গল্প ও প্রবাদের গল্প:
প্রবাদ: ঘোড়াই কেনে নি চাড়ি বানায়
প্রিয় পাঠক ও শ্রোতাবন্ধুরা! সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করি যে যেখানেই আছেন ভালো ও সুস্থ আছেন। আজ আমরা শুনবো প্রাচীন একটি প্রবাদের গল্প। প্রবাদটি হলো: ঘোড়াই কেনে নি চাড়ি বানায়। প্রবাদের পেছনের গল্পটি এরকম:
এক লোক ছিল একেবারেই দীনহীন, গরীব। তার না ছিল কোনো জায়গা-জমি অঅর না ছিল কোনো কাজকর্ম। এমন কোনো সম্পদই ছিল না যা দিয়ে সে তার খানাপিনার একটা ব্যবস্থা করতে পারে। একদিন লোকটা আনমনে বলছিল: আহা রে! যদি একটা ঘোড়া থাকতো তাহলে ঘোড়া দিয়ে মানুষের মাল সামানা টেনেও তো কিছু আয়-রোজগার করে জীবন চালানো যেত। লোকটা ঘোড়ার মালিক মানে তার একটা ঘোড়া আছে- এ কথা ভেবে মনে মনে কিছুটা খুশি হয়ে গেল। সোজা সে চলে গেল বাসায়। বৌকে ডেকে বললো: আমাদের বেলচা, কুড়াল কোথায় রেখেছো? বৌ ভাবলো স্বামী তার কয়েকদিন বেকার সময় কাটানোর পর নিশ্চয়ই কোনো কাজ খুঁজে পেয়েছে। ভীষণ খুশি হয়ে গেল এবং বললো: বেইজমেন্টে মানে মাটির নীচের তলায় রাখা আছে, যাও, নিয়ে নাও! লোকটি দ্রুত হনহন করে নীচে গেল। তার স্ত্রীর ধারণা ছিল স্বামী বেইজমেন্ট থেকে বেলচা, কুড়াল ইত্যাদি নিয়ে কাজে যাবে। কিন্তু না। লোকটি তা করলো না!
লোকটি বেলচা, কুড়াল ইত্যাদি নিয়ে বের হলো ঠিকই কিন্তু বাড়ির বাইরে গেল না। ঘরের দরোজার পাশেই কাজ নেমে পড়লো। কী কাজ? প্রথমেই লোকটি তার বাড়ির দেয়ালের একটা অংশ খুঁড়লো। তারপর শুরু করে দিলো ইট তৈরিসহ অন্যান্য কাজ। বৌ তার কাজকর্ম দেখে অবাক হয়ে গেল। ধীরে ধীরে কাছে গিয়ে বললো: এখানে কী করছো তুমি? দেয়াল ভেঙে নষ্ট করছো কেন? লোকটি বললো: আহ হা! চুপ করো তো! বলেছি না ঘোড়া কিনবো? ঘোড়া দিয়ে মানুষের মালামাল টানবো। ঘোড়াকে রাখবো কোথায়, খাওয়াবো কোথায়? চাড়ি বানাতে হবে না? আমি ঘোড়ার খাওয়ার পাত্র মানে চাড়ি বানাচ্ছি। এ কথা শুনে মহিলা ভীষণ বিরক্ত হলো। বললো: তুমি চাড়ি বানাচ্ছো? তাও আবার ঘরের দরোজায়? তোমার কি আকল-বুদ্ধি আর কোনোদিনই হবে না?
লোকটা জবাবে বললো: ঘরের দরোজার সামনে চাড়ি বানানোর মধ্যে সমস্যা কী? মহিলা বললো: তুমি কি আমাদের ছেলেপুলের কথা একবারও ভাবো নি? জানো না আর মাত্র দুই-তিন মাস পরে আমাদের ঘরে নবজাতকের আবির্ভাব হবে? আমাদের বাচ্চা যখন বড় হবে তখন সে স্কুলে যাবে! স্কুল থেকে দুপুরবেলা যখন বাসায় ফিরবে তখন সে এই দরোজা দিয়ে ঘরে ঢুকবে। সেই দরোজার পাশে একটা ঘোড়া বান্ধা থাকবে। আমি কিছুতেই সেটা করতে দেবো না তোমাকে। লোকটি বললো: কিন্তু সমস্যা কোথায়, আমার তো বুঝে আসে না। আমাদের বাচ্চা স্কুল থেকে ফিরবে, ঘোড়ার চাড়ির সামনে দিয়ে ঘরে ঢুকবে-তাতে সমস্যা কী?
