অমর মনীষী আল ফারাবি-(পর্ব-১)
মুসলিম বিশ্বের গর্ব, সেরা দার্শনিক ও চিন্তাবিদ 'অমর মনীষী আল ফারাবি'র জীবন ইতিহাস এবং জ্ঞানবিজ্ঞানে তার নানা কর্মকাণ্ড ও অবদান নিয়ে আমাদের আলোচনা অনুষ্ঠানে আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। আজ শুনুন নতুন এ ধারাবাহিকের প্রথম পর্ব।
আবু নাসর মুহাম্মাদ ফারাবি প্রায় ২৫৭ হিজরির দিকে তথা ৮৭০ খ্রিস্টাব্দে জন্ম গ্রহণ করেন। তার জন্মস্থান নিয়ে কিছুটা মতভেদ রয়েছে। অনেকেই মনে করেন কাজাকিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলে আধুনিক আত্রাই শহরের কাছে ফারাব অঞ্চলে জন্ম নিয়েছিলেন ফারাবি। আবার কেউ কেউ মনে করেন তিনি প্রাচীন ইরানের বৃহত্তম খোরাসানের ফারিয়াব বা বারিয়াব অঞ্চলে জন্ম নিয়েছিলেন। এ অঞ্চল বর্তমানে আফগানিস্তানের অংশ। ইরানি ও অ-ইরানি নির্বিশেষে বেশিরভাগ গবেষক ও বিশ্লেষকের মতে ফারাবি ছিলেন ইরানি বাবা-মায়ের ইরানি সন্তান। ফারাবির বাবা ছিলেন ইরানের একজন সেনা।
প্রখ্যাত আরব ঐতিহাসিক ইবনে আবি উজাইবাহ তার ‘ইনসানুল উয়ুন' বা ‘মানব-চোখ বা মানব-দৃষ্টি' শীর্ষক বইয়ে ফারাবিকে ইরানি বংশধারার ব্যক্তি বলে উল্লেখ করেছেন। ইবনে নাদিম তার 'আলফিহরিস্ত' শীর্ষক বইয়ে এবং মনীষী আশশাহরুজিও ফারাবিকে ইরানি বলে উল্লেখ করেছেন। আশশাহরুজি খ্রিস্টিয় ১২৮৮ সালের দিকে জীবিত ছিলেন।
ফারাবি ছিলেন বিরল একজন মনীষী এবং তার সময়কাল ছিল অত্যন্ত স্পর্শকাতর। তাঁর পরবর্তী চিন্তাবিদদের চিন্তাধারায় তিনি গভীর প্রভাব রেখে যেতে সক্ষম হন। চিন্তাবিদদের ওপর ফারাবির প্রভাব এতোটাই বেশি ছিল যে বলা যায় তাঁর চিন্তাধারা দিয়ে তিনি ইসলামি সভ্যতা বিকাশের ক্ষেত্র বা পরিবেশ তৈরিতে অনেক বড় ভূমিকা রেখেছিলেন। ফারাবির চিন্তাধারার প্রধান বিষয়বস্তু ছিল ধর্ম ও দর্শনের মধ্যে সংযোগ স্থাপন। তিনি বিশ্বাস করতেন, ইসলাম ধর্ম এবং গ্রীক দর্শনের মধ্যে তেমন কোন পরস্পর বিরোধিতা নেই এবং সামান্য কিছু পার্থক্য যদি থেকেও থাকে তা একান্তই বাহ্যিক এবং সেটাকেও দার্শনিক ব্যাখ্যার মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব। ফারাবির উপাধি ছিল 'মোয়াল্লেম সানি' বা 'দ্বিতীয় শিক্ষক' যাকে ইসলামি দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে অভিহিত করা হয়। মুসলিম বিশ্বে গ্রিক যুক্তিবিদ্যার অনুপ্রবেশে তিনি ভূমিকা রাখেন। অনেক ইতিহাসবিদ ও লেখক তাকে সবচেয়ে বড় মুসলিম দার্শনিক হিসেবে অভিহিত করেছেন। 'দে ফু' এর মতো প্রাচ্যবীদরা ফারাবিকে ইবনে সিনার চাইতেও বড় মাপের দার্শনিক হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
