সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২৩ ২১:০৮ Asia/Dhaka

দখলদার ইরাকি বাহিনীর হাত থেকে খোররামশাহর মুক্ত করার অভিযানের অন্যতম কমান্ডার ছিলেন হাজি আহমাদ মুতাওয়াসসেলিয়ান। তিনি তার সেনা ইউনিটকে নিয়ে এমন বীরবিক্রমে যুদ্ধ করেন যে মনে হচ্ছিল, তিনি যেন চারটি ব্রিগেড নিয়ে ইরাকিদের বিরুদ্ধে লড়াই করছিলেন।

বায়তুল মুকাদ্দাস নামের ওই অভিযানের সবচেয়ে কঠিন অংশ পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল আহমাদ মুতাওয়াসসেলিয়ানকে। এ কারণে তাকে ‘খোররামশাহরের অন্যতম বিজয়ী’ বলে স্মরণ করা হয়। দক্ষিণ ইরাকে যুদ্ধ করার আগে তিনি ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মদদপুষ্ট বিপ্লব-বিরোধী গোষ্ঠীগুলো নির্মূলের অভিযানে অনন্য ভূমিকা পালন করেন।  বিপ্লব বিরোধী গোষ্ঠীগুলোর হাত থেকে ইরাক সীমান্তবর্তী ইরানের কুর্দিস্তান প্রদেশের সানান্দাজ, মাহাবাদ, মিরাভান, বানে ও পাভে শহর মুক্ত করার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব মুতাওয়াসসেলিয়ানের প্রাপ্য।

ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী এই মহান কমান্ডার সম্পর্কে বলেন: “হাজি আহমাদ মুতাওয়াসসেলিয়ান আল্লাহর রাস্তায় জীবন উৎসর্গকারী একজন খাঁটি মানুষ ছিলেন। আমি যখন মারিভান শহর পরিদর্শনে যাই তখন তাকে সেনা কমান্ডার হওয়া সত্ত্বেও একজন সাধারণ সিপাহির মতো দৌড়ঝাঁপ করতে দেখি। তার শরীরে কমান্ডারসুলভ কোনো ইগো তৈরি হয়নি। তিনি ছিলেন সত্যিকার অর্থে একনিষ্ঠ একজন মুমিন ব্যক্তি।” সর্বোচ্চ নেতা ইরানের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের এক সমাবেশে তার অন্য এক ভাষণে বলেন: “আমি ঘনিষ্ঠভাবে মহান কমান্ডার হাজি আহমাদ মুতাওয়াসসেলিয়ানকে চিনতাম এবং তার কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যাবসায় কাছে থেকে প্রত্যক্ষ করতাম। তিনি ছিলেন পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধের অন্যতম বীরসেনানী। আমার মতে, এসব বীরসেনানীকে নিয়ে লেখাপড়া ও গবেষণা করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অনেক কিছু জানতে পারবে।”

খোররামশাহর মুক্ত করার পর আহমাদ মুতাওয়াসসেলিয়ান ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসির একজন গুরুত্বপূর্ণ কমান্ডারে পরিণত হন। তিনি কয়েকজন কমান্ডারের সঙ্গে ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেনীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে তেহরানে আসেন। ওই সাক্ষাতে ইমাম খোমেনী (রহ.) আহমাদ মুতাওয়াসসেলিয়ানের ভুয়সী প্রশংসা করেন। পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধের কমান্ডারদের সঙ্গে ইমামের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত নিবিড়।  এই সম্পর্ক ছিল পিতা-পুত্র বা পীর-মুর্শিদ সম্পর্কের চেয়েও ঊর্ধ্বে। তাদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল আত্মিক ও আধ্যাত্মিক সম্পর্ক।

