যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্কের উন্নয়ন
সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ও বঙ্গোপসাগরে বৃহৎ শক্তির বিপজ্জনক খেলা
-
• যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্কের উন্নয়ন
পার্সটুডে- বাংলাদেশের কৌশলগত দ্বীপ সেন্ট মার্টিনে সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের জন্য মার্কিন চাপ আবারও দক্ষিণ এশিয়ায় ওয়াশিংটনের ভূ-রাজনৈতিক পরিকল্পনার উপর সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে; এটি এমন এক অঞ্চল যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং ভারতের মধ্যে দ্বন্দ্বের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ার জনবহুল দেশ বাংলাদেশ, গত বছর কয়েক মাসের অস্থিরতা এবং ক্ষমতার পালাবদলের পর বিশ্বব্যাপী ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার একটি মূল কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি দিলেও, দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ উত্তেজনাপূর্ণ এবং বিদেশী হস্তক্ষেপের অভিযোগ রয়েছে। এই সংকটের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি নির্মাণের সম্ভাব্যতা নিয়ে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উত্থাপিত একটি অভিযোগ এখনও ঢাকার রাজনৈতিক এবং মিডিয়া জগতে ঘুরপাক খাচ্ছে। পার্সটুডে-র এই বিশ্লেষণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কসহ বাংলাদেশের কিছু স্পর্শকাতর বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা করা হবে।
"সেন্ট মার্টিন"; বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি ছোট দ্বীপ
মাত্র তিন বর্গকিলোমিটার আয়তনের সেন্ট মার্টিন দ্বীপটি উত্তর-পূর্ব বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত এবং এটি কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মালাক্কা প্রণালীতে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য রুটের কাছে এই দ্বীপের অবস্থান হওয়ার কারণে এটি সামরিক ও বাণিজ্যিক যান চলাচল পর্যবেক্ষণের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে দ্বীপটি যে নিয়ন্ত্রণ করবে সেই ভারত মহাসাগরে ক্ষমতার ভারসাম্য পরিবর্তন করতে পারবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য, এই অঞ্চলে এর উপস্থিতি "Free and Open Indo-Pacific " পরিকল্পনার কাঠামোর মধ্যে চীনকে নিয়ন্ত্রণ করার কৌশলের অংশ, যেখানে চীন ও ভারতও তাদের নিরাপত্তা জন্য এই অঞ্চলের ওপর প্রভাব বজায় রাখতে চায়।
সামরিক সুবিধা অর্জনের জন্য মার্কিন চাপের অভিযোগ
বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, এক বিবৃতিতে দাবি করেছেন যে তার শাসনকালে ওয়াশিংটন "সেন্ট মার্টিন" দ্বীপে একটি সামরিক ঘাঁটি নির্মাণের জন্য তাকে চাপ দিয়েছিল। তিনি বলেছেন যে তিনি যদি এই ছাড় গ্রহণ করতেন, তাহলে তিনি পশ্চিমাদের রাজনৈতিক সমর্থন বজায় রাখতে পারতেন। যদিও বর্তমান প্রশাসন এবং মার্কিন কর্মকর্তারা হাসিনার এই বিবৃতি অস্বীকার করেছেন এবং পশ্চিমা গণমাধ্যম এই সন্দেহকে আরও দৃঢ় করেছে যে ওয়াশিংটন তার স্বার্থ অনুসারে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা পুনর্গঠন করতে চাইছে।
বাংলাদেশের ঘটনাবলীর সাথে রঙিন বিপ্লবের মিল