এটা ঠিক যে ইসলামি চিন্তাধারার ইতিহাসে ইয়াকুব বিন ইসহাক কিন্দিকে ইসলামী যুগের প্রথম দার্শনিক বলা হয় এবং তিনিই দর্শনের রাজ্যে অন্যদের জন্য পথ খুলে দিয়েছিলেন, কিন্তু কিন্দি দর্শনের ক্ষেত্রে নিজস্ব কোনো ধারা সৃষ্টি করতে পারেননি। তিনি দর্শনের বিদ্যমান বিষয়গুলোর মধ্যে কেবল সংহতি বা সমন্বয় সাধন করেছিলেন। কিন্তু ফারাবি দর্শনের ক্ষেত্রে এক পরিপূর্ণ স্বতন্ত্র ধারা উপহার দিয়ে গেছেন। কিন্দি যে মহতী কাজ শুরু করেন ফারাবি তা আন্তরিক চিত্তে ও শক্তিমত্তা নিয়ে চালিয়ে যান। গ্রিসের দার্শনিক মতবাদ বা দার্শনিক চিন্তাধারা সম্পর্কিত তত্ত্বগুলো অনুদিত হয়েছিল আরবি ও সুরিয়ানি ভাষায়। কিন্তু দর্শন শাস্ত্র তখনও আরবি ভাষার সঙ্গে খুব একটা ঘনিষ্ঠ হতে পারেনি। দর্শন ও আরবি ভাষার মধ্যে একটা ব্যবধান বা দূরত্ব থেকেই যায়। ফারাবি আরবি ভাষাকে দর্শনের উপযোগী করে উপস্থাপন করতে সক্ষম হন। ফলে দর্শন ও আরবি ভাষা পরস্পরের আপন হয়ে যায়। ফারাবি অ্যারিস্টটলের রচনার ওপর মূল্যবান ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ লিখেছেন এবং তিনিই ছিলেন প্রথম শিক্ষক যিনি এ কাজ করেছেন। এ কারণে তাকে দ্বিতীয় শিক্ষকের উপাধি দেয়া হয়েছিল।
কৈশোর এবং যৌবনের প্রথম দিকে ফারাবি কোথায় এবং কার কাছে জ্ঞান শিক্ষা অর্জন করেছিলেন তা সঠিকভাবে জানা যায়নি। কিন্তু, তার পিতা ও দাদা ছিলেন সামানিয়ান শাসনামলের উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তা এবং নিঃসন্দেহে তারাই ফারাবির জ্ঞানশিক্ষা অর্জনে অনেক বড় ভূমিকা রেখেছিলেন। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন ফারাবি মার্ভ শহরের শিক্ষক হাজেকির কাছে বিজ্ঞান ও দর্শন শাস্ত্রের ওপর প্রাথমিক লেখাপড়া সম্পন্ন করেন। কারণ সে সময় মার্ভ ছিল ধর্ম ও দর্শনশাস্ত্রের পাঠ ও আলোচনার কেন্দ্র।
প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে ফারাবী স্বল্প সময়ের জন্য বিচারক হিসেবে কাজ করেন এরপর তিনি বাগদাদে যান। হিজরি ২৯৫ থেকে ৩২০ সাল পর্যন্ত তিনি বাগদাদে অবস্থান করেন যখন এটি ছিল ইসলামি খেলাফতের কেন্দ্র এবং মুসলিম পণ্ডিত ও চিন্তাবিদদের সমাবেশস্থল। বাগদাদে গিয়ে ফারাবি আরবি ভাষা, ইসলামি আইনশাস্ত্র ও ইসলামি দর্শন ভালোভাবে রপ্ত করেন। এ ছাড়া তিনি তখনকার প্রচলিত যুক্তিবিদ্যা ও দর্শনশাস্ত্র শেখার জন্য ইয়োহান ইবনে হাইলানের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন যিনি ছিলেন একজন খ্রিস্টান এবং তখনকার যুগের অন্যতম বিশিষ্ট দার্শনিকদের একজন।
