আগস্ট ২০, ২০২৩ ১৪:২৩ Asia/Dhaka

গত কয়েক পর্বের আলোচনায় আমরা শ্রেষ্ঠ তথা আদর্শ নারী হিসেবে হযরত ফাতিমার মহতী নানা গুণ নিয়ে কথা বলেছি। আজও তাঁর জীবনের আরও কটি গুণ বা দিক নিয়ে আমরা কথা বলব।

হযরত ফাতিমা ছিলেন হিজাব বা শালীনতার বিধান মেনে চলার ক্ষেত্রে সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত। একদিন এক অন্ধ ব্যক্তি ফাতিমার ঘরে প্রবেশের জন্যে অনুমতি চাইলে তিনি ঐ অন্ধ ব্যক্তি থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখলেন । রাসূল (সা.) বললেন : হে ফাতিমা! কেন তুমি এই ব্যক্তি থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখছ,সে তো অন্ধ! তোমাকে দেখছে না।? উত্তরে ফাতিমা বলেন : যদিও ঐ অন্ধ লোক আমাকে দেখছেন না কিন্তু আমি তো তাকে দেখছি। এ অন্ধ ব্যক্তির নাসিকা গ্রন্থি তো কাজ করছে। তিনি তো ঘ্রাণ নিতে পারেন। এ কথা শুনে রাসূল (সা.) খুশি হয়ে বলেন : আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে,তুমি আমার দেহের অংশ। হযরত ফাতিমা (আ.)-কে প্রশ্ন করা হয়,“একজন নারীর জন্য সর্বোত্তম জিনিস কোনটি?” তিনি এর উত্তরে বলেন : “নারীদের জন্যে সর্বোত্তম জিনিস হল তারা যেন কোন পর-পুরুষকে না দেখে আর পর-পুরুষরাও যেন তাদেরকে দেখতে না পায়।

মদিনার ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধান মহানবীর (সা) কন্যা হওয়া সত্ত্বেও হযরত ফাতিমা অনাড়ম্বর ও দরিদ্র মানুষের জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। সংসারের কাজের ক্ষেত্রে স্বামী আলী (আ.) পানি ও কাঠ জোগাড় করে আনতেন আর হযরত ফাতিমা (আ.) আটা তৈরি করে খামির বানাতেন আর তা দিয়ে রুটি তৈরি করতেন। তিনি কাপড়ে তালি লাগানোর কাজও করতেন।হযরত ফাতিমা (সা. আলাইহা) ছিলেন বাবার মতই খোদাভীরু ও মানব-দরদি! যখন, পবিত্র কুরআনের এক বিশেষ বাণী যার অর্থ 'যারা শয়তানের অনুসারী তথা বিভ্রান্ত মানুষ তাদের সবার নির্ধারিত স্থান হচ্ছে জাহান্নাম। এর সাতটি দরজা আছে। পাপের প্রকৃতি ও মাত্রার আলোকে প্রত্যেক দরজার জন্যে এক একটি পৃথক দল আছে।'-কুরআনের ১৫ তম সুরা তথা সুরা হিজর্‌-এর( ৪৩-৪৪) এ আয়াত যখন নাজিল হয় তখন আল্লাহর রাসূল (সা.) উচ্চস্বরে কাঁদছিলেন। ফলে তাঁর সাহাবীরাও কাঁদছিলেন। কিন্তু তারা জানতেন না যে হযরত জিবরাঈল (আ.) রাসূল (সা.) উপর কোন্ বাণী নাজিল করেছেন। মহানবীর (সা.) ওই অবস্থা দেখে তাঁকে কেউ এ বিষয়ে প্রশ্ন করার সাহস পায় নি।