আঞ্চলিক পর্যবেক্ষকদের মতে, বাংলাদেশের ঘটনাবলীর সাথে পশ্চিমা সমর্থিত রঙিন বিপ্লবের স্পষ্ট মিল রয়েছে। সরকারি চাকরির জন্য কোটা ব্যবস্থার দাবিকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া বিক্ষোভগুলো দ্রুত রাজনৈতিক ও সরকারবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করে। তরুণ ও ছাত্র সমাজের ভূমিকা, আন্দোলনে এনক্রিপ্টেড মেসেঞ্জারের ব্যবহার, আন্তর্জাতিক এনজিওগুলোর ব্যাপক কার্যকলাপ এবং সামাজিক নেটওয়ার্কগুলিতে সহিংসতার নানা ছবি প্রচার, এ সবকিছুই ইউক্রেন, জর্জিয়া এবং সার্বিয়াতেও পরিলক্ষিত কৌশলগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়। বিশ্লেষকরা বলছেন যে ওয়াশিংটন, এই ধরনের কৌশলের উপর নির্ভর করে, মার্কিন নীতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এমন স্বাধীন সরকারগুলোর উপর নরম চাপ প্রয়োগ করতে চায়।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে ওয়াশিংটনের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব মুহাম্মদ ইউনূস
গত বছর দেশব্যাপী বিক্ষোভ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং বাংলাদেশ থেকে তার পালায়ন ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তনের পর, অর্থনীতিবিদ এবং নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। যদিও তাকে একজন সংস্কারকামী ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচয় দেওয়া হয়, তবুও ক্লিনটন পরিবার এবং জর্জ সোরোসের সাথে সম্পর্কিত ফাউন্ডেশনসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক মহলের সাথে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তাকে বাংলাদেশের নেতৃত্বের জন্য ওয়াশিংটনের পছন্দের বলে মনে করা হয়। হাসিনার আমলে এমন খবরও প্রকাশিত হয়েছিল যে সরাসরি আমেরিকান চাপে ইউনূসের বিরুদ্ধে করা মামলাও স্থগিত করা হয়েছিল। এখন, ক্ষমতায় তার প্রত্যাবর্তনকে পর্যবেক্ষকরা এই অঞ্চলে পশ্চিমা স্বার্থকে কেন্দ্র করে "রাজনৈতিক ব্যবস্থার পুনর্নির্ধারণ" হিসাবে দেখছেন।
ভারতের উদ্বেগ এবং চীনের সুযোগসন্ধানীর ব্যাপারে আঞ্চলিক প্রতিক্রিয়া
আঞ্চলিক পর্যায়ে, বাংলাদেশের ঘটনাবলী দুই প্রতিবেশী শক্তি অর্থাৎ ভারত এবং চীনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। শেখ হাসিনার সরকারকে সবসময় সমর্থন করে আসা নয়াদিল্লি এখন তার পূর্ব সীমান্তে বৃহত্তর আমেরিকান প্রভাব বিস্তারের সম্ভাবনা নিয়ে উদ্বিগ্ন। অন্যদিকে, "বেল্ট অ্যান্ড রোড" উদ্যোগের মাধ্যমে বাংলাদেশের অবকাঠামো প্রকল্পগুলিতে ব্যাপক বিনিয়োগ করে চীন বাংলাদেশে তার উপস্থিতি শক্তিশালী করার এবং চীনকে নিয়ন্ত্রণ করার মার্কিন পরিকল্পনার বিরুদ্ধে লড়াই করার সুযোগ হিসেবে দেখছে বেইজিং।
ঢাকাকে কেন্দ্র করে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি দিলেও, বাংলাদেশ এখনও একটি ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন যে দেশটি এখন ওয়াশিংটন, বেইজিং এবং নয়াদিল্লির মধ্যে ত্রিমুখী প্রতিযোগিতার রণাঙ্গনে পরিণত হয়েছে। নতুন করে সামরিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করে বঙ্গোপসাগরে অবস্থান সুসংহত করার চেষ্টা করছে আমেরিকা; চীন তার বাণিজ্য রুট এবং অর্থনৈতিক প্রভাব বজায় রাখতে চাইছে; এবং অন্যদিকে ভারতও বাংলাদেশকে বিদেশী শক্তির প্রভাবমুক্ত রাখার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ শুধু যে তার অভ্যন্তরীণ ভাগ্য নির্ধারণ করবে তাই নয় একইসাথে সমগ্র ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণকেও প্রভাবিত করবে।#
পার্সটুডে/এমআরএইচ/১০
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।