনবো প্রাচীন একটি গল্প। গল্পটি এরকম:
বেশ প্রাচীনকালে এক বাদশাহ ছিল। সে জীবনকে খুব উপভোগ করতো। মনে মনে চাইতো যতদিন সে পৃথিবীতে বেঁচে আছে ততদিন যেন সে বাদশাহ থাকে। কেউ যেন তার বাদশাহির আসনে বসতে না পারে। একদিন রাতের বেলা বাদশাহর আশপাশের পারিষদবর্গ তার চারপাশে ভীড় জমালো। সবাই বিভিন্ন ধরনের গালগল্প করছিল। সেই রাতে একজন জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি রাজার অতিথি ছিলেন।
আলোচনার ভেতর যখন ওই জ্ঞানী লোকের পালা এলো, তিনি বললেন: আমি এমন একটা গাছের কথা জানি যে গাছের ফল জীবনদায়ী। যে-ই ওই গাছের ফল খাবে সে অমরত্ব লাভ করবে। ওই গাছটি ভারতবর্ষে পাওয়া যায়। 'জীবনদায়ী' গাছ নামেই পরিচিত সেই গাছটি। এই গল্প শুনে বাদশাহ ভীষণ খুশি হয়ে গেল এবং সেই জ্ঞানী লোককে জিজ্ঞেস করলো: যে গাছের কথা বললে ওই গাছটার কি অন্য কোনো নাম আছে? জ্ঞানী ভদ্রলোক বললেন: আমার জানা নেই। শুধু এটুকুই জানি যে গাছটি ভারতবর্ষে পাওয়া যায় এবং ওই গাছের ফল জীবনদায়ী। ব্যস, এটুকুই।
বাদশাহ সিদ্ধান্ত নিলো যে করেই হোক ওই জীবনদায়ী বৃক্ষের ফল খেয়ে অমরত্ব লাভ করবে এবং বাদশাহী করবে। বাদশাহ তার নিকটজনদের মধ্য থেকে একজনকে নির্বাচন করলো। তাকে বললো: তাড়াতাড়ি ভারতবর্ষে যাত্রা করো। যতক্ষণ পর্যন্ত ওই ফল না পাচ্ছো, ফিরবে না। যদি ওই ফল আমার জন্য নিয়ে আসতে পারো তাহলে তোমাকে আমার প্রধানমন্ত্রী বানাবো। আর যদি খালি হাতে ফিরে আসো তাহলে তোমাকে জল্লাদের হাতে দেওয়া হবে। সুতরাং ফল সংগ্রহ করতে না পারলে ফিরে না আসাটাই তোমার জন্য ভালো হবে। তুমি যেখানেই থাকো না কেন তোমার পথ-খরচ আমি তোমার জন্য পাঠিয়ে দেবো। এখনই তোমার হাতে আমি বিপুল পরিমাণ অর্থ দিয়ে দিচ্ছি। ওই টাকা দিয়ে তুমি পুরো ভারতবর্ষ ঘুরে বেড়াবে আর জীবনদায়ী বৃক্ষ খুঁজে বের করে আমার জন্য নিয়ে আসবে। তাড়াতাড়ি করো, সময় বড়ো কম।
বাদশাহর দূত তার সফর শুরু করে দিলো। যেতে যেতে বেশ কিছুদিন পর সে ভারতবর্ষে গিয়ে পৌঁছে গেল। মাসখানেক ধরে সে খুঁজে বেড়ালো, মাস দু'য়েক খুঁজলো কিন্তু জীবনদায়ী বৃক্ষের কোনো খোঁজই পেলো না। ভারতবর্ষের প্রায় সকল এলাকাতেই ঘুরে ঘুরে খোঁজ করলো। প্রদেশ, শহর, গ্রাম থেকে শুরু করে পাড়ায় মহল্লায়, প্রতিটি ঘরে ঘরে খোঁজ করলো কিন্তু কোনো খোঁজ পেলো না। কেউ ওই জীবনদায়ী গাছের সন্ধান দিতে পারলো না। এতো বেশি খুঁজেছে সে, একেবারে মরুচারী থেকে বেদুইন পর্যন্ত, পথচারী থেকে পর্বতবাসী পর্যন্ত কাউকে আর জিজ্ঞেস করতে বাকি রাখে নি বাদশাহর দূত। এ কারণেই সবার কাছেই দূত পরিচিত হয়ে উঠলো। কদিন যেতে না যেতে মানুষ তাকে দেখলেই ঠাট্টা-মশকরা করতে শুরু করে দিলো।
