সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২৩ ১৪:২৭ Asia/Dhaka
  • ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস (১৪৬): যুদ্ধের ময়দানে ইরানি যোদ্ধাদের আল্লাহর স্মরণ

পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ইরানি যোদ্ধারা আল্লাহর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক স্থাপন করতে পেরেছিলেন। মহান আল্লাহ অশুভ শক্তি ও ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মুমিন যোদ্ধাদেরকে সহযোগিতা করার অলঙ্ঘনীয় প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনের বাণী অনুযায়ী, যখনই মুমিন ব্যক্তিরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে জিহাদ করবে তখন মহান আল্লাহ তাদেরকে সহযোগিতা করবেন।

মানব সৃষ্টির শুরু থেকে আল্লাহ তায়ালা যুগে যুগে তাঁর মুমিন বান্দাদের এই সহযোগিতা করে এসেছেন। আট বছরব্যাপী পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে ইরানি যোদ্ধারা এই বিশ্বাস অন্তরে পোষণ করেছেন যে, তারা যেহেতু আল্লাহর দ্বীনকে সাহায্য করছেন এবং নিজের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষার জন্য জিহাদ করছেন তখন তারা আল্লাহ তায়ালার সাহায্য পাবেনই।

এই বিশ্বাস অন্তরে জাগরুক থাকার কারণে ইরানি যোদ্ধাদের অন্তর থেকে ইরাকি বাহিনীর পৃষ্ঠপোষক পরাশক্তিগুলোর ভয় মন থেকে দূর হয়ে গিয়েছিল।  সেইসঙ্গে তারা অর্জন করেছিলেন অসীম সাহস ও আত্মিক শক্তি। আল্লাহ তায়ালা সূরা ফুসসিলাতের ৩০ নম্বর আয়াতে বলেছেন: “নিঃসন্দেহে যারা বলে- আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ, অতঃপর (সে কথার উপর) অবিচল থাকে, ফেরেশতারা তাদের নিকট অবতীর্ণ হয় (আর বলে), তোমরা ভয় করো না, চিন্তা করো না, আর তোমাদেরকে যে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে তার সুসংবাদ গ্রহণ করো। ” ১৯৮১ সালে পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধের দ্বিতীয় বছরে ইরানি যোদ্ধারা ফাতহুল মোবিন অভিযানে ইরাকি বাহিনীর কবল থেকে বাস্তান এলাকা পুনরুদ্ধার করেন। এ সময় ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা হযরত ইমাম খোমেনী (রহ.)  বলেন: 

“আল্লাহ তাবারাক ও তায়ালা বলেছেন, যে আমাকে সাহায্য করে আমিও তাকে সাহায্য করব। তিনি জানেন যে, আমরা তাঁর দ্বীনকে সাহায্য করতে এবং পৃথিবীর বুকে তাঁর বিধান প্রতিষ্ঠান করতে চাই।  ইরানি জনগণ শুরু থেকেই এই একটি বিষয়ের ওপর অটল ছিল। এ পর্যন্ত যারা শহীদ হয়েছেন এবং যারাই এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন তাদের সকলের চাওয়া এই একটি বিন্দুতে এসে মিলিত হয়েছে। কাজেই যখন আমরা সবাই মিলে আল্লাহকে সাহায্য করার আকাঙ্ক্ষা বুকে ধারণ করেছি তখন আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই আমাদেরকে সাহায্য করবেন।”

ইমাম খোমেনী দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন ইসলামি প্রাথমিক যুগে মুসলিম যোদ্ধারা যেভাবে ঐশী সাহায্য লাভ করেছিলেন ইরানি যোদ্ধারাও সেভাবে অদৃশ্য শক্তির পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করবেন। ইরানি যোদ্ধারা ফ্রন্টে চরম প্রতিকূল পরিবেশে যে প্রশান্ত চিত্ত লাভ করেছিলেন তার একমাত্র কারণ এটি ছিল বলে মনে করতেন ইমাম। তিনি এ সম্পর্কে ইরানি যোদ্ধাদের উদ্দেশ করে বলেন: “আপনারা আল্লাহর ওপর ভরসা করেছেন বলে মানসিকভাবে প্রফুল্ল থাকুন ও সব দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলে দিন। কারণ, যে আল্লাহর ওপর ভরসা করে সে সাহায্যপ্রাপ্ত হয়। মহান আল্লাহ আপনাদেরকে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তবে শর্ত হচ্ছে আপনারা ততদিন সাহায্যপ্রাপ্ত হবেন যতদিন আপনারা আল্লাহকে সাহায্য করতে থাকবেন।” বাস্তবে হয়েছিলও তাই।  ইরানের সেনাবাহিনী ও আইআরজিসি’র কমান্ডাররা পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধের প্রতিটি স্তরে যেকোনো অভিযান চালাতে বা আত্মরক্ষা করতে গিয়ে এই ঐশী সাহায্যের বিষয়টি গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন।