মহানবী (সা) যখনই হযরত ফাতিমাকে দেখতেন তখনই আনন্দিত হতেন। তাই হযরত সালমান ফারসি মহানবীর কান্নারত অবস্থার সংবাদ হযরত ফাতিমাকে দিতে তাঁর ঘরে পৌঁছে দেখেন যে হযরত ফাতিমা যাঁতায় আটা তৈরি করছেন,আর পাঠ করছিলেন কুরআনের এক বিশেষ আয়াত যার অর্থ   (وَ مَا عِنْدَ اللهِ خَيْرٌ وَ أَبْقَى) আল্লাহর কাছে যা আছে তা-ই কল্যাণকর এবং তা-ই অবশিষ্ট থাকবে।- তাঁর পরনে একটি পশমি আবা,যার বারো জায়গায় খেজুরের আঁশ দিয়ে তালি লাগানো ছিল। হযরত সালমান ফারসি নবী-নন্দিনীর কাছে নবীজির কান্নার ঘটনা খুলে বললেন। হযরত ফাতিমা উঠে দাঁড়ালেন এবং সেই তালি দেয়া আবা পড়েই বাবার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলেন। এ সময় হযরত সালমান ফারসি নবী-কন্যার পরনের জীর্ণ-পুরনো কাপড় দেখে ভীষণ কষ্ট পেয়ে বলেন : হায়! রোমান ও পারস্য সম্রাটদের কন্যারা রেশমি কাপড় পরিধান করে আর মুহাম্মাদের (সা.) কন্যার পরনে রয়েছে পশমি আবা, যার বারো স্থান তালিযুক্ত!

...মুহাম্মাদের (সা.) কন্যার পরনে রয়েছে পশমি আবা, যার বারো স্থান তালিযুক্ত!

হযরত ফাতিমা (আ.) বাবার কাছে পৌঁছে সালাম দিয়ে বললেন : “হে পিতা! সালমান আমার পোশাক দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছে। সেই আল্লাহর শপথ! যিনি আপনাকে নবুওয়াত প্রদান করেছেন,পাঁচ বছর ধরে এই একটি দুম্বার চামড়া ছাড়া আমাদের অন্য কিছু নেই-যার ওপর দিনের বেলা উটের খাবার রাখি আর রাত্রিতে এটাই আমাদের বিছানা। আমাদের বালিশ হচ্ছে এমন চামড়ার যার ভেতরটা খেজুরের আঁশ দিয়ে ভর্তি। মহানবী (সা.) বলেন : হে সালমান! আমার মেয়ে আল্লাহর পথে অগ্রগামী। হযরত ফাতিমা পিতাকে প্রশ্ন করেন : “বাবা আপনার জন্যে আমার জীবন কুরবান হোক! বলুন, কি কারণে আপনি কাঁদছিলেন?” তখন রাসূল (সা.) হযরত জিবরাঈলের মাধ্যমে আনা ওই আয়াতে কারিম পাঠ করেন। হযরত ফাতিমা তা শুনে এমনভাবে কাঁদেন যে মাটিতে পড়ে যান। তখন থেকে অনবরত তিনি বলতেন : হায়! হায়! যার জন্যে জাহান্নামের আগুন  নির্ধারিত হবে তার অবস্থা কেমন হবে! মহানবী (সা) ও হযরত ফাতিমা ছিলেন এমনই খোদাভীরু ও মানব-দরদি!

পশ্চিমা সমাজ-ব্যবস্থা ও কথিত নারীবাদ নারী ও পরিবার-ব্যবস্থার ব্যাপক ক্ষতি করেছে এবং এখনও ধ্বংসাত্মক ক্ষতির ওই প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে। নারীদের চিন্তা-চেতনা ও ভূমিকায় বিষাক্ত প্রভাব রাখছে জড়বাদী বা বস্তুবাদী এই মতবাদ।মানুষের প্রথম শিক্ষক হলেন মা। সন্তান সাত বছর পর্যন্ত বেশিরভাগ সময় মায়ের কাছে থাকে বলে তার শিক্ষার প্রাথমিক ভিত্তি ও ব্যক্তিত্ব মায়ের শিক্ষা আর প্রশিক্ষণ-কেন্দ্রিক হয়ে ওঠে।  নারীর বিভিন্ন ভূমিকার মধ্যে সন্তানকে সুশিক্ষিত করার ক্ষেত্রে মায়ের এই ভূমিকাকে তার অন্য সব ভূমিকার চেয়ে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয় ইসলাম। মায়ের কথাবার্তা ও আচরণ সন্তানের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। মা যত বেশি ধার্মিক ও সুশিক্ষিত হবেন তিনি সমাজকেও তত বেশি খোদাভীরু ও সুনাগরিক উপহার দিতে সক্ষম হবেন। মা সন্তানের শিক্ষক। তাঁর পেশা ও নবী-রাসুলদের মিশনের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। মা যদি ভালো না হন শিক্ষা ও নৈতিকতার দিক থেকে তার সন্তানও হবে অসৎ বা মন্দ নাগরিক।

