আগস্ট ১৯, ২০২৩ ১৪:১৫ Asia/Dhaka

শ্রোতা ভাইবোনেরা, গত কয়েকটি পর্বে আমরা সর্বকালের সেরা মহামানবী হযরত ফাতিমার ব্যক্তিত্ব ও মহতী কয়েকটি গুণ সম্পর্কে আলোকপাত করেছি। আজ আমরা স্বামীর সেবা ও সন্তান প্রতিপালনের ক্ষেত্রেও শ্রেষ্ঠ মহামানবী হিসেবে হযরত ফাতিমার ভূমিকার কয়েকটি দিক ও দৃষ্টান্ত তুলে ধরব।

 মহান আল্লাহ সুরা আররাহমানের ১৯ থেকে ২২ নম্বর আয়াতে দুটি সাগরের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, পাশাপাশি সত্ত্বেও ওই দুই সাগরের পানি পরস্পরের সঙ্গে মিশে যায় না এবং ওই দুই সাগর হতে আসে প্রবাল ও মুক্তা। মহানবীর (সা) আহলে বাইতের বর্ণনা অনুযায়ী ওই দুই সাগর বলতে হযরত ফাতিমা ও হযরত আলী এবং প্রবাল ও মুক্তা বলতে হযরত ইমাম হাসান ও হুসাইনকে বোঝানো হয়েছে।

হযরত আলী ও ফাতিমার ঘরে কোনো চাকচিক্য ছিল না। তাঁদের ঘর ছিল মহান আল্লাহর ইবাদাতের স্থান। মহান আল্লাহকে এখানে প্রতিনিয়ত স্মরণ করতেন তাঁরা। মহান আল্লাহর ইবাদাতের ঐশ্বর্যের বাইরে এ ঘর ছিল খুবই সাদামাটা তথা বাহ্যিক চাকচিক্যহীন ঘর। অল্প সম্পদে তুষ্ট হযরত ফাতিমা যদি ধন সম্পদের প্রতি আগ্রহী হতেন তাহলে তিনি সম্পদশালী ব্যক্তিদের বিয়ের প্রস্তাবেই রাজি হতেন!  কিন্তু মহানবী (সা) জানতেন তাঁর কন্যার অল্পে-তুষ্ট থাকার স্বভাব। তাই তিনি বিপুল মোহরানা দিতে আগ্রহী ওইসব ব্যক্তির বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।

হযরত ফাতিমার সাদামাটা জীবন-যাপন পদ্ধতি বিশ্বের সব মুসলমান নর-নারীর জন্য শ্রেষ্ঠ আদর্শ। হযরত ফাতিমা পরকালকে গুরুত্ব দিতেন বলেই দুনিয়ার সম্পদ ও চাকচিক্য ছিল তাঁর কাছে তুচ্ছ বিষয়। মানুষের ঈমান ও বুদ্ধিবৃত্তি যত বেশি প্রবল হয় ততই তাঁরা আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হন।  তাই তাদের বিয়ে হয় সামান্য মোহরানায় এবং ঘরের আসবাবপত্রও হয় খুব সাদামাটা। হযরত ফাতিমা ও আলীর বিয়েই এর সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত। তাঁদের ঘর ছিল বিলাসিতা ও বাহুল্য-বর্জিত। অল্পে তুষ্ট নারী হযরত ফাতিমার পক্ষেই সম্ভব হয়েছিল বিয়ের রাতে এ উৎসবের জন্য তৈরি নতুন পোশাক সাহায্য-প্রার্থীকে দিয়ে দেয়া!

স্বামী ও স্ত্রী হিসেবে হযরত ফাতিমা ও হযরত আলীর সম্পর্ক কেমন ছিল?  এ প্রসঙ্গে হযরত আলী (আ) বলেছেন, আমি কখনও এমন কাজ করিনি যাতে ফাতিমা ক্রুদ্ধ হন এবং ফাতিমাও কখনও এমন কাজ করেনি যাতে আমি রেগে যাই! আমি ঘরে এসে যখনই ফাতিমার দিকে তাকাতাম তখনই আমার সব দুঃখ-বেদনা দূর হয়ে যেত!হযরত ফাতিমা ঘরের কাজ যেমন খামির ও রুটি তৈরি করা, ঘর পরিচ্ছন্ন রাখা ইত্যাদি কাজের ব্যাপারে হযরত আলীর কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন আর হযরত আলী গৃহের বাহিরের কাজ যেমন কাঠ ও খাদ্য সংগ্রহের ব্যাপারে হযরত ফাতিমার কাছে ওয়াদাবদ্ধ ছিলেন। একদিন ইমাম আলী হযরত ফাতিমাকে জিজ্ঞেস করেন : “ঘরে কি খাবার আছে?” উত্তরে হযরত ফাতিমা বলেন : “যিনি তোমাকে মর্যাদা দিয়েছেন তাঁর শপথ,তিন দিন যাবৎ ঘরে কিছু নেই।” ইমাম বলেন : “কেন আমাকে একথা বল নি?” তখন হযরত ফাতিমা বলেন : আল্লাহর রাসূল (সা.) তোমার কাছে কিছু চাওয়ার ব্যাপারে আমাকে নিষেধ করেছেন এবং বলেছেন : “তুমি আলীর কাছে কিছু চেয়ো না। সে স্বেচ্ছায় কিছু আনলে নিও,নতুবা তাঁর কাছে কিছু চেয়ো না।