মহিলা তার স্বামীর সঙ্গে কথোপকথনের ফাঁকে বলছিল: জানতাম তুমি চিন্তাভাবনা না করেই কাজ করতে বসেছো। আমাদের সন্তান যখন স্কুল থেকে বাসায় ফিরবে, ওই চাড়ির সামনে দিয়ে ঘরে ঢুকতে গেলে ঘোড়া লাত্থি দেবে। আমাদের সন্তান আহত হবে না? কে জানে হয়তো খোঁড়াও হয়ে যেতে পারে। লোকটি বললো: সেরকম হলে তুমিই দায়ী কারণ তুমি বাচ্চাকে গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছো। বাচ্চা কি লাত্থি খাওয়ার জন্য ঘোড়ার পেছনে যাবে? তার তো মাথা নীচু করে ঘরে গিয়ে পড়তে বসার কথা। স্ত্রী বললো: এখন সব দোষ আমার ঘাড়ে চাপাচ্ছো, তাই না? লাত্থি মারা ঘোড়া ঘরে নিয়ে এসে তুমি বোকামি করছো। স্বামী বললো: তুমি কি চাও মরাধরা একটা ঘোড়া কিনি? ওই ঘোড়া দিয়ে মাল টানবো কী করে? কী করে উপার্জন করবো?
কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে লোকটি চাড়ি বানাতে দেয়াল কাটতে শুরু করলো আর তার স্ত্রী তাকে বাধা দিতে গেল। স্বাভাবিকভাবেই চীৎকার চেঁচামেচি আরও জোরেশোরে শুরু হলো। প্রতিবেশিরা এগিয়ে এসে তাদের ঝগড়া থামানোর চেষ্টা করলো। প্রতিবেশিদের একজন বেলচা, কুঠার হাত থেকে নিয়ে গিয়ে বললো: কী হয়েছে? কেন বেলচা কুঠার হাতে নিয়েছো? লোকটি বললো: কিছুই না। আমি এখানে আমার ঘোড়ার জন্য একটা চাড়ি বানাতে চেয়েছি কিন্তু আমার স্ত্রী বানাতে দিচ্ছে না। মহিলা বললো: আমার চাড়ি বানাতে আপত্তি নেই। আপত্তি হলো ঘরে ঢোকার মুখে কেন বানাতে হবে? অন্য কোনো কোণে বানালেই তো হয়। ঘরের দরোজার মুখে চাড়ি বানালে আমার বাচ্চা স্কুল থেকে ফিরতে যদি ঘোড়ার লাথি খায়! ওর জন্য বিপজ্জনক না? মহিলা তার স্বামিকে সুন্দর করে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করলো। মহিলা বোঝাতে চাইলো তার সন্তান স্কুল থেকে ফিরলে ঘোড়ার লাত্থি খাওয়ার আশংকা আছে। সব কথা শুনে প্রতিবেশি এক লোক স্বামি-স্ত্রী দু'জনের দিকেই তাকালো। আস্তে করে জানতে চাইলো: ঠিক আছে তোমাদের কথা তো শুনলাম। তো তোমাদের ঘোড়া কোথায়? লোকটি বললো: ঘোড়া? ঘোড়া তো এখনও কেনা হয় নি। কিনবো। টাকা-পয়সা জোগাড় করছি। জোগাড় হয়ে গেলেই ঘোড়া কিনবো। একথা শুনে প্রতিবেশি ভদ্রলোক হাসতে হাসতে বললো:
এখনও তুমি ঘোড়াই কেনো নি অথচ ঘোড়ার জন্য চাড়ি বানাতে শুরু করে দিয়েছো? সেই চাড়ি বানানো নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া? এ কথা শুনে অন্যান্য প্রতিবেশিও হাসলো। হাসতে হাসতে কথা বলতে বলতে তারা যে যার ঘরে ফিরে গেল। এই ঘটনার পর থেকেই কেউ যখন কোনো কাজের প্রাথমিক প্রস্তুতি না নিয়েই তার ফলাফল বা পরিণতি নিয়ে ভাবে কিংবা তার পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া নিয়ে চিন্তাভাবনা করে, তখন এই প্রবাদটি উচ্চারণ করতে শুরু করে: ঘোড়াই কেনে নি চাড়ি বানায়।#
পার্সটুডে/এনএম/২৫/৭২
মূল ফার্সি গল্পের রূপান্তর: নাসির মাহমুদ