ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস
ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস (১৪৭): যুদ্ধের ময়দানে ইরানি যোদ্ধাদের আল্লাহর স্মরণ
পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ইরানি যোদ্ধারা আল্লাহ তায়ালার প্রতি গভীর ঈমান রাখতেন। আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীর বেশিরভাগ সেনা অধিক অর্থ পাওয়ার লোভে কিংবা সাদ্দাম সরকারের ভয়ে যুদ্ধে এসেছিল। কিন্তু ইরানি যোদ্ধারা ইসলাম ও দেশরক্ষার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বেচ্ছায় যুদ্ধক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।
ইরাকি সেনারা যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত বা আহত না হওয়া পর্যন্ত ঘরে ফিরে যেতে পারত না। যতক্ষণ সুস্থ থাকত ততক্ষণ তাদের সেরকম ছুটি বা যুদ্ধের দায়িত্ব পালনে অব্যাহতি মিলত না। কিন্তু ইরানি যোদ্ধারা ইচ্ছে করলেই সাময়িক ছুটি কিংবা স্থায়ীভাবে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিতে পারতেন।
এছাড়া, স্বেচ্ছাসেবার ভিত্তিতে বেসামরিক ইরানি নাগরিকরা স্বল্প প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হতেন। এরকম যোদ্ধাদের যুদ্ধক্ষেত্রে থাকার মেয়াদ ছিল তিন মাস। তিন মাস পর তাদের সবাই নিজ নিজ ঘরে ফেরার ক্ষেত্রে স্বাধীন ছিলেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, ওই সুযোগ কাজে লাগিয়ে শতকরা মাত্র ৩০ ভাগ ইরানি যোদ্ধা নিজেদের প্রত্যাহার করে নেন। বাকি ৭০ ভাগ যোদ্ধা পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ফ্রন্টেই ছিলেন। তিন মাস পর পর তারা নিজ ঘরবাড়িতে ফিরে এসে কিছুদিন ছুটি কাটিয়ে আবার যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে যেতেন। কাজেই দেখা যাচ্ছে, ইরানের ওপর ইরাকের চাপিয়ে দেওয়া আট বছরের যুদ্ধে দুই দেশের শিবিরের সার্বিক পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। ইরানি যোদ্ধারা যখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে রণাঙ্গনে যেতেন তখন ইরাকি সেনারা যুদ্ধ আসত বাধ্য হয়ে।
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের পরিপূর্ণ পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া সত্ত্বেও ইরাকি সেনারা একের পর এক ফ্রন্টে ইরানি যোদ্ধাদের কাছে ধরাশায়ী হচ্ছিল। যুদ্ধের প্রথম বছরে ইরাকিরা অকস্মাৎ আগ্রাসন চালিয়ে ইরানের বেশ কিছু এলাকা দখল করে নিলেও দ্বিতীয় বছর থেকে যুদ্ধের নিয়ন্ত্রণ ইরানি যোদ্ধাদের হাতে চলে আসে। ইরানি সৈনিকেরা রাত্রীকালীন অভিযান চালিয়ে একের পর এক ইরাকি শিবিরকে নাস্তানাবুদ করতে থাকেন। যুদ্ধের দ্বিতীয় বছরে খোররামশাহর পুনরুদ্ধার করার অভিযানে প্রায় ২০ হাজার ইরাকি সেনা ইরানের হাতে বন্দি হয়। বায়তুল মুকাদ্দাস নামের ২৫ দিনব্যাপী ওই অভিযানে হাজার হাজার ইরাকি সেনা হতাহত হয়।
ইরানি যোদ্ধারা মৃত্যুকে পরোয়া না করে অভিযান পরিচালনা কিংবা আত্মরক্ষা উভয় ক্ষেত্রে অত্যন্ত সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। ফাতহুল মোবিন অভিযানে ইরানের অল্প কিছু যোদ্ধা ইরাকের বিশাল বাহিনীর মোকাবিলা করেন। ওই অভিযান সম্পর্কে ইরানের হাতে আটক একজন ইরাকি সেনা বলেন, “আমাদের সেনারা একটি পরিখায় অবস্থান গ্রহণকারী ইরানের আট যোদ্ধার সঙ্গে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়। আমাদের ছয়টি সেনাদল যার প্রতিটিতে একশ করে সৈন্য ছিল তারা ওই আট ইরানি যোদ্ধার বিরুদ্ধে লড়াই করে। কিন্তু ওই আটজন আমাদের ৬০০ সেনার বিরুদ্ধে অদ্ভূত প্রতিরোধ গড়ে তোলে। আমরা ইরানি যোদ্ধাদের দিকে গ্রেনেড নিক্ষেপ করি কিন্তু তারা আমাদেরই নিক্ষিপ্ত গ্রেনেড মাটি থেকে কুড়িয়ে আবার আমাদের দিকেই ছুড়ে মারে। এতে আমাদের বেশ কয়েকজন সেনা হতাহত হয়।”
আটক ইরানি সেনা আরো বলেন, “এ অবস্থায় আমরা ইরানি যোদ্ধাদেরকে আর রক্তক্ষয় না করে আত্মসমর্পণ করার আহ্বান জানাই কিন্তু তারা প্রতিরোধ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকে। ঠিক এ সময় আমাদের পক্ষে দু’টি ট্যাংক এসে হাজির হয় এবং একটি ট্যাংক এগিয়ে গিয়ে পরিখার মধ্যে কামানের নল ঢুকিয়ে দেয়। ফলে ওই আট ইরানি যোদ্ধার আত্মসমর্পণ করা ছাড়া উপায় থাকে না। তারা বাইরে বেরিয়ে এলে দেখা যায় তাদের একজন নিহত ও তিনজন আহত হয়েছে এবং বাকি চারজন সুস্থ আছে।” এভাবে পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে ইরানি যোদ্ধারা বহুবার তাদের প্রতি আল্লাহর সাহায্য প্রত্যক্ষ করেছেন।
ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেনী (রহ.) পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধের দিনগুলোতে যে কথাগুলো বারবার বলতেন তা হচ্ছে: “আল্লাহর শক্তিই বড় কথা। আপনারা ইরানি যোদ্ধারা যা কিছুই করেন সেটা আল্লাহর শক্তিতেই করেন। আপনারা যে গুলিটিই ছোড়েন সেটি আল্লাহর শক্তিতেই ছোড়া হয়। তাঁর দেওয়া শক্তি দিয়ে আপনারা ট্রিগারে চাপ দেন এবং গুলি নিক্ষিপ্তি হয়। সামরিক ও বেসামরিক সকল কাজে সকল শক্তির পেছনে রয়েছেন আল্লাহ তায়ালা।”
ইরাকের হাতে বন্দি ইরানি যোদ্ধারা বন্দিজীবনে আল্লাহর স্মরণের মাধ্যমে মানসিক প্রশান্তি লাভ করতেন। এরকম একজন যোদ্ধা মুক্ত হয়ে দেশে ফেরার পর নিজের স্মৃতিকথায় লিখেছেন: কখনও কখনও মনে হতো আমি কোনোদিন ইরাকের কারাগার থেকে মুক্ত হবো না। ওই কঠিন পরিস্থিতিতে আমরা নিজেদের অন্তরে বিশাল শূন্যতা অনুভব করতাম এবং সে শূন্যতা কেবল আল্লাহর স্মরণের মাধ্যমে পূর্ণ হতো।
ইরানি যোদ্ধারা যে শুধু যুদ্ধক্ষেত্রে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন তা নয় বরং ইরাকি বন্দিশিবিরগুলোতেও তাদেরকে কঠোর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হয়েছে। ইরাকি কারারক্ষীরা ইরানি বন্দিদের ওপর চরম শারিরীক ও মানসিক অত্যাচার চালাত। তারা যুদ্ধক্ষেত্রে নিজেদের পরাজয়ের প্রতিশোধ ইরানি বন্দিদের কাছ থেকে নেওয়ার চেষ্টা করত। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ইরাকি কারাগারে বন্দি শতকরা ৯০ ভাগ ইরানি যোদ্ধা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এবং তাদের মধ্যে শতকরা ৩৭ ভাগই নির্যাতনের কারণে শারিরীক পঙ্গুত্ববরণ করেছেন। এই একটি পরিসংখ্যানই বলে দেয় সাদ্দাম বাহিনীর সেনারা কতটা নৃশংসভাবে ইরানি বন্দিদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে।
এ সম্পর্কে একজন ইরানি যোদ্ধা তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন, “আমাদের ওপর নির্যাতন চালানো ইরাকি কারারক্ষীদের বিনোদনে পরিণত হয়েছিল। তারা ভাঙা কাঁচের টুকরো উপর দিয়ে আমাদেরকে খালি পায়ে হেঁটে যেতে বাধ্য করত।”
তিনি আরো বলেন, “একবার আমাদেরকে ভাঙা কাঁচের টুকরার উপর দিয়ে দৌড়াতে বাধ্য করা হয়। কাঁচের টুকরাগুলো পায়ের চামড়া ও গোশত ভেদ করে হাড়ে গিয়ে আঘাত করে। সে দৃশ্য এখন কল্পনা করতেও আমার গা শিউরে ওঠে।”
ওই কারাগার থেকে মুক্ত আরেক ইরানি যোদ্ধা বলেন: আমাদের দৌড় শেষ হওয়ার পর ওই রক্তাক্ত পায়ে আমাদেরকে রশিতে ঝুলিয়ে পেটানো হয়। তারা আমাদের কাছ থেকে তাদের চাহিদামতো তথ্য বের করার জন্য যেকোনো নির্যাতন করতে প্রস্তুত ছিল। আমার তখন একটি গোপন অভিযানের পরিকল্পনা জানা ছিল। আমি আল্লাহর কাছে চাইলাম তিনি যেন আমাকে নির্যাতন সহ্য করে টিকে থাকার তৌফিক দেন এবং ইরাকিদের হাত থেকে আমাকে মুক্ত করার ব্যবস্থা করেন।” এভাবে ইরানি যোদ্ধারা চরম দুঃসময়েও আল্লাহর ওপর ভরসা করতে ও তাঁর সাহায্য চাইতে ভোলেননি।#
পার্সটুডে/এমএমআই/বাবুল আখতার/১৮
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।