কিছুকাল পর ফারাবি ইয়োহান ইবনে হাইলানের বিশেষ ছাত্রদের একজন হয়ে ওঠেন এবং তার কাছে সমস্ত যুক্তি ও দর্শন অধ্যয়ন করেন। এই খ্রিস্টান শিক্ষকের কাছেই ফারাবি এরিস্টটলের বেশিরভাগ চিন্তা-দর্শনের সাথে পরিচিত হন যার মধ্যে যুক্তিবিদ্যাও রয়েছে। এখানে পড়াশোনা শেষ করে তিনি তার শিক্ষকের পরামর্শে বর্তমান তুরস্কের হাররান ও কনস্টান্টিনোপলে যাত্রা করেন এবং সেখানে প্রায় আট বছর অবস্থান করেন। কনস্টান্টিনোপলে অবস্থানকালে তিনি সেখানে প্রাতিষ্ঠানিক মাধ্যম ছাড়াই গ্রিক বিজ্ঞান ও গণিতশাস্ত্রের ওপর পড়াশোনা করেন। তিনি গণিত থেকে প্যারানরমাল সায়েন্স বা অতি প্রাকৃতিক বিজ্ঞান পর্যন্ত বিজ্ঞানের সকল শাখায় জ্ঞানার্জন করেন।
তরুণ ফারাবি এরপর বাগদাদে ফিরে আসেন এবং প্রায় দুই দশক পর্যন্ত ইসলামি ভূখণ্ডের এই প্রাণকেন্দ্রে জীবন অতিবাহিত করেন। এই সময়কালে, ফারাবীর বৈজ্ঞানিক জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় শুরু হয় এবং তার বেশিরভাগ রচনা এই দুই দশকে রচিত হয়েছিল।
বাগদাদে আল-ফারাবি যদিও যুক্তিবিদ্যা ও দর্শনের অধ্যাপক ছিলেন, কিন্তু এই শহরের শিক্ষার ঐতিহ্য অনুসারে তিনি বাগদাদের সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক ইউনুস বিন মতির ক্লাসে অংশ নেন। কিন্তু বেশিদিন লাগেনি বাগদাদসহ সমগ্র মুসলিম বিশ্বে ফারাবির খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে এবং দর্শনশাস্ত্রসহ বিজ্ঞানের সকল শাখায় মুসলিম পণ্ডিত হিসেবে তিনি পরিচিতি পান। বাগদাদে প্রায় বিশ বছর ধরে শিক্ষকতার পাশাপাশি অধ্যয়ন করার পর, ফারাবি বাগদাদে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিষয়ে মতপার্থক্য ও বিরাজমান বিরূপ পরিবেশকে জ্ঞান-গবেষণার জন্য উপযোগী মনে করেননি। তাছাড়া, সম্ভবত ফারাবির রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি তৎকালীন বাগদাদ সরকারের নীতি ও আচরণের সাথেও সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। এসব কারণে রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা শুরুর আগেই তিনি দামেস্কের উদ্দেশ্যে সিরিয়া ত্যাগ করেন। কিন্তু দামেস্কে তার উপস্থিতি এবং ইখশিদী শাসকদের শাসনের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। এমনকি দুই বছর না যেতেই, সেখানকার শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিঘ্নিত হয় এবং দামেস্ক রাজনৈতিক সংঘাত ও বিদেশী আক্রমণের স্থলে পরিণত হয়। এরপর তিনি দামেস্কে সংঘাত শুরুর আগেই মিশরে চলে যান এবং সেখানে প্রায় ছয় বছর অবস্থান করেন।#
পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন