সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২৩ ১৮:০৮ Asia/Dhaka

প্রিয় পাঠক ও শ্রোতাবন্ধুরা! সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করি যে যেখানেই আছেন ভালো ও সুস্থ আছেন। আজ আমরা শুনবো প্রাচীন একটি  ইরানি গল্প। গল্পটি শেখ সাদি'র গোলেস্তান থেকে নেয়া। গল্পটি এরকম: 

বেশ প্রাচীনকালে খোরাসানি দুইজন দরবেশ ছিলেন। তাদের মধ্যে দারুণ সখ্যতা ছিল মানে পরস্পরে খুবই ভালো বন্ধু ছিল তারা। এতোটাই ভালো, আন্তরিক এবং সহৃদয় ছিল যে তাদের দেখে লোকজন বলাবলি করতো-ওরা দু'জন এক বাদামের খোসার ভেতর দুই টুকরোর মতো।

ওই দুই বন্ধুর একজন মোটা এবং পেটভারি শক্তিশালী। সে যতই খেত পেট ভরতো না তার। পক্ষান্তরে অন্য দরবেশ ছিল পাতলা গঠনের এবং দুর্বল। সে খাবার খেত খুবই কম এমনকি বেশিরভাগ দিনই খাবারের প্রতি তার কোনো আকর্ষণ থাকতো না। পেট মোটা দরবেশ সবসময় ক্ষুধার্ত থাকতো আর পাতলা দরবেশ মনে হতো যেন কখনই তার ক্ষুধা লাগতো না, কোনোরকম দুই-তিন লোকমা খেলেই পেট ভরে যেত। আবার কাজের ক্ষেত্রে দেখা যেত পাতলা দরবেশ ভালোই পরিশ্রম করতে পারতো কিন্তু মোটা দরবেশ কাজের ব্যাপারে ছিল ভীষণরকম অলস। সে কেবলই ঘুমাতে পছন্দ করতো। এরকমই বিপরীতধর্মী ছিল দুই দরবেশের চরিত্র। 

সময়ের পরিক্রমায় একদিন ওই দুই দরবেশের সামনেই সফরের সময় এলো। বেশ দূরের সফর। বেশ লম্বা সময় ধরে অনেক পথ পাড়ি দিয়ে তারা ক্লান্ত হয়ে গেল। ওই ক্লান্ত শ্রান্ত অবসন্ন দেহেই এক সময় তারা শহরের প্রবেশদ্বারে গিয়ে উপস্থিত হলো। ঘটনাক্রমে শহরের প্রবেশদ্বারে যাবার পর দুই দরবেশই গ্রেফতার হলো। কারণটা হলো তাদেরকে গোয়েন্দাগিরির ব্যাপারে সন্দেহ করা হয়েছিল। সুতরাং দুজনকেই একটা ঘরে বন্দি করে রাখা হলো। ওই ঘর থেকে কোনোভাবেই বের হবার মতো সুযোগ ছিল না। ঘরের সকল দরোজা জানালা এমন মজবুত করে আটকানো ছিল যে সেগুলো ভেদ করার মতো অবস্থা ছিল না। 

কেবল ঘরের ছাদের মাঝখানে ছোট্ট একটু খোলা জায়গা ছিল। ওই জায়গা দিয়ে ঘরে আলো-বাতাস প্রবেশ করতো। দরবেশরা একজন আরেকজনের দিকে তাকালো। তারা বুঝতে পারছিলো না কী অপরাধে তাদেরকে বন্দী করা হয়েছে। কেবল পুলিশের মুখে একটু গুঞ্জন শুনলো যে তারা দুইজন নাকি গুপ্তচর। মোটা দরবেশ ভীষণ ক্ষুধার্ত ছিল। সে বললো: গুপ্তচরবৃত্তির সঙ্গে আমাদের তো কোনো সম্পর্কই নেই। পাতলা দরবেশও পানির পিপাসায় কাতর হয়ে পড়েছিল। আবার বিস্তর পথ পায়ে হেঁটে আসায় তার পা ব্যথা করছিল। সে তাই পা দুটো আলতো করে মেসেজ করতে করতে বললো: আমাদের সঙ্গে যে বিষয়টি একেবারেই যায় না সেটা হলো গুপ্তচরবৃত্তি। 

