সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২৩ ১৭:৪৯ Asia/Dhaka
  • মোহাম্মাদ হোসেইন ফাহমিদে
    মোহাম্মাদ হোসেইন ফাহমিদে

পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীর হাত থেকে খোররামশাহর রক্ষা করতে কিশোর ও তরুণরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিল। ইরাক সীমান্তে অবস্থিত এই শহরের প্রতিরোধ যোদ্ধারা আগ্রাসী বাহিনীকে ৩৪ দিন পর্যন্ত ঠেকিয়ে রেখেছিলেন।

তারা জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে মাতৃভূমি রক্ষা করে এক ঐতিহাসিক বীরত্বগাঁথা তৈরি করেছিলেন।  নিজ শহর রক্ষা করতে গিয়ে যেসব যোদ্ধা প্রাণপণ লড়াই করেছিলেন তাদের অন্যতম ছিলেন ১৩ বছর বয়সি বেহনাম মোহাম্মাদি। বেহনাম ১৯৬৭ সালে খোররামশাহরে নিজের পৈত্রিক ভিটায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বরে শহরটিতে এই গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, ইরাকি বাহিনী খোররামশাহরে হামলা চালাতে পারে।

বেহনাম মোহাম্মাদি

বেহনাম একথা বিশ্বাস করতেই পারছিলেন না যে, তার প্রিয় শহরটি ইরাকিরা দখল করে নেবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই গুজব সত্যি হয়।  ইরাক ইরানে আগ্রাসন চালায় এবং যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। খোররামশাহর ছেড়ে নারী, শিশু ও বৃদ্ধরা ইরানের অভ্যন্তরে নিজেদের আত্মীয়-স্বজনের কাছে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান। কিন্তু ১৩ বছর বয়সি বেহনাম শহর রক্ষা করতে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সঙ্গে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ইরাকের পদাতিক বাহিনী খোররামশাহর অবরোধ করে রাখে এবং দেশটির বিমান বাহিনী শহরের বিভিন্ন অবস্থানে বোমাবর্ষণ করে। কোথাও বোমাবর্ষণ হলেই বেহনাম আহতদের সেবায় ছুটে যেতেন। শহরে অবস্থানকারী ইরানি যোদ্ধাদের কাছে কিছু রাইফেল ছাড়া আর কিছু ছিল না। তারা উপায়ন্তর না দেখে মোলোটভ ককটেল বানাতে শুরু করেন।

শিশু বেহনাম শত্রুসেনাদের অবস্থান জানার জন্য শহর ছেড়ে বেরিয়ে পড়তেন এবং ফিরে এসে প্রতিরোধ যোদ্ধাদেরকে মূল্যবান তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করতেন। তাকে কয়েকবার ইরাকি সেনারা ধরে ফেলে। একবার তিনি ধরা পড়ার পর ইরাকি সেনাদের বলেন, আমি মায়ের সঙ্গে যাচ্ছিলাম হঠাৎ মাকে হারিয়ে ফেলেছি। ইরাকি বাহিনীও একথা বুঝতে পারত না যে, মাত্র ১২/১৩ বছরের একটি ছেলে গোয়েন্দা তৎপরতা চালাতে পারে। তাই তারা বেহনামকে ছেড়ে দিত। শেষ পর্যন্ত ইরানি যোদ্ধাদের প্রতিরোধ ব্যুহ ভেদ করে ইরাকি বাহিনী খোররামশাহরের একাংশ দখল করে নেয়। শহর আগেই খালি হয়ে গিয়েছিল বলে দখলদার সেনারা ইরানি নাগরিকদের ঘরবাড়িতে আশ্রয় নিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যায়। এ সময় প্রতিটি ইরানি বাড়িতে কয়েকজন করে ইরাকি সেনা দেখা যেত।

এ সময়ে বেহনাম নিজের শরীরে ধুলা মাখিয়ে চুলগুলো উস্কো খুস্কো করে কাঁদতে কাঁদতে সেইসব বাড়ির কাছে যেত যেসব বাড়িতে অধিক সংখ্যক ইরাকি সেনা অবস্থান করছিল।  ইরাকিরা ধুলাবালি মাখা একটি বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে মাথা ঘামাতে চাইত না। বেহনাম ঘুরে ঘুরে ইরাকি সেনারা সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় কোথায় আছে সে তথ্য ইরানি যোদ্ধাদের কাছে তুলে দিত। ইরানি যোদ্ধারা বেহনামের দেয়া তথ্য অনুযায়ী অভিযান পরিচালনা করতেন।  

মোহাম্মাদ হোসেইন ফাহমিদে

অবশেষে এই কিশোর যোদ্ধা ইরাকি বাহিনীর হাতে অত্যন্ত নির্মমভাবে শাহাদাতবরণ করেন। আগ্রাসী সেনারা ইরানি যোদ্ধাদের উপর মুহুর্মুহু কামান ও ট্যাংকের গোলাবর্ষণ করছিল। অরাশ নামক সড়কে দু’পক্ষের মধ্যে তীব্র লড়াই শুরু হয় যথারীতি ওই সংঘর্ষে অংশ নিতে বেহনাম এসে হাজির হয়। কিন্তু হঠাৎ প্রতিরোধ যোদ্ধারা দেখতে পান বেহনামের মাথা ও বুক দিয়ে রক্ত ঝরছে। নীল রঙের চেকশার্ট পরা বেহনামের সারা শরীর রক্তে ভরে যাচ্ছিল। ইরাকি বাহিনীর গোলার আঘাতে এই কিশোর যোদ্ধা তড়পাচ্ছিলেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করেন। খোররামশাহর পুরোপুরি ইরাকি বাহিনীর দখলে চলে যাওয়ার কয়েকদিন আগে বেহনাম মোহাম্মাদি নিহত হন।  বয়সে ছোট হওয়া সত্ত্বেও মৃত্যুর আগে অন্যান্য যোদ্ধার দেখাদেখি বেহনামও নিজের ওসিয়তনামা লিখে ফেলেছিলেন। ওই ওসিয়তনামার একাংশে লেখা রয়েছে: “আমি প্রতি মুহূর্তে শাহাদাতের প্রহর গুণছি। …সহযোদ্ধাদের কাছে আমার আকাঙ্ক্ষা তারা যেন ইমামকে একা ফেলে না যায় এবং আল্লাহকে ভুলে না যায়। তারা যেন যেকোনো পরিস্থিতিতে আল্লাহর ওপর ভরসা রাখে। হে ইরানি মাতা ও পিতারা! সন্তানদেরকে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারী হিসেবে গড়ে তোলো।”

পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ইরানি সৈনিকেরা মহান আল্লাহর ওপর পরিপূর্ণ আস্থা রাখতেন এবং মৃত্যুকে পরোয়া করতেন না। মৃত্যু ভয় দূর করতে পেরেছিলেন বলে তারা ন্যুনতম অস্ত্রসস্ত্র দিয়ে বিপুল পরিমাণ সমরাস্ত্রে সজ্জিত ইরাকি বাহিনীর মোকাবিলায় ঝাপিয়ে পড়তে পেরেছিলেন। খোররামশাহর রক্ষার লড়াইয়ে অংশগ্রহণকারী আরেক কিশোরের নাম মোহাম্মাদ হোসেইন ফাহমিদে। তার বয়সও ছিল মাত্র ১৩ বছর। বেহনাম খোররামশাহরের অধিবাসী হলেও ফাহমিদে সেখানকার অধিবাসী ছিলেন না। ১৯৬৭ সালে তার জন্ম হয়েছিল ইরানের মধ্যাঞ্চলীয় শহর কোমে।  তিনি ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের পর ইমাম খোমেনী (রহ.)-এর নির্দেশে গঠিত স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। ইরাকি বাহিনী ইরানের ওপর আগ্রাসন শুরু করলে ফাহমিদে স্বেচ্ছায় খোররামশাহর রক্ষার লড়াইয়ে অংশ নেন।

বয়স অল্প হওয়ার কারণে ফাহমিদেকে রণাঙ্গণ থেকে ফেরত পাঠানো হলে তিনি বলেন: আপনারা আমাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবেন না। আমি আবার ফ্রন্টে যাবো এবং মাতৃভূমি রক্ষার কাজে অংশ নেব। আমি আবার যুদ্ধে যাব না- এমন প্রতিশ্রুতি দিতে পারছি না। মোহাম্মাদ হোসেইন ফাহমিদে এভাবে সবার অগোচরে আবার ফ্রন্টলাইনে চলে যান এবং নিজের বন্ধু মোহাম্মাদরেজা শামসের সঙ্গে একই ঘাঁটিতে অবস্থান নেন। একদিন সম্মুখ লড়াইয়ে মোহাম্মাদ রেজা আহত হলে তাকে অনেক কষ্টে টেনে পেছনে নিয়ে যান ফাহমিদে এবং তাকে নিরাপদ স্থানে রেখে আবার যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে আসেন। তিনি ইরাকি বাহিনীর অসংখ্য ট্যাংক আসতে দেখে শরীরে কয়েকটি গ্রেনেড বেধে সামনে এগিয়ে যান। একটি ট্যাংকের সামনে গিয়ে শরীরে থাকা গ্রেনেডগুলোর বিস্ফোরণ ঘটান। ইরাকি সেনাসহ ট্যাংকটি ধ্বংস হয়ে যায় এবং সেইসঙ্গে ফাহমিদের ছোট্ট শরীরও ছিন্নভিন্ন হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এই দৃশ্য দেখার পর ইরাকি বাহিনীর বাকি ট্যাংকগুলো বড় ধরনের হামলা হয়েছে ভেবে পিছু হটে পালিয়ে যায়। এভাবে ইরাকি বাহিনীকে কয়েকদিনের জন্য আটকে রাখা সম্ভব হয় এবং এরইমধ্যে ইরানি যোদ্ধাদের জন্য রসদ সরবরাহ পৌঁছে যায়।#

পার্সটুডে/এমএমআই/বাবুল আখতার/১৮

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