হযরত ফাতিমা তাঁর নবজাতকদের কানে আযান দিতে তাঁদের নিয়ে যেতেন মহানবীর (সা) কাছে

হযরত ফাতিমা কখনও স্বামীর কাছে এমন কিছু চাননি যা দেয়ার সাধ্য হযরত আলীর ছিল না। তিনি বলতেন, যা আমার স্বামী এনে দিতে সক্ষম নন সে রকম কিছু এনে দেয়ার দায়িত্ব তাঁর ওপর চাপিয়ে দিতে আমি মহান আল্লাহর কাছে লজ্জা অনুভব করি।

আলী ও ফাতিমা ছিলেন দুই পবিত্র ও নিষ্পাপ অস্তিত্ব। আর তাদের মিলনে জন্ম হয়েছে আরও দুই নিষ্পাপ ও পবিত্র অস্তিত্ব হযরত ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন। আলী ও ফাতিমা কখনও পরস্পরের ওপর জুলুম করেননি।  নবজাতক জন্ম নিলে যাতে তারা সুসন্তান হয় সেই লক্ষ্যে ইসলামী আদব-কায়দা বা প্রথা মেনে চলা জরুরি। ইসলামের এমনই এক প্রথা হল নবজাতকের কানে আযান দেয়া। হযরত ফাতিমা তাঁর নবজাতকদের নিয়ে যেতেন মহানবীর (সা) কাছে। তিনি তাঁদের ডান কানে আযান ও বাম কানে নামাজের একামতের বাক্যগুলো উচ্চারণ করতেন।

 সন্তান জন্ম গ্রহণের পর আকিকার অনুষ্ঠান করা একটি পছন্দনীয় প্রথা। এ উৎসবে সাধারণত ছাগল বা ভেড়া কুরবানি করা হয়।  হযরত ফাতিমার প্রত্যেক সন্তানের জন্মের পর ভেড়া কুরবানি দিয়ে আকিকার অনুষ্ঠান করা হয়েছিল। কুরবানি-কৃত ভেড়ার  গোশতের অংশ বিশেষ ধাত্রীর জন্য এবং বাকি গোশত্ প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনের কাছে পাঠানো হত। আর এতে সবাই খুশি হত। সন্তান জন্মের পর সপ্তম দিনে নবজাতকের চুল কামানো হত এবং চুলের সমান ওজনের রূপা দরিদ্র ও অভাবীদের দেয়া হত। নবজাতকের সুন্দর নাম রাখাও একটি জরুরি প্রথা। এটি বাবা মায়ের ওপর সন্তানের একটি বড় অধিকার।

সন্তানকে কুরআন শরিফ শিক্ষা দেয়া ও জরুরি শিক্ষা-দীক্ষাদানও বাবা মায়ের ওপর তাদের বড় অধিকার। হযরত ইমাম হাসানের জন্ম গ্রহণের পর হযরত ফাতিমা হযরত আলীকে সন্তানের নাম রাখতে বললে তিনি রাসুলকে দিয়ে তাঁর নাম নির্বাচন করতে আগ্রহী বলে জানান এবং নবজাতক ইমাম হাসানকে তাঁর নানার কাছে নিয়ে যান। মহানবীও (সা.) নাম জানতে চাইলে তিনি ওই একই আগ্রহের কথা জানান। এ অবস্থায় মহানবীও বলেন, তিনি এই সন্তানের নাম মহান আল্লাহর কাছ থেকে পেতে চান!এ অবস্থায় জিব্রাইল ফেরেশতা মহান আল্লাহর অভিনন্দন বাণী নিয়ে মহানবীর কাছে আসেন এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে জানান যে,  আলীর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক মুসার সঙ্গে হারুনের সম্পর্কের মতো বলে হারুনের সন্তানের নামের অনুরূপ নাম রাখার নির্দেশ দিয়েছেন মহান আল্লাহ। হিব্রু ভাষায় হারুনের সন্তানের নাম ছিল শুব্বার, আরবিতে এর প্রতিশব্দ হয় হাসান!

সন্তানের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে মায়ের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মায়ের আচার-আচরণ সন্তানের ব্যক্তিত্বের ওপর প্রভাব রাখে। হযরত ফাতিমা সন্তানদের ঈমান ও নৈতিকতা সম্পর্কিত ফরজ ও মুস্তাহাব বিষয়গুলো শেখাতেন। যেমন, শবে ক্বদরের রাতে তাঁর সন্তানরা যাতে ব্যাপক আগ্রহ ও উদ্দীপনা নিয়ে ইবাদতে মশগুল হতে পারেন এবং এই অসাধারণ মহিমান্বিত রাতের বরকত অর্জন করতে পারেন সেই লক্ষ্যে তিনি তাঁদেরকে দিনে ঘুম পাড়িয়ে দিতেন। তিনি তাঁর সন্তানদের রাত জেগে ইবাদত করানোর বিষয়ে এতটা অভ্যস্ত করেছিলেন যে হযরত জাইনাব (সা.আ.) পুরো রাত জেগে সকাল পর্যন্ত নামাজ পড়া ও কুরআন তিলাওয়াতসহ নানা ইবাদাতে মশগুল থাকতেন।#

পার্সটুডে/এমএএইচ/১৯

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