সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২৩ ১৫:০৩ Asia/Dhaka
  • ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস (১৪৮): যুদ্ধের ময়দানে ইরানি যোদ্ধাদের আল্লাহর স্মরণ

পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে ইরানি যোদ্ধাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল তাদের সাহসিকতা ও বীরত্ব। তাদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিল চরম প্রতিকূল পরিবেশ সহ্য করার মতো মানসিক শক্তি। আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীর বিরুদ্ধে ইরানি যোদ্ধাদেরকে গ্রীষ্মের প্রচণ্ড গরমে এবং শীতকালের হাঁড় কাঁপানো ঠাণ্ডায় লড়াই করতে হয়েছে।

এসব লড়াইয়ের জন্য প্রশিক্ষণও নিতে হয়েছে ওইরকম পরিবেশেই। প্রশিক্ষণের সময় তাদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে আরো কঠোর প্রতিকূল পরিবেশ যা সহ্য করার জন্য ইরানি যোদ্ধাদেরকে ধৈর্যশক্তি বাড়াতে হয়েছে কয়েক গুণ। যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে ডুবুরিদের প্রশিক্ষণ ছিল সবচেয়ে কঠিন। চরম প্রতিকূল পরিবেশে চালানো ওয়ালফাজর-৮, কারাবালা-৩ ও কারবালা-৫ অভিযানে ইরানি ডুবুরিরা অসামান্য অবদান রেখেছেন।

উদাহরণস্বরূপ, ইরানি যোদ্ধাদেরকে ওয়ালফাজর-৮ অভিযানে প্রচণ্ড খরস্রোতা বিশাল আরভান্দ নদী পার হয়ে ইরাকি বাহিনীর ওপর হামলা চালাতে হতো। ওই অভিযানের সম্মুখসারির যোদ্ধা ছিলেন ইরানের ডুবুরিরা। তারা অগ্রগামী বাহিনী হিসেবে প্রথমে নদী পার হয়ে ইরাকি সেনাদের প্রতিরোধ ব্যুহ ভেঙে ফেলেন এবং এরপর ইরানের পদাতিক বাহিনী মূল অভিযান চালায়।

ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসির সারুল্লাহ-৪১ ডিভিশন গঠন করা হয়েছিল মূলত ডুবুরিদের নিয়ে। ওই ডিভিশনের একজন কমান্ডার বলেন: আরভান্দ নদীতে জোয়ার ও ভাটার মধ্যবর্তী সময়গুলোতে পানি তুলনামূলক শান্ত থাকলেও যখন জোয়ার বা ভাটা হতো তখন ওই নদীতে সাঁতার কাটা একটি দুঃসাধ্য বিষয় হয়ে দাঁড়াত। এছাড়া, এ সময় বড় বড় ঢেউও হতো। দুই মিটার থেকে চার মিটার পর্যন্ত উঁচু হতো এসব ঢেউ।

ওই কমান্ডার আরো বলেন, বিশেষ করে আরভান্দ নদী যেখানে গিয়ে পারস্য উপসাগরে পড়েছে সেখানে সাঁতার কাটা অসম্ভব বলে মনে হতো। আমাদের বাহিনীর ডুবুরিরা প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নিয়েছিল জলাশয়ের স্থির পানিতে। তাই এ ধরনের খরস্রোতা নদী বা সাগরের পানি অতিক্রম করার জন্য তাদেরকে নতুন করে প্রশিক্ষণ নিতে হয়। প্রশিক্ষণের একটি অংশ ছিল পানির মধ্যে সাঁতার কাটতে থাকা অবস্থায় গুলি চালানো। এমনকি আরপিজি নিক্ষেপ করার কাজও তাদেরকে সাঁতার কাটতে থাকা অবস্থায় করতে হয়েছে।

এ সম্পর্কে ওয়ালফাজর-৮ অভিযানে অংশগ্রহণকারী একজন ডুবুরি বলেন: আমরা তিন শিফট ভাগ হয়ে সাগরে সাঁতার কাটতে যেতাম। একদল যেতাম সকালে, একদল বিকেলে এবং আরেকদল রাতে। আবহাওয়া ছিল প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। একদলের সাঁতার শেষ হওয়ার পর তাদের পোশাক পরেই পরবর্তী দলকে পানিতে নামতে হতো।