তারা যখনই কোনো অভিযানে জয়ী হতেন তখনই মুখে একথা উচ্চারণ করতেন যে, এটি আল্লাহর সাহায্যেই সম্ভব হয়েছে। আইআরজিসির তৎকালীন প্রধান কমান্ডার মেজর জেনারেল মোহসেন রেজায়ি ১৯৮২ সালের গ্রীষ্মে খোররামশাহর পুনরুদ্ধারের অভিযানে জয়ী হওয়ার কারণ সম্পর্কে বলেন: “সবার আগে স্বীকার করতে হবে যে, ওই অভিযানে আল্লাহ তায়ালার সাহায্য ও দিকনির্দেশনা ছিল। কারণ, বাস্তব অবস্থা পর্যালোচনা করে অনেক কমান্ডার ওই অভিযানের বিরোধিতা করেছিলেন। সমরাস্ত্র, লোকবল ও অন্য যেকোনো প্রেক্ষাপটকে বিবেচনায় নিলে আমাদের পক্ষে ওই অভিযানে জয়লাভ করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু আমাদের একমাত্র ভরসাস্থল ছিল আল্লাহর সাহায্য এবং সেদিকে তাকিয়ে অবশেষে সব কমান্ডার ওই অভিযানের পক্ষে মত প্রকাশ করেন। ”

খোররামশহার মুক্ত করার অভিযান সম্পর্কে ইরানের তৎকালীন সেনাপ্রধান লে. জেনারেল শহীদ সাইয়্যাদ শিরাজি বলেন: “ওই অভিযানের বিভিন্ন পর্যায়ে আমরা ঐশী মদদের বিষয়টি উপলব্ধি করেছিলাম। অভিযানের বিভিন্ন পর্যায়ে আমরা অনেক বড় বড় প্রতিবন্ধকতা ও ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছি। কিন্তু আল্লাহর ওপর পরিপূর্ণ আস্থা ও ভরসা রাখার কারণে অনেকটা অলৌকিকভাবে সেসব প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করা সম্ভব হয়েছে। এ কারণে আমরা অভিযান শেষে আল্লাহর শোকর আদায় করেছি।”

তিনি আরো বলেন, আল্লাহ তায়ালার ওপর ভরসা ছিল বলেই আমাদের পক্ষে এটা করা সম্ভব হয়েছিল। মহান আল্লাহ মুমিনদেরকে সাহায্য করার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আমরা সেদিন তা আমাদের সমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে উপলব্ধি করেছি। আল্লাহ তায়ালা যখন মুমিনদের সাহায্য করাকে নিজের জন্য কর্তব্য বলে নির্ধারণ করে নিয়েছেন তখন আমরা একটি বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম যে, বিজয় আমাদের হবেই। এ সম্পর্কে একজন ইরানি পাইলটের স্মৃতিকথাও উল্লেখ করা যায়। মেইমাক অঞ্চলে অভিযান পরিচালনাকারী ওই পাইলট বলেন: আমরা ভোরে ইলাম থেকে মেইমাকের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যাই। সেখানে পৌঁছে দেখি তিন ডিভিশন ইরাকি সেনাদের মোকাবেলায় আমাদের খুব অল্প সংখ্যক সেনা লড়াই করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রথম ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু পরক্ষণে ঐশী মদদের কথা মনে করে অন্তরে প্রশান্তি অনুভব করলাম।

তিনি আরো বলেন, আমরা আল্লাহর নামে যুদ্ধ শুরু করেছিলাম এবং আমাদের আশা ছিল আল্লাহ আমাদেরকে সাহায্য করবেন। আমি তাকিয়ে দেখি আমার দুচোখ যতদূর যায় ততদূর পর্যন্ত ইরাকি সেনা মোতায়েন রয়েছে।  এ অবস্থায় আমাদের হাতে যে কয়েকটি হেলিকপ্টার ছিল সেগুলো দিয়েই এই বিশাল বাহিনীর মোকাবিলা করতে প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলাম। আমি হেলিকপ্টার চালিয়ে ইরাকি সেনাদের মাথার উপরে পৌঁছে যাই। মেশিনগান দিয়ে তাদের উপর এমনভাবে ব্রাশফায়ার করতে থাকি যে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। ইরানি বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টার ও মেশিনগানের মুহর্মূহু গুলবর্ষণের শব্দে ইরাকি বাহিনীর অন্তরে কাঁপন ধরে যায় এবং তারা পালাতে থাকে।#

পার্সটুডে/এমএমআই/বাবুল আখতার/১৮

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।