ইরান যখন খোররামশাহর মুক্ত করার জন্য বায়তুল মুকাদ্দাস অভিযান পরিচালনা করে তখন ইহুদিবাদী ইসরাইল ফিলিস্তিন মুক্তি ফ্রন্ট বা পিএলওকে দমনের অজুহাতে লেবাননে অণুপ্রবেশ করে। এ সময় ইসরাইলি আগ্রাসন প্রতিহত করার জন্য ইরান থেকে সিরিয়ায় সৈন্য পাঠানোর প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা হয়। 

হাজি আহমাদ মুতাওয়াসসেলিয়ান কয়েকজন সেনা কমান্ডারের সঙ্গে পরামর্শক্রমে সিরিয়ায় সেনা পাঠানোর একটি পরিকল্পনা তৈরি করেন। স্বেচ্ছায় সিরিয়ায় গিয়ে যুদ্ধ করতে ইচ্ছুক এমন ৫০০ সৈন্যের সমন্বয়ে তিনি একটি ব্রিগেড গঠন করেন। ব্রিগেডটি নিয়ে হাজি আহমাদ সিরিয়ায় গমন করেন এবং দেশটির লেবানন সীমান্তবর্তী ‘জাবদানি’ এলাকায় ঘাঁটি গাড়েন। সে সময় সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন হাফেজ আল-আসাদ এবং তিনি  ইসরাইলবিরোধী প্রতিরোধ অক্ষে যোগ দিয়েছিলেন।  ইরাক-ইরান যুদ্ধে বেশিরভাগ আরব দেশ যখন বাগদাদকে সমর্থন দেয় তখন হাফেজ আল-আসাদ ইরানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখেন এবং ইরাকি শাসক সাদ্দামের কাছ থেকে সিরিয়াকে দূরে সরিয়ে রাখেন। হাজি আহমাদ মুতাওয়াসসেলিয়ান সিরিয়া সীমান্ত থেকে লেবাননের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ শেষে নীতি-নির্ধারকদের সঙ্গে পরামর্শ করতে তেহরানে ফিরে আসেন।

তিনি তেহরানে এসে ইরানের সেনাবাহিনী ও আইআরসিজির পদস্থ কর্মকর্তাদের সামনে নিজের অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন। তার পরামর্শ গ্রহণ করে বিষয়টি সম্পর্কে চূড়ান্ত দিক-নির্দেশনা পাওয়ার জন্য সেনা কর্মকর্তারা ইমাম খোমেনীর সঙ্গে দেখা করতে যান। সেখানে কমান্ডারদের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ইমাম বলেন: “সিরিয়া ও লেবাননে ইহুদিবাদী ইসরাইল যে আগ্রাসন চালিয়েছে তার উদ্দেশ্য ইরানকে তার আসল দায়িত্ব অর্থাৎ ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা থেকে বিরত রাখা।” এরপর তিনি বলেন, ইহুদিবাদীদের কবল থেকে কুদস বা বায়তুল মুকাদ্দাস মুক্ত করার গুরুদায়িত্ব পালন করার আগে ইরাকি বাহিনীর আগ্রাসন থেকে ইরানকে মুক্ত করতে হবে। অর্থাৎ ইমামের দৃষ্টিতে ইসরাইলের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ করার সময় এখনও আসেনি।  তাই তিনি অবিলম্বে সিরিয়ায় পাঠানো সেনাদলকে প্রত্যাহার করে দেশে ফেরত আনার নির্দেশ জারি করেন।

এ সম্পর্কে ইরানের সাবেক সেনাপ্রধান শহীদ লে. জেনারেল সাইয়্যাদ শিরাজি বলেন: আমরা ১৯৮২ সালের ২৬ জুন ইমামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাই। সিরিয়ায় আমরা কী করেছি সে সম্পর্কে ইমামকে অবগত করার পর এখন কী করনীয় তা ইমামের কাছে জানতে চাই। তিনি আমাদের কথা মনযোগ দিয়ে শোনার পর বলেন: “তোমরা সেখানে যেসব সৈন্য পাঠিয়েছো তাদের শরীর থেকে যদি এক ফোটা রক্ত ঝরে তাহলে আমি তার দায়িত্ব নেব না। এখনই তাদেরকে দেশে ফিরতে বলো।” আমি সেদিনের আগ পর্যন্ত ইমামকে এত কঠোর নির্দেশ জারি করতে দেখিনি।  আমরা দ্রুত সিরিয়ায় পাঠানো সৈন্যদের দেশে ফেরত আনার ব্যবস্থা করি।