ওই ডুবুরি আরো বলেন, শীতের মধ্যরাতে পানি নামার চেয়ে কঠিন আর কোনো কাজ ছিল না। রাত ২টা/৩টার সময় ঘুম থেকে উঠে আগের দলের ব্যবহৃত ভেজা পোশাক পরে পানিতে নামতে হতো। আরেকজন যোদ্ধা এ সম্পর্কে বলেন: আমাদের প্রশিক্ষণের সময় শেষ হয়ে এসেছিল। আমরা বলতে গেলে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা পানির মধ্যে কাটাচ্ছিলাম।  সময়টা ছিল জানুয়ারি মাসের প্রচণ্ড ঠাণ্ডা।  সেই ঠাণ্ডা উপেক্ষা করে আমরা দিনের মধ্যে মনে হয় একশ’ বার ‘বাহমান শির’ নদীর এপার থেকে ওপারে এবং ওপার থেকে এপারে আসতাম। পানি থেকে যখন ডাঙায় উঠতাম তখন আমাদের হাতের আঙ্গুলগুলো নাড়াতে পারতাম না এবং ডুবুরির পোশাকের চেইন খোলার মতো শক্তি থাকত না। এ সময় লজিস্টিক বিভাগের যোদ্ধারা আমাদের জন্য আগুন জ্বালাত এবং আমাদের পোশাক খুলতে সাহায্য করত।  

১৯৮০ সালে যখন ইরাকি বাহিনী আগ্রাসন শুরু করে তখন তাদেরকে প্রতিহত করার মতো প্রস্তুতি বা শক্তি ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর ছিল না। কিন্তু তারপরও ইরানের অল্প কিছু বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈনিক আগ্রাসী বাহিনীকে কোনো কোনো ফ্রন্টে রুখে দিয়েছিলেন। তারা সীমান্তবর্তী খোররামশাহর শহরের পতন ৩৪ দিন পর্যন্ত ঠেকিয়ে রেখেছিলেন। ইরাকি বাহিনী খোররামশাহর দখলের জন্য তাদের ৩৩ ব্রিগেডের বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দুই ব্যাটালিয়ান সেনা পাঠায়। তাদের ধারনা ছিল কয়েক ঘণ্টার মধ্যে শহরটি দখল করে ফেলতে পারবে। কিন্তু ইরানি যোদ্ধাদের প্রবল প্রতিরোধের কারণে তারা সেই দুই ব্যাটেলিয়ান সেনাকে দুই ডিভিশনে উন্নীত করতে বাধ্য হয় এবং খোররামশাহর দখলের জন্য এক মাসের বেশি সময় ধরে অপেক্ষা করতে হয়।

ইরানি জনগণের কাছে খোররামশাহর নিছক একটি শহর নয় বরং প্রতিরোধ ও  আত্মত্যাগের এক উজ্জ্বল ইতিহাস। আগ্রাসী ইরাকি বাহিনী ১৯৮০ সালের অক্টোবর মাসে এটি দখল করে এবং দুই বছরেরও কম সময়ের মাথায় ১৯৮২ সালের ২৪ মে ইরানি যোদ্ধারা শহরটিকে পুনরুদ্ধার করে। খোররামশাহর পুনরুদ্ধার উপলক্ষে ইরানি ক্যালেন্ডারে ২৪ মে প্রতিরোধ দিবস হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে।

খোররামশাহর ইরানের দক্ষিণাঞ্চলীয় একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দরনগরী। শহরটির ভেতর দিয়ে খরস্রোতা কারুন নদী প্রবাহিত হয়ে পারস্য উপসাগরে গিয়ে পড়েছে। কৌশলগত দিক দিয়ে ইরানের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ শহরটি দখল করার জন্য ইরাকের সাদ্দাম সরকার বিশেষভাবে মনযোগী হয়েছিল।  সাদ্দাম ও তার বিদেশি সহযোগীরা ভেবেছিল খোররামশাহর দখল করতে পারলে ইরানের শক্তি অনেকাংশে কমে আসবে এবং এরপর একের পর এক হামলা চালিয়ে দ্রুত ইরানের বাকি অংশ দখল করে ফেলা সম্ভব হবে।

কিন্তু ইরানি যুবকদের ঈমানি শক্তি ও প্রত্যয়ের কথা সাদ্দামের জানা ছিল না। ইরাকের এই স্বৈরশাসক ভেবেছিল কয়েকদিনের মধ্যে সে ইরানে তার সামরিক লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে। কিন্তু আগ্রাসনের প্রথম দিনগুলোতেই খুজিস্তানসহ ইরানের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ আগ্রাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। বিশেষ করে ইরাকি বাহিনী যখন খোররামশাহর অবরোধ করে তখন সেখানে অবস্থানরত ইরানি যোদ্ধারা আত্মত্যাগ আর বীরত্বগাঁথার এক অনন্য নজীর স্থাপন করেন। ইরাকি বাহিনী শহরটি দখল করেছিল ঠিকই কিন্তু অক্ষত অবস্থায় নয়। খোররামশাহরের এমন কোনো বাড়ি অবশিষ্ট ছিল না যেটিতে কামানের গোলা আঘাত হানেনি। ইরাকের একজন সেনা কমান্ডার একথা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে যে, ইরানি প্রতিরোধ যোদ্ধারা তাদের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে খোররামশাহরে পতন ঠেকানোর চেষ্টা করেছে।

পার্সটুডে/এমএমআই/বাবুল আখতার/১৮

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।