অমর মনীষী আল ফারাবি-(পর্ব-৪)
আজকের অনুষ্ঠানে আমরা ইরান ও মুসলিম বিশ্বের অমর মনীষী আল ফারাবির যুগের সাংস্কৃতিক ও জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষার পরিস্থিতির ওপর পর্যালোচনা করবো।
ফারাবি "দ্বিতীয় শিক্ষক" নামে পরিচিত। তিনি এমন একটি সময়ে বাস করেছিলেন যখন মুসলিম শাসকরা ২০০ বছর পার করেছেন এবং তখন মুসলিম ভূখণ্ডে বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানের বিকাশ ঘটছিল এবং মুসলিম বিশ্ব ও খ্রিস্টান বিশ্বের মধ্যে বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান সবেমাত্র শুরু হয়েছিল। মুসলিম পণ্ডিতরা আনুমানিক ১২৫ হিজরি থেকে অর্থাৎ আব্বাসিয় শাসক হারুন আল-রশিদ এবং মামুন আল রশিদের সময় থেকে গ্রীক জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার গ্রন্থ আরবি ভাষায় অনুবাদ করতে শুরু করেন। এই প্রথম মুসলমানরা খ্রিস্টান ও অন্যান্য অমুসলিম সভ্যতার বুদ্ধিবৃত্তিক ও ধর্মতাত্ত্বিক বিজ্ঞান ও চিন্তাচেতনার সাথে পরিচয় লাভ করে। মুসলিম ও খ্রিস্টান ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে মতবিনিময়ের পাশাপাশি বহু গ্রন্থ আরবি ভাষায় অনুবাদ হওয়ার কারণে মুসলিম চিন্তাবিদরা অন্য সভ্যতার জ্ঞানবিজ্ঞান জানার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে।
ঠিক এমনই এক সময়ে বিরল মুসলিম মনীষী আল-ফারাবির আবির্ভাব ঘটে। তিনি পূর্ববর্তী সভ্যতাগুলোর রেখে যাওয়া বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্যকে সঠিকভাবে ইসলামি বিশ্বে স্থানান্তর করতে সক্ষম হননি, তবে তিনি তাদের জ্ঞানগত সমৃদ্ধি ও বিকাশের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছিলেন। ফারাবি মুসলিম ও অমুসলিম সভ্যতার মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তাধারার একটি গভীর সংযোগ তৈরি করেছিলেন। সেই সময় অমুসলিম সভ্যতার বুদ্ধিবৃত্তিক বিজ্ঞানের প্রাচীন ঐতিহ্য এবং মুসলিম পণ্ডিতদের অর্জনের মধ্যে একটি নির্ভরযোগ্য সেতুবন্ধনের প্রয়োজনীয়তা প্রবলভাবে অনুভূত হয়েছিল। এটি এমন এক সময় ছিল যখন প্রাচীন গ্রীক জ্ঞান-বিজ্ঞানগুলোও অনেকটা হারিয়ে যেতে বসেছিল এবং এগুলো ভালোভাবে শেখাতে পারে এমন একজন নির্ভরযোগ্য শিক্ষক খুঁজে পাওয়া তখন কঠিন ছিল। খ্রিস্টান রাজাদের মধ্যে কেউ খ্রিস্টান পাদ্রি বা ধর্মগুরুর কাছে পরামর্শ করে বিজ্ঞান বা নতুন কোনো বিষয়ে চিন্তা-গবেষণার কোন্ বিষয়টি খ্রিস্টান ধর্মের জন্য ক্ষতিকর নয় তা নিশ্চিত হতো। এরপর তারা ওই বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ করতো। আর যে বিষয়টি ধর্মের জন্য ক্ষতিকর মনে হতো সেটার চর্চা থেকে বিরত থাকতো। এরই ভিত্তিতে সে সময় যুক্তিবিদ্যার কিছু বিষয় না শেখার পক্ষে মত দেয়া হতো।
ইসলাম আবির্ভাবের আগ পর্যন্ত শিক্ষা ও জ্ঞানগবেষণা সংক্রান্ত আলোচনা এভাবেই চলতো। তখন শিক্ষা পদ্ধতি মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া থেকে তুরস্কের আন্তাকিয়ায় স্থানান্তরিত হয়েছিল এবং দীর্ঘকাল এ রীতি চালু ছিল। অবশেষে একজন মাত্র বিজ্ঞান শিক্ষক অবশিষ্ট ছিলেন। দু'জন ব্যক্তি তার কাছে যায় বিজ্ঞানসহ অন্য বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণের জন্য এবং সেখান থেকে চলে যাওয়ার সময় তারা কিছু বই সঙ্গে করে নিয়ে যায়। ওই দুই জনের একজন ছিলেন হাররান অঞ্চলের অধিবাসী এবং অপরজন ছিলেন ইরানের মার্ভ অঞ্চলের অধিবাসী। মার্ভ অঞ্চলের এই ব্যক্তি দুজন ছাত্র গড়ে তুলেছিলেন। তাদের একজন ছিলেন ইব্রাহিম মারওয়াজি এবং অপরজন ছিলেন ইয়োহান্না বিন হাইলান। এই ইয়োহান্না হচ্ছেন আল-ফারাবি যিনি মার্ভ এর শিক্ষকের কাছে যুক্তিবিদ্যা ও দর্শনশাস্ত্র শিক্ষা গ্রহণ করেন। এরপর তিনি আরবি ভাষায় সাবলীলভাবে যুক্তিবিদ্যা ও দর্শনশাস্ত্র তুলে ধরেন। তিনি যে কেবল শিক্ষা প্রসারে যোগাযোগের এই মাধ্যম ভালভাবে তৈরি করেছিলেন তাই নয় একইসাথে বিভিন্ন বিষয়ে অ্যারিস্টটলের বইগুলোর ব্যাখ্যা তুলে ধরে তিনি অ্যারিস্টটলের লেখাগুলো পুনরুজ্জীবিত করেছেন এবং প্রাচীন গ্রীক বিজ্ঞানে গতিশীলতা ফিরিয়ে আনেন।