এভাবে ইমামের নির্দেশে বেশিরভাগ সেনাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হলেও তাদের মুষ্টিমেয় কয়েকজনকে হাজি আহমাদ মুতাওয়াসসেলিয়ানের নেতৃত্বে সিরিয়ায় রেখে দেওয়া হয়।  এ সময়ে বৈরুতস্থ ইরান দূতাবাসের চার্জ দ্যা অ্যাফেয়ার্স সাইয়্যেদ মোহসেন মুসাভি ১৯৮২ সালের ৫ জুলাই জাবদানি ঘাঁটিতে মোতায়েন ইরানি সেনা কমান্ডারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে সিরিয়ায় যান। তিনি বৈরুতের পরিস্থিতি সম্পর্কে হাজি আহমাদ মুতাওয়াসসেলিয়ানকে অবহিত করেন। ইরানি এই অভিজ্ঞ সেনা কমান্ডার নিজে বৈরুত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার জন্য লেবানন গমনের সিদ্ধান্ত নেন এবং মোহসেন মুসাভির সঙ্গে তার কূটনৈতিক নম্বর প্লেট লাগানো গাড়িতে ওঠেন। সঙ্গে নেন তার ব্রিগেডের সেনা প্রশিক্ষক তাকি রাস্তেগার মোকাদ্দাম এবং বার্তা সংস্থা ইরনার রিপোর্টার ও ক্যামেরাম্যান কাজেম আখাভানকে। তাদের কূটনৈতিক গাড়িটি স্কর্ট করার জন্য লেবাননের ডিপ্লোমেটিক পুলিশের একটি দলও তাদের সঙ্গে ছিল।

গাড়িটি বৈরুত থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে ‘বারবারা’ নামক স্থানে পৌঁছালে ইসরাইলের সমর্থনপুষ্ট লেবাননের উপদল ‘ফ্যালাঞ্জিস্ট’ বাহিনীর হাতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। সে সময়ে গৃহযুদ্ধ কবলিত লেবাননে সামির জা’জা’ নামক একজন রাজনীতিকের নেতৃত্বাধীন ফ্যালাঞ্জিস্ট বাহিনীর স্থাপিত একটি চেকপোস্টে ইরানি কূটনীতিক ও সেনা কমান্ডারকে বহনকারী গাড়িটিকে অপহরণ করা হয়। তখন থেকে আজ পর্যন্ত বিগত ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে আহমাদ মুতাওয়াসসেলিয়ান ও তার বাকি তিন অনুগামীর ভাগ্যে কী ঘটেছে তা জানা যায়নি। তবে তাদের সম্পর্কে অনেক জল্পনা ও গুজব রটেছে। পরবর্তী সময়ে সামির জা’জা অনেকগুলো অভিযোগে গ্রেফতার হন এবং তিনি মুক্তি পাওয়ার পর স্বীকার করেন, ইরানি পণবন্দিদেরকে তার বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল এবং তার বাহিনীর মিলিশিয়ারা ওই চার ইরানিকে হত্যা করেছে। কিন্তু ইরান সরকার সামিরের এই বক্তব্যকে শুরু থেকেই সন্দেহের চোখে দেখেছে। অন্য এক বর্ণনায় জানা যায়, আহমাদ মুতাওয়াসসেলিয়ান ও তার তিন অনুগামীকে অপহরণ করার পর ইহুদিবাদী ইসরাইলের হাতে তুলে দেওয়া হয় এবং এখনও তারা ইসরাইলি কারাগারে বন্দি আছেন।

 

ট্যাগ