কুরআনের আলো
সূরা জুমা: ৬-১১ (পর্ব-২)
শ্রোতাবন্ধুরা, সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করছি আপনারা সবাই ভালো আছেন। আপনাদের হয়তো মনে আছে গত আসরে আমরা সূরা জুমার ৫ নম্বর পর্যন্ত আয়াত নিয়ে আলোচনা করেছি। আজ আমরা এই সূরার ৬ থেকে ১১ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের সংক্ষিপ্ত তাফসির শুনব। প্রথমেই এই সূরার ৬ থেকে ৮ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
قُلْ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ هَادُوا إِنْ زَعَمْتُمْ أَنَّكُمْ أَوْلِيَاءُ لِلَّهِ مِنْ دُونِ النَّاسِ فَتَمَنَّوُا الْمَوْتَ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ (6) وَلَا يَتَمَنَّوْنَهُ أَبَدًا بِمَا قَدَّمَتْ أَيْدِيهِمْ وَاللَّهُ عَلِيمٌ بِالظَّالِمِينَ (7) قُلْ إِنَّ الْمَوْتَ الَّذِي تَفِرُّونَ مِنْهُ فَإِنَّهُ مُلَاقِيكُمْ ثُمَّ تُرَدُّونَ إِلَى عَالِمِ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ فَيُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ (8)
“বলুন, হে ইয়াহুদীরা! যদি তোমরা মনে কর যে, তোমরাই আল্লাহর বন্ধু, অন্য লোকেরা নয়; তবে তোমরা মৃত্যু কামনা কর, যদি তোমরা সত্যবাদী হও [তাহলে আল্লাহ তায়ালা তাঁর বন্ধুদের জন্য যে প্রতিদান নির্ধারণ করেছেন তা তোমরা পেয়ে যাবে]।”
“কিন্তু তারা এর আগে যেসব কর্ম করেছে, সে কারণে তারা কখনও মৃত্যু কামনা করবে না। আর আল্লাহ যালিমদেরকে খুব ভাল করেই জানেন।”
“[হে নবী! আপনি] বলুন, তোমরা যে মৃত্যু হতে পলায়ন কর সে মৃত্যু তোমাদের সাথে অবশ্যই সাক্ষাৎ করবে। তারপর তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেয়া হবে অপ্রকাশ্য ও প্রকাশ্যের জ্ঞানী আল্লাহর কাছে, অতঃপর তোমরা যা আমল করতে সে সম্পর্কে তিনি তোমাদেরকে জানিয়ে দেবেন।”
গত আসরে আমরা সেই ইহুদিদের নিয়ে কথা বলেছিলাম যারা তাদের আসমানি গ্রন্থ অর্থাৎ তাওরাতের মর্মবাণী প্রত্যাখ্যান করে শুধুমাত্র এই গ্রন্থের প্রতি বাহ্যিক সম্মান প্রদর্শন করত। এরপর এই আয়াতগুলোতে বলা হচ্ছে: এরপরও তারা নিজেদেরকে আল্লাহর নির্বাচিত জাতি বলে ভাবত এবং মনে করতো তাদেরকে আল্লাহ কোনোরকম শাস্তি বা আজাব দেবেন না। এই তিন আয়াতের শুরুতে সেইসব ইহুদিকে লক্ষ্য করে বলা হচ্ছে: যদি তোমরা নিজেদের এই দাবির ব্যাপারে সত্যবাদী হয়ে থাকো তাহলে তোমরা পার্থিব জগতের মায়ায় এতটা আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছো কেনো এবং কেনো মৃত্যুকে ভয় পাচ্ছো?
যদি তোমরা আল্লাহর বন্ধু হয়ে থাকো তাহলে তো তোমাদের মৃত্যু কামনা করার কথা যাতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে আল্লাহর সাক্ষাৎ লাভ করতে পারো। সেক্ষেত্রে তোমরা আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ নেয়ামত লাভ করবে। হযরত আলী (আ.) এ সম্পর্কে বলেন: “মাতৃদুগ্ধের প্রতি একজন নবজাতকের যতটা আকর্ষণ থাকে মৃত্যুর প্রতি আমার আকর্ষণ তার চেয়ে বেশি।” কিন্তু অপরাধী ও পাপী ব্যক্তিরা কখনও মৃত্যু কামনা করে না। কারণ, তারা জানে যে, এই পৃথিবীতে তারা এত খারাপ কাজ করেছে যে, আল্লাহর কাছে গেলে চরম শাস্তি ছাড়া আর কিছু পাওয়া যাবে না। অবশ্য মৃত্যুর দিনক্ষণ মানুষের হাতে নেই এবং কাউকে আত্মহত্যা করারও অনুমতি দেওয়া হয়নি। মৃত্যুর প্রতি আকর্ষণের অর্থ হচ্ছে, গোনাহমুক্ত জীবনযাপন করে সার্বক্ষণিকভাবে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকা। কিয়ামতের কঠিন দিনে আল্লাহর সামনে দাঁড়ানোর কথাই সব সময় মনে রাখা উচিত।
এই তিন আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:
১- যারা নিজেদেরকে ধার্মিক ও খোদাপ্রেমী বলে দাবি করে তাদের ঈমান পরীক্ষা করার সর্বোত্তম উপায় মৃত্যুর জন্য তাদের প্রস্তুতি আছে কিনা তা দেখা।
২- যে বিষয়টি মানুষের ঈমান দুর্বল করে ফেলতে পারে তা হলো নিজেকে আল্লাহর প্রিয় বান্দা বলে মনে করা এবং সেটা অন্যদের সঙ্গে কথায়, কাজে ও আচরণে প্রমাণ করার চেষ্টা করা।
৩- মানুষ যখন গোনাহের কাজ করে ফেলে তখন সে মৃত্যুকে ভয় পায়। কিন্তু গোনাহমুক্ত জীবনযাপনকারী ব্যক্তিরা কখনও মৃত্যুর ভয়ে ভীত নন। তারা সব সময় মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকেন।
এবারে সূরা জুমার শেষ তিন আয়াত অর্থাৎ ৯, ১০ ও ১১ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا إِذَا نُودِيَ لِلصَّلَاةِ مِنْ يَوْمِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا إِلَى ذِكْرِ اللَّهِ وَذَرُوا الْبَيْعَ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ (9) فَإِذَا قُضِيَتِ الصَّلَاةُ فَانْتَشِرُوا فِي الْأَرْضِ وَابْتَغُوا مِنْ فَضْلِ اللَّهِ وَاذْكُرُوا اللَّهَ كَثِيرًا لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ (10) وَإِذَا رَأَوْا تِجَارَةً أَوْ لَهْوًا انْفَضُّوا إِلَيْهَا وَتَرَكُوكَ قَائِمًا قُلْ مَا عِنْدَ اللَّهِ خَيْرٌ مِنَ اللَّهْوِ وَمِنَ التِّجَارَةِ وَاللَّهُ خَيْرُ الرَّازِقِينَ (11)
“হে ঈমানদারগণ! জুমার দিনে যখন নামাজের জন্য ডাকা হয় তখন তোমরা আল্লাহ্র স্মরণে ধাবিত হও এবং কেনা-বেচা ত্যাগ কর, এটাই তোমাদের জন্য সর্বোত্তম, যদি তোমরা জানতে।”
“অতঃপর নামাজ শেষ হলে তোমরা জমিনে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান কর ও আল্লাহকে খুব বেশী স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও।”
“আর যখন [তাদের কেউ কেউ] ব্যবসা অথবা ক্রীড়া-কৌতুক দেখে তখন তারা [নামাজের কাতার থেকে] আপনাকে [খুতবা পাঠরত ও] দাঁড়ানো অবস্থায় রেখে সেদিকে ছুটে যায়। [তাদেরকে] বলুন, আল্লাহর কাছে যে [অনুগ্রহ ও বরকত] আছে তা খেল-তামাশা ও ব্যবসার চেয়ে উৎকৃষ্ট। আর আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ রিযিকদাতা।
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মাদানি জীবনে কোনো এক শুক্রবার তিনি যখন খুতবা দিচ্ছিলেন তখন একটি বাণিজ্যিক কাফেলা মদীনা শহরে প্রবেশ করে। তারা ঢোল-ঢক্কর পিটিয়ে নিজেদের উপস্থিতির জানান দেয়। এ সময় বেশিরভাগ মুসল্লি রাসূলুল্লাহ (সা.)কে খুতবারত অবস্থায় রেখে কাফেলার কাছ থেকে তাদের কাঙ্ক্ষিত জিনিসটি কেনার জন্য সেদিকে ছুটে যায়। এই তিন আয়াতে এই আচরণের জন্য ঈমানদারদের ভর্ৎসনা করার পাশাপাশি এই নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, ধার্মিকতার অন্যতম নিদর্শন এই যে, নামাজের সময় হলে পার্থিব সকল কাজ পরিত্যাগ করতে হবে। ঈমানদার ব্যক্তিরা যতই ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাকরি-বাকরির কাজে ব্যস্ত থাকুক না কেন নামাজের সময় হলে তারা সবকিছু ফেলে নামাজে ছুটে যান।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমাদের সমাজে ঈমানের দাবিদার এমন বহু মানুষ পাওয়া যাবে যারা পরকালের প্রস্তুতির চেয়ে পার্থিব জগতের কাজকর্মকে বেশি প্রাধান্য দেয়। অথচ পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে: নামাজকে দুনিয়াবি অন্যান্য কাজের চেয়ে অগ্রাধিকার দেওয়ার মধ্যেই তোমাদের দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ নিহিত রয়েছে।
এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:
১- জুমাসহ অন্যান্য নামাজ মসজিদে গিয়ে জামায়াতে আদায় করা হচ্ছে ঈমানদার ব্যক্তির অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
২- মানুষের জীবনে এমন কোনো জরুরি কাজ থাকা উচিত নয় যা তাকে জুমার নামাজে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখে। জুমার নামাজের কথা মাথায় রেখে শুক্রবারের অন্যান্য কাজ এমনভাবে সাজাতে হবে যাতে আগে আাগে মসজিদে পৌঁছে যাওয়া যায়।
৩- ইসলাম ধর্মে মানুষকে পার্থিব জীবনের কাজকর্ম বন্ধ রাখতে বলা হয়নি। বরং তাদেরকে জুমার নামাজ শেষ হওয়ার পর হালাল রুজি অনুসন্ধানের জন্য পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়তে বলা হয়েছে।
৪- পার্থিব জীবন ও পরকালের জন্য আল্লাহ তায়ালা যে বিধিবিধান জারি করেছেন তা যথাযথভাবে পালন করার মধ্যেই মানুষের পার্থিব ও পারলৌকিক কল্যাণ নিহিত রয়েছে।
তো শ্রোতাবন্ধুরা! এরইসঙ্গে শেষ করছি কুরআনের আলোর আজকের আয়োজন। যারা সঙ্গ দিলেন তাদের সবাইকে অনেক ধন্যবাদ।#
পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ বাবুল আখতার/৩
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।