ইসলামি সভ্যতার সাধারণ বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের যদিও নিজস্ব স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ছিল তবে তা ইরানী, গ্রীক ও সুরিয়ানি প্রভাব থেকে মুক্ত থাকেনি। বাগদাদে দারুল হিকমা শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত মুসলিম ভূখণ্ডগুলোতে যে জ্ঞানশিক্ষা কেন্দ্রগুলো বিদ্যমান ছিল সেগুলো পরস্পরের সহযোগিতায় শিক্ষা বিস্তারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। আর এইসব শিক্ষাকেন্দ্রের সাথে ফারাবির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং পরিচিতি ছিল। ইয়োহান্না বিন হাইলান অর্থাৎ ফারাবি, মাতি বিন ইউনুস এবং ইব্রাহিম মারওয়াজি এই কেন্দ্রগুলো থেকে বাগদাদে জ্ঞান স্থানান্তরের ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। এই দুজনই ফারাবীর শিক্ষক ছিলেন।
এবারে তৎকালীন সময়ে জ্ঞানশিক্ষা অর্জনে এই গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাকেন্দ্রগুলোর দিকে একটু নজর দেয়া যাক, তাহলে ওই কেন্দ্রগুলোর গুরুত্ব উপলব্ধি করা যাবে। বলা যায়, মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ার শিক্ষাকেন্দ্র ছিল সেসময়কার খুবই গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যা ওই যুগে কিংবা পরবর্তী দীর্ঘ সময় পর্যন্ত আশেপাশের অন্যান্য শিক্ষাকেন্দ্রেও জ্ঞানবিজ্ঞান স্থানান্তরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। আলেকজান্দ্রিয়ার শিক্ষাকেন্দ্রটি সম্ভবত মিশরের শাসক প্রথম বিতলামিউসের সময়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং এরপর এটি ওমর বিন আবদুল আজিজের সময় ১০০ হিজরি পর্যন্ত অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে শিক্ষাকার্যক্রম অব্যাহত রেখেছিল। এই শিক্ষাকেন্দ্রটি গ্রিক সভ্যতার প্রথম উত্তরাধিকারী এবং পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক চিন্তাধারার মিলনকেন্দ্র হিসেবে মুসলিম সমাজে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছিল। ইউক্লিড এবং আর্কিমিডিস বা টলেমি, বিখ্যাত চিকিৎসক হেরোফিলোস এমনকি গ্যালেনের মতো পণ্ডিতরাও কোনো না কোনোভাবে আলেকজান্দ্রিয়ার জ্ঞানবিজ্ঞান শিক্ষাকেন্দ্র দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন কিংবা সেখান থেকে তারা শিক্ষা নিয়ে বের হয়েছিলেন।
মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া শিক্ষাকেন্দ্রে দর্শন ও হিকমত বা প্রজ্ঞাশাস্ত্রে অনেক স্বনামধন্য ব্যক্তির নাম শোনা যায়। এদের মধ্যে নব্য-প্ল্যাটোনিক দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা অ্যামোনিয়াস সাকাস এবং তার অসংখ্য ছাত্রের কথা উল্লেখ করা যায়। দার্শনিকদের এই দলটি যারা মিশরীয় নব্য-প্ল্যাটোনিস্ট নামে পরিচিত তারা গ্রীক দর্শন বিশেষ করে প্লেটোর দর্শন ইসলামি ও খ্রিস্টান বিশ্বে স্থানান্তরিত করার ক্ষেত্রে বিরাট অবদান রেখেছিলেন।
উল্লেখ্য, মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ার জ্ঞানশিক্ষা কেন্দ্রটি হিজরি প্রথম শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত সক্রিয় থাকলেও ইসলামী বিশ্বে এর প্রভাব অব্যাহত ছিল। আলেকজান্দ্রিয়ার বিখ্যাত লাইব্রেরি যা দু'একবার পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল তা ছিল ইসলামী বিশ্বে জ্ঞান স্থানান্তরের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস।
আলেকজান্দ্রিয়া শিক্ষাকেন্দ্রের পর তুরস্কের ঐতিহ্যবাহী নগরি আন্তাকিয়ার বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও শিক্ষাকেন্দ্রের কথা উল্লেখ করা যায়। কারণ আলেকজান্দ্রিয়ার পতনের সাথে সাথে বৈজ্ঞানিক গবেষণাকর্ম ও শিক্ষা ১০০ হিজরির দিকে আন্তাকিয়ার শিক্ষাকেন্দ্রে স্থানান্তর করা হয়েছিল। এই শিক্ষাকেন্দ্রটি আব্বাসিয় শাসক মোতাওয়াক্কিলের খেলাফত পর্যন্ত সক্রিয় ছিল। এই কেন্দ্রটি আবু ইসহাক ইব্রাহিম কাভিরি, আবু বাশার মতি বিন ইউনুস ও ইব্রাহিম মারোজির মতো শিক্ষকদের দ্বারা উপকৃত হয়েছিল। এই কারণে ফারাবী এই শিক্ষাকেন্দ্র দ্বারা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছিলেন বলে মনে করা হয়। কারণ আবু বাশার মতি বিন ইউনুস ছিলেন ফারাবির শিক্ষক। #
পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন