ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস
ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস (১৫২): খোররামশাহর মুক্ত করার অভিযানে ইরানি যোদ্ধাদের লড়াই
১৯৮০’র দশকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সার্বিক সহযোগিতা নিয়ে ইরাকের চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধে ইরানের যত ক্ষতিই হোক না কেন এতে এদেশের জনগণের মধ্যে আত্মবিশ্বাস প্রবল হয়েছে এবং মানুষের মধ্যে নৈতিকতা, সাহস ও নিজেকে উৎসর্গ করার মানসিকতা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।
খোররামশাহর মুক্ত করার অভিযানে ইরানি যোদ্ধাদের পক্ষে কমান্ডারের দায়িত্ব পালনকারী আহমাদ মুতাওয়াসসেলিয়ান ছিলেন এরকম একজন মানুষ। পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধের ইতিহাসে তার মতো মানুষ হাতে গোণা কয়েকজনের বেশি ছিল না। তিনি ছিলেন অসম্ভব সহ্যশক্তির অধিকারী একজন কমান্ডার যিনি দায়িত্ব পালনে ছিলেন অত্যন্ত কঠোর। তার অধীনস্ত যোদ্ধা জাফর রাবিয়ি এক সাক্ষাৎকারে এ সম্পর্কে বলেন: আহমাদ মুতাওয়াসসেলিয়ান সম্পর্কে যে চিত্রটি সবার আগে স্মৃতিতে ভেসে ওঠে তা হলো তিনি ছিলেন একজন সাহসি ও বীর যোদ্ধা। শহীদ হেম্মাত, রেজা চেরাগি ও আলী ফাজলির মতো কমান্ডারদের অধীনে কাজ করার অভিজ্ঞতা আমার ছিল। কিন্তু আহমাদ মুতাওয়াসসিলিয়ান ছিলেন তাদের সবার চেয়ে বড় মাপের কমান্ডার।
এই বীর যোদ্ধা কমান্ডিং পজিশনে থাকার সময় যোদ্ধাদের সঙ্গে কঠোর আচরণ করতেন। তার সঙ্গে দায়িত্ব পালনকারী সবাই তাকে ভয় পেতেন। রাবিয়ির ভাষায়, আহমাদ ছিলেন সরু দেহের অধিকারী লম্বা একজন মানুষ। তার সম্পর্কে অনেক কথা শোনার পর তাকে যারা কোনোদিন দেখেনি তারা তাকে দেখে অবাক হতো। কারণ, শারীরিক দিক দিয়ে তিনি তেমন কোনো সুপুরুষ ছিলেন না। আহমাদ মুতাওয়াসসেলিয়ান ছিলেন সময়ানুবর্তী একজন মানুষ এবং অন্যায়ের সঙ্গে তিনি কখনো আপোষ করেননি।
রাজধানী তেহরানের দক্ষিণে ১৯৬৩ সালে ইরানের এই বীরযোদ্ধার জন্ম হয়। স্কুলে পড়ালেখার পাশাপাশি তিনি দোকানের ব্যবসা পরিচালনায় বাবাকে সাহায্য করতেন। স্কুলজীবন থেকেই ধর্মকর্মের প্রতি তার আকর্ষণ তৈরি হয় এবং কুরআন মজিদের প্রতি আলাদা রকম অনুরাগ গড়ে ওঠে। ধমীয় ক্লাসগুলোতে তিনি তৎকালীন স্বৈরশাসক শাহের অত্যাচারের কথা শুনে কিশোর বয়সেই ওই সরকার বিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন।
১৯৭১ সালে উচ্চ মাধ্যমিক সমাপণী পরীক্ষা সম্পন্ন করেন আহমাদ মুতাওয়াসসেলিয়ান। এরপর একটি বেসরকারি কোম্পানিতে কাজ শুরু করেন এবং ওই কোম্পানির পক্ষ থেকে ইরানের লোরেস্তান প্রদেশের খোররামাবাদ শহরে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। চাকরির পাশাপাশি তিনি শাহ সরকার বিরোধী আন্দোলনে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়েন। এর ফলে তিনি শাহের পেটোয়া নিরাপত্তা বাহিনী সাভাকের দৃষ্টিতে পড়ে যান। ১৯৭৬ সালে তাকে সাভাক গ্রেফতার করে এবং তার উপর ব্যাপক নির্যাতন চালায়। খোররামাবাদে সাভাকের কারাগারের কনডেম সেলে তাকে পাঁচ মাস আটক রাখা হয়। ওই আটক ও নির্যাতনের ঘটনায় মুতাওয়াসসেলিয়ান অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ক্ষেত্রে আরো বেশি দৃঢ়চেতা হন। কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি ইমাম খোমেনী (রহ.)-এর নেতৃত্ত্বাধীন বিপ্লবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন এবং ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিপ্লবের চূড়ান্ত বিজয় হয়।
ইসলামি বিপ্লব সফল হওয়ার পর ইরানে সদ্য প্রতিষ্ঠিত ইসলামি শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র শুরু হয়। শত্রুদের পৃষ্ঠপোষকতায় ইরানের সীমান্তবতী শহরগুলোতে বিপ্লব বিরোধী তৎপরতা মাথাচারা দিয়ে ওঠে। বিশেষ করে ইরাক সীমান্তবতী ইরানের কুর্দিস্তানে প্রদেশে বিপ্লব বিরোধীরা সশস্ত্র তৎপরতা শুরু করে। তাদেরকে দমন করতে তেহরান থেকে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে অনেক যোদ্ধা কুর্দিস্তানে গমন করেন। এ সময় আহমাদ মুতাওয়াসসেলিয়ান ৬৬ সহযোদ্ধাকে নিয়ে কুর্দিস্তানের বুকান শহরে যান। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এই কমান্ডারের নেতৃত্বে ইরানি যোদ্ধারা অল্পদিনের মধ্যেই সশস্ত্র বিপ্লব বিরোধীদের দমন করে শহরকে বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীমুক্ত করেন। বুকান শহরে তার সাফল্য দেখে তাকে কুর্দিস্তান প্রদেশের আরো দু’টি শহর সাকেজ ও বানে শহরে পাঠানো হয়।
আহমাদ মুতাওয়াসসিলয়ানের নেতৃত্বাধীন যোদ্ধারা বানে শহরে পৌঁছার আগে বিপ্লব বিরোধী বিচ্ছিন্নতাবাদীরা সেনাবাহিনীর ওপর হামলা করে তাদের বড় ধরনের ক্ষতি করেছিল। বুকান শহরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আহমাদ এবার এক সাড়াশি অভিযান পরিচালনা করেন। অভিযানে ২০০ বিচ্ছিন্নতাবাদী নিহত ও প্রায় ৪০০ জন বন্দি হয়। সাকেজ ও বানে শহর শত্রুমুক্ত করার পর এই কমান্ডার তার উপ প্রধান শহীদ মোহাম্মাদ তাওয়াসসুলিসহ কুর্দিস্তান প্রদেশের কেন্দ্রীয় শহর সানান্দাজে গমন করেন। তার নেতৃত্বাধীন যোদ্ধারা বিপ্লব বিরোধীদের দ্বারা অবরুদ্ধ শহরের একদিকের অবরোধ ভেঙে ফেলেন। ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বরে ইরানের দক্ষিণাঞ্চল দিয়ে ইরাক যখন আগ্রাসন চালায় তখন ইরানকে কুর্দিস্তানেস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোকে দমনের কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর টানা এক বছর আহমাদ মুতাওয়াসসেলিয়ান কুর্দিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ব্যস্ত থাকেন। (মিউজিক)
এভাবে আহমাদ মুতাওয়াসসেলিয়ান বিপ্লব বিরোধী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অন্তরে প্রচণ্ড আতঙ্ক তৈরি করতে সক্ষম হন। তার একজন সহযোদ্ধা এ সম্পর্কে বলেন, যখনই বিপ্লববিরোধীদের কাছে এ খবর পৌঁছাত যে, হাজি আহমাদ তাদের বিরুদ্ধে হামলা করতে যাচ্ছেন তখন তারা পলায়নকেই শ্রেষ্ঠ পন্থা মনে করত। ১৯৮১ সালের মাঝামাঝি সময়ে হাজি আহমাদ পবিত্র হজ্বব্রত পালন শেষে দেশে ফিরে এলে তাকে সাঁড়াশি অভিযান চালানোর জন্য দক্ষিণ ইরানে পাঠানো হয়। ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গাড বাহিনী বা আইআরজিসির প্রধান কমান্ডার তাকে দক্ষিণ ইরানের বিপ্লববিরোধীদের দমন করার জন্য একটি ব্রিগেড গঠন করার নির্দেশ দেন। মোহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ (সা.) নামের ওই ব্রিগেডটি পরবতীতে ডিভিশনে উন্নীত হয়।
ব্রিগেডটিকে ১৯৮২ সালে খোররামশাহর মুক্ত করার অভিযানে কাজে লাগানো হয়। বায়তুল মুকাদ্দাম নামক বিখ্যাত ওই অভিযানে আইআরজিসি ও সেনাবাহিনী সম্মিলিতভাবে অংশগ্রহণ করে। হাজি আহমাদ মুতাওয়াসসেলিয়ান ব্রিগেড কমান্ডারের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি শত্রুসেনাদের অবস্থান চিহ্নিত করার কাজেও অংশগ্রহণ করতেন। আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীর সম্ভাব্য অভিযান ও তার সম্ভাব্য গতিপথ শনাক্ত করার পাশাপাশি সে অভিযান প্রতিহত করার রোডম্যাপও চূড়ান্ত করতেন আহমাদ মুতাওয়াসসেলিয়ান।