বাদশাহর দূতকে উপহাস করে কেউ কেউ বলছিল: ওরে বেচারা পথিক! খামোখা ওই গাছের সন্ধানে ঘুরে কোনো লাভ হবে না। সারাজীবন ঘুরলেও ওই গাছের হদিস মিলবে না কারণ এ ধরনের জীবনদায়ী গাছের আদৌ কোনো অস্তিত্বই নেই। এরকম কোনো গাছ যদি সত্যিই থাকতো তাহলে প্রতিদিন কেন এতো মানুষ রোগ-ব্যাধিতে মারা যাচ্ছে? আবার কেউ কেউ বলছিল: ঘোরো ঘোরো! আরও ঘুরে বেড়াও! পেয়েও তো যেতে পারো! যে খুঁজে বেড়াবে, সে-ই তো পাবে, তাই না? এই বলে ভুলভাল একটা ঠিকানা দিয়ে দিতো তাকে। দূত বেচারা ঘুরে ঘুরে বেড়ালো। বাদশাহও তার রীতিমতো খোজখবর রাখতো এবং তার খরচাপাতি ঠিকঠাকমতো পাঠাচ্ছিলো। কিন্তু গাছ আর খুঁজে পেলো না দূত, সে ওই গাছের ব্যাপারে হতাশ হয়ে পড়লো।
অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলো নিজের শহরে ফিরে যাবে। ফেরার পথে শুনতে পেলো ভারতবর্ষের উত্তরাঞ্চলীয় একটি পার্বত্য এলাকায় এক বুজুর্গ শেইখ বা বড় আলেম বাস করেন। যথেষ্ট জ্ঞানী ওই আলেম নাকি মানুষের সকল প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দেন। সে কারণে জনগণ সমস্যায় পড়লে তাঁর কাছে গিয়ে ধর্না দেয়। এই খবর শুনে বাদশাহর দূত যেন আশার একটু আলো দেখতে পেলো। মনে মনে খুশি হলো সে। ওই বুজুর্গের ঠিকানা নিয়ে পার্বত্য অঞ্চলের দিকে রওনা হলো দূত এবং ঠিকঠাকমতো ওই বুজুর্গকে পেয়েও গেল। তাঁর কাছে বসলো এবং তার সমস্যার কথাটা দূত আলেমকে বললো: হে মহান শায়েখ! বোঝাই যাচ্ছে যে ওই বিজ্ঞ লোক বাদশাহর অতিথি হয়ে সেই রাতে যে গল্পটি বলেছিল, সেটি মিথ্যে ছিল। কিন্তু বাদশাহ গল্পটা বিশ্বাস করেছিল। শেখ হাসতে হাসতে বললো: না, হে ক্লান্ত মানুষ! ওই বিজ্ঞ লোক সত্যিই বলেছেন। এ ধরনের গাছ সত্যিই আছে। কিন্তু গাছটি পাওয়া সবার জন্য সহজ নয়। দূত জিজ্ঞেস করলো: এরকম গাছ তাহলে আছে? তাহলে আমি যে এতো তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়ালাম, পেলাম না কেন? ওই গাছটা আসলে কী গাছ, কোথায় পাওয়া যায়? শেখ হেসে হেসে বললো: হে যুবক! ওই গাছ হলো জ্ঞানবৃক্ষ। জ্ঞানবৃক্ষ অনেক উঁচু এবং বিস্তীর্ণ। জ্ঞানবৃক্ষের ফল জীবনদায়ী। তুমি যে ওই গাছটি খুঁজে পাও নি তার কারণ হলো তুমি শুধু বহিরাঙ্গ খুঁজে বেড়িয়েছো। অর্থ আর প্রকৃত হাকিকত সম্পর্কে গাফেল ছিলে।
জ্ঞানের সর্বনিম্ন প্রভাব হলো অমরত্ব লাভ। বাদশাহর দূত তার প্রশ্নের জবাব পেয়ে খুশিমনে ওই আলেমের কাছ থেকে বিদায় নিলো এবং যেখান থেকে সে এসেছে সেই পথে পা বাড়ালো।#
পার্সটুডে/এনএম/২৪/৭১
মূল ফার্সি গল্পের রূপান্তর: নাসির মাহমুদ