পাতলা দরবেশ আরও বললো: জানি না কোন আহাম্মক রিপোর্ট করেছে আমাদের ব্যাপারে। যাই হোক আমরা তো আর কোনো ভুল করি নি, সুতরাং আল্লাহ আমাদের পরিণতি যেন সৌভাগ্যময় করেন। কে জানে এই বন্দিদশা থেকে আদৌ মুক্তি পাবো কি না! মোটা দরবেশ বললো: না.. কী বলো! আমরা খুব দ্রুতই ছাড়া পেয়ে যাবো। তারা যখন তদন্ত করে দেখবে এবং বুঝতে পারবে যে আমরা নির্দোষ, অবশ্যই আমাদের কাছে আসবে এবং আমাদের মুক্তি দেবে। পাতলা দরবেশ বললো: যতোটা সহজ মনে করছো ততোটা সহজ নয় বন্ধু! তত সহজ নয়। মোটা দরবেশ এবার বললো: ঠিকই বলেছো! আমাদের শত্রুরা কেউ যদি সাক্ষ্য দেয় যে আমরা গুপ্তচর তাহলে আমরা যে সত্যিই নির্দোষ সেই সাখ্য কে দেবে?

পাতলা দরবেশ বললো: কেউ দেবে না। আমার উদ্বেগটা সেজন্যই। আমরা তো ক্ষুণাক্ষরে কোনোদিন চিন্তাও করি নি গুপ্তচরবৃত্তি করবো অথচ সেই অপরাধে আমরা গ্রেফতার হয়ে এখন বন্দি হয়ে আছি। এখন ভয় হচ্ছে যদি সত্যিই আমাদেরকে গুপ্তচর বলে সাব্যস্ত করে তখন কী হবে! নি:সন্দেহে আমাদেরকে ফাঁসিতে ঝোলানো হবে। এমনও তো হতে পারে ফাঁসি কার্যকর করার পর তারা জানতে পারলো যে আমরা নির্দোষ ছিলাম। তখন আর ফায়দা কী! আমরা তো আর জীবিত হতে পারবো না। ঐ দুই নিরীহ দরবেশ গুপ্তচরবৃত্তির গন্ধও তাদের গায়ে ছিল না, একেবারেই নিষ্পাপ ছিল তারা। বেচারারা কারাগারের অন্ধকারে বিষন্ন মনে পড়ে রইলো। কী করবে না করবে ভেবে কুল পাচ্ছিল না। 

হ্যাঁ অবশেষে তারা নিজেদের মনে আশার সঞ্চার করে পরস্পরকে বললো: আরে আমরা তো নির্দোষ, কিছুই হবে না। দেখো কালই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে হ্যাঁ। পাতলা দরবেশ বললো: মুক্তি পেলেই হলো। বাতাসের আগে ছুটে যাবে এখান থেকে, পেছনে আর তাকাবো না। এই শহরে আর ফিরবো না। মোটা দরবেশ বললো: হ্যাঁ ভুলেও না। বিশ্বের সকল খাবার যদি এই শহরে ফ্রি-ও দেয় তবুও ফিরবো না। কিন্তু দুই সপ্তা পর তারা ঠিকই মুক্তি পেল। জানা গেল যে তারা আসলে গুপ্তচর নয়। দরোজা খুলে বেরিয়ে এলো পাতলা দরবেশ। তবে মোটা দরবেশ মারাই গেল। পাতলা দরবেশ বেরুতেই লোকজন তাকে ঘিরে বৃত্ত রচনা করলো। তারা বলাবলি করতে লাগলো-এতো দুর্বল মানুষটা কী করে একদিন পর পর সামান্য রুটি আর ক'গ্লাস পানি খেয়ে বেঁচে রইলো! 

দরবেশ তার মোটা বন্ধুর শোকে কাঁদতে লাগলো। বললো: এদের অকারণ সন্দেহের জেরে আমার বন্ধু মারা পড়লো। এখন কী করে তারা ওর কাছে দু:খ প্রকাশ করবে? এ নিয়ে কিন্তু কারো ভাবনা নেই। সবাই ভাবছে পাতলা দরবেশ বেঁচে আছে কীভাবে, যেখানে মোটা দরবেশ মরে গেল? লোকজনের কথা শুনতে পেল একজন ডাক্তার। সে ওখানেই ছিল। বললো: মোটা দরবেশ না মরে পাতলা দরবেশ মরলেই আশ্চর্য হতাম। মোটা লোকটি অতিরিক্ত খাবার খেত। ক্ষুধার কষ্ট সহ্য করতে না পেরে মরে গেছে। কিন্তু পাতলা দরবেশ ছিল সংযমী। সে ক্ষুধাতৃষ্ণা সহ্য করতে পারতো। ধৈর্যধারন করতে পারতো, তাই সে বেঁচে গেছে।#
পার্সটুডে/এনএম/১৮/৯৬
মূল ফার্সি গল্পের রূপান্তর: নাসির মাহমুদ
 

ট্যাগ