'অনৈক্য বা বিভক্তি ডেকে আনে আমাদের পতন' (Divided We Fall)শীর্ষক বইয়ের লেখক (Bryce Christensen)  ব্রাইসি ক্রিস্টেনসেন-এর মতে পাশ্চাত্যে মায়ের ঐতিহ্যবাহী ভূমিকা পরিত্যক্ত হওয়ার বিষয়টি সামরিক হামলার মতই বিপজ্জনক। মায়েরা যদি সন্তানদের নীতি নৈতিকতা না শেখান তাহলে সন্তানদেরকে দেশপ্রেম বা দেশের প্রতিরক্ষার গুরুত্ব কে শেখাবে? ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আর ভালো সেনা বলে কিছু থাকবে না এবং এর ফলে সামরিক হামলার পথগুলো খুলে যাবে!কথিত মার্কিন ভেলভেট বা মখমল বিপ্লবের নীল-নকশার অন্যতম প্রধান হোতা মাইকেল আর্থার লিডিন মনে করেন ইরানের ইসলামী বিপ্লবের গণ-ভিত্তি ধ্বংস করতে জনগণের ওপরই আঘাত হানতে হবে যাতে ভেতর থেকেই এ বিপ্লব দুর্বল হয়ে যায়।  তার মতে নারী সমাজকে ব্যবহার করে সরকারকে উৎখাত ও সমাজকে ধ্বংস করা সবচেয়ে সহজ। কোনো একটি সমাজকে সহজেই ধ্বংস করার জন্য দরকার হল সেখানকার নারীদের বিয়ে করা থেকে দূরে রাখা অথবা বিয়ে করলেও যাতে খুব দ্রুত তারা তালাক নেয় সেই ব্যবস্থা বা পরিবেশ সৃষ্টি করা!

পাশ্চাত্যের নয়া উপনিবেশবাদী ব্যবস্থা পরিবারগুলোকে ধ্বংস করতে নারীবাদী ধারণা ছড়াচ্ছে যাতে সমাজগুলো থেকে নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধগুলো বিদায় নেয়। কথিত ব্যক্তি-স্বাধীনতা কথিত মানবতাবাদ ও ধর্ম-নিরপেক্ষ মতবাদের অন্যতম ফসল। ব্যক্তি স্বাধীনতার নামে খুলে দেয়া হচ্ছে অবাধ গর্ভপাত, বিকৃত যৌনতা বা ব্যভিচারের পথ। পশ্চিমা নারীবাদ স্বামী-সেবা ও সন্তান প্রতিপালনকে অমর্যাদাপূর্ণ বলে তুলে ধরে। এভাবে নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করার নামে নারীকে ভোগ-বিলাস ও অর্থনৈতিক শোষণের সহজ হাতিয়ারে পরিণত করেছে পশ্চিমা সমাজ ব্যবস্থা। শিল্পায়নের যুগে পশ্চিমা সমাজ ব্যবস্থা থেকে বিদায় নিতে থাকে গৃহকর্তী হিসেবে মমতাময়ী মায়েদের ভূমিকা। #

পার্সটুডে/এমএএইচ/২০

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

 

ট্যাগ